চিন্তার ক্ষমতা, সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনী দক্ষতা- মানুষের সবচেয়ে বড় তিন সম্পদ। এই তিনটি গুণকে একই সময়ে খুব দারুণভাবে কাজে লাগানোর সৌভাগ্য কিংবা সক্ষমতা ইতিহাসে খুব অল্প কিছু মানুষের হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই আজ নিজ নিজ নামে জগদ্বিখ্যাত। তেমনই এক অমিত প্রতিভাধর মানুষের গল্প নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। নাম তার মিচিও সুজুকি।
পদবী শুনেই অনেকে বুঝে ফেলেছেন কে ছিলেন এই মানুষটি। তার ছিল ঈশ্বর-প্রদত্ত অনন্য সাধারণ এক উদ্ভাবনী দক্ষতা। প্রকৃতির উপহার বৃথা যায়নি। মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজের নামে তিনি করেছিলেন শতাধিক উদ্ভাবনের পেটেন্ট। তবে যদি জানতে চাওয়া হয়, তার সৃজনশীল জীবনের ‘ম্যাগনাম ওপাস’ কী, অবশ্যই সেটি হবে ‘সুজুকি মোটর কর্পোরেশন’।
মিচিও সুজুকির জন্ম ১৮৮৭ সালে, জাপানের ছোট্ট একটি গ্রাম নেজুমিনো-মুরাতে। ‘ছোট্ট’ শব্দটি থেকে যারা পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে পারছেন না, তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে দিই, ওই গ্রামে ছিল মাত্র ৩২টি ঘর! সুজুকি ছিলেন এক কৃষক পিতার দ্বিতীয় পুত্র। ছেলেবেলাটা তার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য তুলা সংগ্রহতেই কেটেছে। তখনও এসব কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও উদ্ভাবন তো দূরে থাক, বিদ্যুৎ বলে যে কিছু একটা আছে, সেটির সাথেই তার পরিচয় হয়নি!
নেজুমিনো-মুরা গ্রামের মানুষদের প্রধান কাজই ছিল তাঁত বোনা। তাঁতের শব্দ শুনতে শুনতে শৈশব-কৈশোর কেটেছে সুজুকির। পরে কিছুদিন শিক্ষানবিশ হিসেবে তিনি কাজ করেছেন একটি তাঁত কারখানায়। নিজের চোখে দেখেছেন, তার মাকে প্রতিদিন তাঁত বোনার কাজে কী অক্লান্ত পরিশ্রমই না করতে হয়। সেই কষ্টের কিছুটা নিজেও অনুভব করতে পারতেন সুজুকি। আর তাই সেটা খানিকটা কমাতে গিয়েই যেন তিনি প্রথম স্বাক্ষর রাখেন তার উদ্ভাবনী ক্ষমতার। সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় লোহা ও কাঠের সমন্বয়ে একটি তাঁত তৈরি করেন তিনি মায়ের জন্য, যা আগেকার যেকোনো মডেলের যন্ত্রের চেয়ে দশ গুণ দ্রুত কাজ করতে সক্ষম ছিল!
যখনের কথা বলছি, সেটি ১৯০৮ সাল। ততদিনে বৈদ্যুতিক শক্তির সাথে মানুষের ভালোই পরিচয় হয়ে গেছে। ফলে তাঁতের চাহিদাও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় সুজুকি যখন সেসময়ের সবচেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন তাঁতের উদ্ভাবন করেন, এ কথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিকে দিকে। মানুষজন তাকে ধন্যি ধন্যি তো করলই, পাশাপাশি তাঁত তৈরির অনেকগুলো অর্ডারও পেয়ে গেলেন তিনি।
পারিবারিক সিল্কওয়ার্ম হাউজকে ওয়ার্কশপ বানিয়ে একটি তাঁত হয়তো বানানো গেছে মায়ের জন্য, কিন্তু সেখানেই তো এই সব অর্ডারের তাঁত তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই ১৯০৯ সালে ২০০ বর্গমিটারের একটি ধার করা জমির উপর সুজুকি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সুজুকি লুম ম্যানুফ্যাকচারিং’। আর তার এই প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র হিসেবে বেছে নিলেন ‘আত্মনির্ভরশীলতা’ শব্দটিকে।
পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য সুজুকি সবসময় ক্রেতাদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করলেন। তাদের কোনো মন্তব্যই তিনি ফেলনা ভেবে উড়িয়ে দিতেন না। কারণ তিনি জানতেন, যত বেশি মানুষের ধারণার সম্মিলন ঘটবে, উদ্ভাবন হবে তত বেশি বৈচিত্র্যময় ও কার্যকর। এজন্যই তার প্রিয় কথা ছিল, “সবসময় ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করো। সে যা চায়, তা-ই তাকে সরবরাহ করো।” বলা বাহুল্য, এই দর্শন মেনেই অসংখ্য গ্রাহকের মন জয় করতে সক্ষম হলেন সুজুকি।
নিজে তাঁত সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখার পরও, কখনও আত্মতুষ্টিতে ভুগতেন না সুজুকি। নিজের জানাকে জ্ঞানের শেষ পর্যায় বলেও মনে করতেন না। তার বিশ্বাস ছিল, শিক্ষার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁতিদের সাথে যোগাযোগ করতেন তিনি, নতুন কিছু জানার জন্য। তাদের ধারণা ও দর্শন সম্পর্কে জেনে নিজে সমৃদ্ধ হতেন, এবং নিজের উৎপাদিত পণ্যের মান বৃদ্ধি করতেন। এভাবেই তিনি অসংখ্য পেটেন্ট করতে সক্ষম হন নিজের নামে। বাড়তে থাকে তার পণ্যের চাহিদা। সেইসাথে জিততে থাকেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
সুজুকির জীবনে দারুণ এক সময় হয়ে আসে ১৯৩০ সালটি। কারণ এ বছরই তার উদ্ভাবিত সারং তাঁত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি শুরু হয়, এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে সুজুকির নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। সারং তাঁতের অভাবনীয় সাফল্য সুজুকির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে, তাকে অনুপ্রেরণা জোগায় নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা অব্যহত রাখতে।
কেবল তাঁত শিল্পে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না সুজুকি। স্বপ্ন যার ছিল আরও বড় কিছু করার, তার আসলে থেমে যাবার কথাও নয়। দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অনুধাবন করেছিলেন, প্রতিদিনের ব্যবহারিক কাজের জন্য মানুষের দরকার ছোট আকারের, সাধ্যে কুলাবে এমন দামের কোনো যানবাহন। আর তাঁত শিল্পকে গড়ে তুলতে গিয়ে মোটর সংক্রান্ত যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন, তা দিয়ে গাড়ি নির্মাণে হাত দেয়াও তার জন্য তখন আর অসম্ভব কিছু ছিল না।
সেই ভাবনার প্রকাশ হিসেবেই ১৯৩৭ সালে সুজুকি প্রাথমিকভাবে তৈরি করলেন তার গাড়ি। গড়ে তুললেন ৮০০ সিসি লিকুইড কুলড, চার স্ট্রোক ও চার সিলিন্ডার ইঞ্জিনের একটি প্রোটোটাইপ– তখনকার দিনে যেটি ছিল একটি সত্যিকারের বৈপ্লবিক উদ্ভাবন। এছাড়াও সেই প্রোটোটাইপে ছিল একটি কাস্ট অ্যালুমিনিয়াম ক্রাঙ্ককেস ও গিয়ারবক্স, যেটি তখন উৎপাদন করতে পারত ১৩ হর্সপাওয়ার শক্তি (৯.৭ কিলোওয়াট)!
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে অন্য অনেক কিছুর মতো পণ্ড করে দেয় সুজুকির সব পরিকল্পনাও। যুদ্ধের শুরুর দিকেই জাপান সরকার সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়িকে আখ্যায়িত করে ‘নন-এসেনশিয়াল কমোডিটি’ হিসেবে, ফলে প্রোটোটাইপ থেকে বড় আকারে গাড়ি উৎপাদন আর সম্ভব হলো না সেই সময়ে।
যুদ্ধ শেষে সুজুকি আবার ফিরে গেলেন তাঁত উৎপাদনে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার জাপানে তুলা প্রেরণের অনুমোদন দিলে তাঁতের উৎপাদন বেড়ে যায় নাটকীয়ভাবে। স্থানীয় টেক্সটাইল প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে অর্ডারের পরিমাণও যেন আকাশ ছুঁতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৫১ সালের দিকে ধস নামে তুলার বাজারে, ফলে তাঁতের চাহিদাও কমে আসতে থাকে তরতর করে। ঠিক এই সময়ে সুজুকি আবার ভাবতে শুরু করেন গাড়ি নিয়ে তার পুরনো স্বপ্নের নতুন বিনির্মাণের জন্য।
যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান তখনও কেবল পারমাণবিক বোমার আঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তাই সেসময় তাদের আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে সুলভ মূল্যের ব্যক্তিগত যানের প্রয়োজনীয়তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। তখন কিছু ফার্ম ‘ক্লিপ-অন’ গ্যাসচালিত ইঞ্জিন প্রস্তুত করতে শুরু করে, যা সাধারণ বাইসাইকেলের সাথে লাগানো যেত। এদিকে সুজুকির ছেলে শুনজো সুজুকি ডিজাইন করেন ‘পাওয়ার ফ্রি’ নামক মোটরচালিত বাইসাইকেলের, যেটি দামের দিক থেকে ছিল খুবই সাশ্রয়ী, আর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণও ছিল একদম সহজ।
সুজুকির নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতিটি তখনকার দিনে এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, নতুন জাপানি সরকারের পেটেন্ট অফিস সুজুকিকে আর্থিক ভর্তুকিও দিতে শুরু করে এর নির্মাণ প্রকৌশল চালিয়ে যাওয়ার জন্য। সাধারণ মানুষের মাঝেও এটি হয়ে ওঠে প্রচণ্ড জনপ্রিয়। সেই সূত্র ধরেই, ১৯৫৪ সালে প্রতি মাসে ৬,০০০ মোটরসাইকেল উৎপাদন করার কাজে হাত দেন সুজুকি। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে বদলে ফেলেন তার প্রতিষ্ঠানের নাম। নতুন নাম হয় ‘সুজুকি মোটর কর্পোরেশন লিমিটেড’।
এমনই ছিল বিশ্ববিখ্যাত সুজুকির যাত্রার শুরুটা। ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মিচিও সুজুকি এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করেন। বয়স যখন ৭০ এর কোঠায়, তখন অবসর গ্রহণ করেন তিনি, দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তার সুযোগ্য পুত্ররা। ১৯৮২ সালে যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তিনি, ততদিনে সুজুকির গাড়ি হয়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে মানুষের আস্থার এক অনন্য প্রতীক।
দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে এরপর কীভাবে শুরু হয়েছিল সুজুকি মোটর কর্পোরেশনের পথচলা, কীভাবে এটি পরিণত হয়েছে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় এক ব্র্যান্ডে, সেসব সাফল্যময় গল্পই আমরা শুনব এই সিরিজের পরবর্তী পর্বে।