ওয়ানডে ক্রিকেটে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখার কারণে ১৯৯২ বিশ্বকাপ অনেকের কাছেই এখন পর্যন্ত হওয়া শ্রেষ্ঠ বিশ্বকাপ। কিন্তু যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার হিসাবে শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয়, তবে কোন আসরটি জায়গা পাবে? এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি আসরের নাম আসলেও অন্য সবগুলোর চেয়ে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকার কথা। অসাধারণ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ, নাটকীয় কিছু মোড়ের কারণে এই বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে।
সপ্তম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে, প্রথম তিন আসরের আয়োজক হওয়ার পর ১৬ বছর বাদে আবারও ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফেরে তার জন্মভূমিতে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের মতো এই আসরেও অংশগ্রহণকারী দল ছিল ১২টি, এবং দলগুলোকে আগের আসরের মতো দুইটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। তবে এবার কোয়ার্টার ফাইনালের বদলে সুপার সিক্স নামক ফরম্যাট চালু করা হয়, অর্থাৎ প্রতি গ্রুপ থেকে চারটি দলের বদলে তিনটি দল যাবে পরের রাউন্ডে। গ্রুপপর্ব থেকেই জমে ওঠে এই বিশ্বকাপ।
গ্রুপ এ
গ্রুপ এ’তে ছিল ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া। আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা ও স্বাগতিক ইংল্যান্ড। স্বাগতিকদের কাছে অবশ্য পাত্তা পায়নি লঙ্কানরা, আট উইকেটের জয় তুলে নিয়ে টুর্নামেন্টের শুরুটা দারুণভাবে করে ইংলিশরা। আগের আসরের অনবদ্য পারফরম্যান্সের ছিঁটেফোঁটাও এই আসরে দেখাতে পারেনি শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ার বিপক্ষে দুই জয় বাদে বাকি সব ম্যাচে বেশ বাজেভাবে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয় তারা।
এই গ্রুপে সারপ্রাইজ প্যাক হিসেবে আগমন ঘটে জিম্বাবুয়ের। নিজেদের প্রথম ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের মুখোমুখি হয় তারা। লেস্টারে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ৬৮ রান, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারের ৪৫ রান ও বাকি খেলোয়াড়দের ছোট ছোট অবদানে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৯ উইকেটে ২৫২ রান সংগ্রহ করে জিম্বাবুয়ে। তবে স্লো-ওভার রেটের কারণে ভারতের ইনিংস থেকে ৪ ওভার কেটে নেওয়া হয়। জবাব দিতে নেমে মাত্র ৫৬ রানে ৩ উইকেট হারালেও সদাগোপন রমেশ ও অজয় জাদেজার ৯৯ রানের জুটিতে জয়ের কক্ষপথেই ছিল তারা।
কিন্তু এই জুটি ভাঙার পর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনে ভারত। তবে রবিন সিং একা লড়ে ম্যাচটাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যান। এক পর্যায়ে ৩ উইকেট হাতে রেখে ভারতের দরকার ছিল ১১ বলে ৭ রান, কিন্তু সেই সময়েই হেনরি ওলোঙ্গার বলে আউট হয়ে যান রবিন। এরপর ওই ওভারের শেষ দুই বলে শ্রীনাথ ও প্রসাদকে ফিরিয়ে দিয়ে জিম্বাবুয়েকে ৩ রানের নাটকীয় এক জয় উপহার দেন ওলোঙ্গা। ব্যাট হাতে ৪৫ রানের পর বল হাতে অবদান রাখায় ম্যাচসেরা অবশ্য গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারই নির্বাচিত হন।
এরপরের দুই ম্যাচে শ্রীলঙ্কা ও স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ায় সুপার সিক্সে যেতে হলে নিজেদের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ওপেনার নিল জনসনের ৭৬ রানে ভর করে ২৩৩ রানের লড়াকু সংগ্রহ দাঁড় করায় জিম্বাবুয়ে। জবাব দিতে নেমে মাত্র ৪০ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে যায় প্রোটিয়ারা, এরপর শন পোলক ও ল্যান্স ক্লুজনারের ফিফটিতে সেই বিপর্যয় সামলালেও তা দক্ষিণ আফ্রিকার পরাজয় ঠেকাতে যথেষ্ট ছিল না, ৪৮ রানে ম্যাচটা জিতে নিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শেষ ছয়ে জায়গা করে নেয় জিম্বাবুয়ে। আর নেট রানরেটে পিছিয়ে থাকায় স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়।
এই ম্যাচ হারলেও গ্রুপ পর্বের বাকি ম্যাচগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকার পারফরম্যান্স ছিল দারুণ, আগের চারটা ম্যাচেই জিতে সুপার সিক্স আগেই নিশ্চিত করে ফেলেছিল তারা। তবে এই প্রোটিয়াদের এই দাপটে দলীয় পারফরম্যান্সের চেয়ে একজনের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য অনেক বেশি ভূমিকা রেখেছিল, তিনি প্রোটিয়া অলরাউন্ডার ল্যান্স ক্লুজনার। একটা আসরে একজন খেলোয়াড় দুই-তিনটা ম্যাচে অনবদ্য খেলে দলকে জেতাতে পারেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ক্লুজনার সেবার প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই এমন পারফরম্যান্স উপহার দিচ্ছিলেন, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বল হাতে তো কার্যকর ছিলেনই, তবে তিনি আসল জাদুটা দেখিয়েছিলেন ব্যাট হাতে। ব্যাটিংয়ে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপদে পড়বে আর তিনি এসে দলকে উদ্ধার করবেন – এটি ছিল সেই আসরের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য।
ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ক্লুজনারের তেমন সাহায্য ছাড়াই সহজ জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। আসল খেলাটা শুরু হয় এরপরের ম্যাচ থেকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ১২২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে যখন দিশেহারা প্রোটিয়ারা, তখনই প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যান তিনি। ৪৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে দলকে এনে দেন ১৯৯ রানের লড়াকু সংগ্রহ। এরপর বল হাতে তিন উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ৮৯ রানের বড় জয়টাও নিশ্চিত করেন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেও আবারও বিপদে প্রোটিয়ারা, আর আবারও ত্রাণকর্তা সেই ক্লুজনার। দলীয় সংগ্রহ যখন ১৪৭/৭, তখন ৪০ বলে অপরাজিত ৪৮ রান করে দলকে পৌঁছে দেন ২২৫ রানে। এরপর বল হাতেও ১ উইকেট নিয়ে এ ম্যাচেও ম্যাচসেরা হন তিনি। পরের ম্যাচে কেনিয়ার সাথেও ঝলক দেখান, তবে এবার আর ব্যাট হাতে তাকে দরকার হয়নি। বল হাতে পাঁচ উইকেট নিয়ে টানা তিন ম্যাচে ম্যাচসেরা হওয়ার দারুণ কীর্তি গড়েন এই অলরাউন্ডার।
এই গ্রুপ থেকে সুপার সিক্স নিশ্চিত করা আরেক দল ছিল ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের কাছে হারলেও শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও কেনিয়ার বিপক্ষে প্রাপ্ত বড় জয় তাদেরকে সুপার সিক্স নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। গ্রুপপর্বে ভারতের পারফরম্যান্সে বেশ কিছু স্মরণীয় ঘটনা ছিল, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে সৌরভ গাঙ্গুলি খেলেন ১৫৮ বলে ১৮৩ রানের অনবদ্য এই ইনিংস। এই ম্যাচেই রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে ৩১৮ রানের জুটি গড়েন সৌরভ, যা দীর্ঘদিন ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রানের জুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এছাড়া কেনিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার পর আকাশের দিকে তাকিয়ে শচীন যেভাবে নিজের সদ্যপ্রয়াত বাবাকে স্মরণ করেছিলেন, তা অনেকের চোখেই জল এনে দিয়েছিল।
গ্রুপ বি
গ্রুপ এ’এর তুলনায় গ্রুপ বি’তে নাটক কিছুটা কমই হয়েছিল। এই গ্রুপের ছয়টি দল ছিল পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, উইন্ডিজ, স্কটল্যান্ড ও বাংলাদেশ। এই গ্রুপে একচেটিয়া দাপট দেখায় ওয়াসিম আকরামের পাকিস্তান, প্রথম চারটি ম্যাচ জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করে তারা। নিয়ম রক্ষার শেষ ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ, বিশ্বমঞ্চে নিজেদের অভিষেক আসরে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল স্কটল্যান্ডকে হারানো, আর সেটা পূরণ হয়ে যাওয়ায় এই ম্যাচটা নির্ভার হয়েই খেলতে নেমেছিলো টাইগাররা।
নর্দাম্পটনে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে আকরাম খানের ৪২ রান ও বাকিদের ছোট ছোট সংগ্রহে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৯ উইকেটে ২২৩ রান করে টাইগাররা। জবাব দিতে নেমে বাংলাদেশী বোলারদের আঁটসাঁট বোলিংয়ে শুরু থেকেই চাপে ছিল পাকিস্তান, শেষ পর্যন্ত ৬২ রানের এক অভাবনীয় জয় তুলে নিয়ে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় টাইগাররা। এই একটা জয় বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিশাল এক ভূমিকা রাখে।
এই গ্রুপে সুপার সিক্সে উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, উইন্ডিজ ও নিউ জিল্যান্ডের মধ্যে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। প্রথম চার ম্যাচ শেষে ছয় পয়েন্ট ও রানরেটেও এগিয়ে থেকে সেই লড়াইয়ে অবশ্য ক্যারিবিয়ানরাই এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড উভয় দলের পয়েন্টই ছিল ৪, নেট রানরেটেও দুই দল উইন্ডিজের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। তাই শেষ ম্যাচে দুই দলের সামনেই জয় ভিন্ন অন্য কোনো পথ ছিল না।
সেই লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল উইন্ডিজ, টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে গ্লেন ম্যাকগ্রা ও শেন ওয়ার্নের বোলিং তোপে মাত্র ১১০ রানে গুটিয়ে যায় উইন্ডিজ। সুপার সিক্স নিশ্চিত করতে হলে ৪৭.২ ওভারের মধ্যে অজিদের এই রান টপকাতে হতো। ব্যাটসম্যানদের ছোট ছোট ইনিংসে ৬ উইকেট হাতে রেখে ৪০.৪ ওভারেই এই রান তাড়া করে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলে অস্ট্রেলিয়া।
এই ম্যাচের ফলাফলের পর সুপার সিক্সে যেতে হলে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নিউ জিল্যান্ডকে বড় ব্যবধানে জিততে হতো। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ১২১ রানে গুটিয়ে যায় স্কটিশরা, হিসাবনিকাশ অনুযায়ী সুপার সিক্সে উঠতে গেলে ২১.২ ওভারের মধ্যে এই রান তাড়া করতে হতো ব্ল্যাক ক্যাপসদের। রজার টোজের ঝড়ো ফিফটিতে ১৭.৫ ওভারে এই রান তাড়া করে সুপার সিক্স নিশ্চিত করে নিউ জিল্যান্ড। আর সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় উইন্ডিজকে।
নাটকীয় সুপার সিক্স
ফরম্যাট অনুযায়ী সুপার সিক্সে উত্তীর্ণ প্রতিটি দল অপর গ্রুপ থেকে উত্তীর্ণ তিনটি দলের মুখোমুখি হবে। তবে গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলোর ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সুপারে সিক্স শুরু হওয়ার আগেই প্রতিটি দলের ঝুলিতে বেশ কিছু পয়েন্ট দিয়ে দেওয়া হয়। নিজ গ্রুপ থেকে যে দুই দল কোয়ালিফাই করেছে, তাদের বিপক্ষে গ্রুপপর্বে প্রতিটি জয়ের দেওয়া হয় দুই পয়েন্ট। এই নিয়মের ফলে অনেক সমীকরণই উল্টে গেলো।
গ্রুপ এ’তে পয়েন্ট টেবিলে জিম্বাবুয়ের অবস্থান ছিল তৃতীয়, কিন্তু ওই গ্রুপ থেকে উত্তীর্ণ বাকি দুই দল দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের বিপক্ষে গ্রুপপর্বে জয় পাওয়ায় ৪ পয়েন্ট নিয়েই সুপার সিক্স শুরু করে তারা। ফলে সুপার সিক্সে তিন ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পেলেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যেতো তাদের। কিন্তু দুই ম্যাচে হার ও নিউ জিল্যান্ডের সাথে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হওয়ায় সুপার সিক্সেই থেমে যায় জিম্বাবুয়ের স্বপ্নযাত্রা।
অন্যদিকে, গ্রুপের পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও গ্রুপ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের কাছে হারের কারণে ভারত সুপার সিক্স শুরু করে একদম খালি হাতে। সেমিফাইনালে যেতে হলে এই রাউন্ডের সবগুলো ম্যাচেই তাদের জিততে হতো। এই কঠিন চ্যালেঞ্জের শুরুতেই অজিদের কাছে ৭৭ রানে হেরে তারা হোঁচট খায়, এরপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে ৪৭ রানে হারালেও শেষ ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের কাছে হেরে সুপার সিক্সের পয়েন্ট টেবিলের একদম তলানিতে থেকেই আসর শেষ করে ভারত। আর এই জয়ের ফলে ব্ল্যাক ক্যাপসদের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে, গ্রুপপর্ব থেকে চার পয়েন্ট নিয়ে আসা পাকিস্তান এই রাউন্ডে শুধুমাত্র জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিতেই সুপার সিক্সের পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে উঠে যায়।
সুপার সিক্সের সবচেয়ে বড় নাটকটা অপেক্ষা করছিল ওই রাউন্ডের শেষ ম্যাচে, যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপপর্ব থেকে খালি হাতে সুপার সিক্সে আসায় সেমিফাইনালে যেতে হলে তিন ম্যাচেই জিততে হতো অজিদের, ভারত ও জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে সেই লক্ষ্যের দিকেই ছুটছিল তারা। অন্যদিকে, গ্রুপপর্ব থেকে প্রাপ্ত দুই পয়েন্ট, সাথে সুপার সিক্সে নিউ জিল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হারানোয় দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তবুও এই ম্যাচে জেতার জন্য নিজেদের সেরাটা নিয়েই খেলতে নেমেছিল তারা, কারণ এই ম্যাচ জিতলে সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে পেতো তারা, আর হারলে এই অজিদেরই সেমিতে মোকাবেলা করতে হতো।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে হার্শেল গিবসের সেঞ্চুরিতে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৭ উইকেটে ২৭১ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় দক্ষিণ আফ্রিকা। জবাব দিতে নেমে মাত্র ৪৮ রানে তিন উইকেট হারিয়ে বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিল অজিরা, সেখান থেকে পন্টিংকে সাথে ইনিংস মেরামতের দায়িত্ব নিলেন অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। পন্টিং ৬৯ রানে ফিরে গেলেও স্টিভ ওয়াহ ছিলেন নিজের দায়িত্বে অবিচল, ১১০ বলে ১২০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে ৫ উইকেটের জয় তুলে নিয়ে অজিদের সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত করেন তিনি।
অথচ সেদিন ব্যক্তিগত ৫৬ রানেই সাজঘরে ফিরে যেতে পারতেন ওয়াহ, ল্যান্স ক্লুজনারের বলে মিড উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকা গিবস ক্যাচটা তালুবন্দীও করেছিলেন, কিন্তু অতি দ্রুত উদযাপন করতে গিয়ে বল হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন তিনি! তখন হয়তো গিবস নিজেও বুঝতে পারেননি, এই একটা ক্যাচ মিসের কত বড় মাশুল তার দলকে সেমিফাইনালে গুনতে হবে।
বিপরীত মেরুর দুই সেমিফাইনাল
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে প্রথম সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৭ উইকেটে ২৪৭ রান সংগ্রহ করে নিউ জিল্যান্ড। জবাব দিতে নেমে সাঈদ আনোয়ার ও ওয়াজাহাতুল্লাহ ওয়াস্তির উদ্বোধনী জুটি থেকেই ১৯৪ রান পেয়ে যায় পাকিস্তান। ওয়াস্তি ৮৪ রানে আউট হলেও ১১৩ রানে অপরাজিত থেকে পাকিস্তানের ৯ উইকেটের জয় নিশ্চিত করেন সাঈদ আনোয়ার।
তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সেমিফাইনালের ঘাটতি সুদে আসলে পূরণ করে দেয় দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে শন পোলক ও অ্যালান ডোনাল্ডের বোলিং তোপে একদমই সুবিধা করতে পারেনি অজিরা, শেষ পর্যন্ত স্টিভ ওয়াহ ও মাইকেল বেভানের ফিফটিতে ৪৯.২ ওভারে ২১৩ রানে অলআউট হয় তারা। মাঝারি মানের এই সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে শেন ওয়ার্নের ঘূর্ণিতে মাত্র ৬১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় প্রোটিয়ারা। সেখান থেকে ক্যালিস ও রোডসের ৮৪ রানের জুটিতে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় তারা। তবে এই জুটি ভাঙার পর আবার আরেক মড়ক লাগে প্রোটিয়াদের ইনিংসে। কিন্তু এত কিছুর মাঝে একা লড়ে যেতে থাকেন ল্যান্স ক্লুজনার।
আগেই বলা হয়েছে, সেই আসরে অস্বাভাবিক ভালো ফর্মে ছিলেন ক্লুজনার, এই ম্যাচের আগ পর্যন্ত ৭ ইনিংসে ব্যাট করে অপরাজিত ছিলেন পাঁচটি ইনিংসেই। এই ম্যাচেও সেই ধারা অব্যাহত রাখেন তিনি, তার লড়াকু ইনিংসে ভর করে খেলা শেষ ওভার পর্যন্ত নিয়ে যায় প্রোটিয়ারা। সেখানে তাদের দরকার ছিল ৯ রান, আর হাতে ছিল ১ উইকেট। ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের প্রথম দুই বলে দু’টি চার মেরে স্কোর সমান করে ফেলেন ক্লুজনার। বাকি চার বলে এক রান নিলেই প্রথমবারের মতো ফাইনালে চলে যাবে প্রোটিয়ারা। এই চাপটাই সামাল দিতে পারলেন না অ্যালান ডোনাল্ড, পাগলাটে এক ভোঁ দৌড় লাগালেন তিনি।
অথচ বল তখন ওয়াহর হাতে। ওয়াহর হাত থেকে বল যখন ফ্লেমিংয়ের হাতে এলো, তখন ক্লুজনার ও ডোনাল্ড দুজনেই একই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন! ডোনাল্ড তড়িঘড়ি করে আবার দৌঁড় শুরু করলেও লাভ হয়নি, তার আগেই গিলক্রিস্ট উইকেট ভেঙে দিয়ে প্রোটিয়াদের শেষ উইকেটের পতন নিশ্চিত করেন।
ম্যাচ টাই, কিন্তু সুপার সিক্সে নেট রান রেটে এগিয়ে থাকায় ফাইনালের টিকিট পায় অজিরাই। অথচ গিবস যদি সুপার সিক্সে অতি উত্তেজিত হয়ে হাত থেকে ক্যাচটা না ফেলতেন, তাহলে হয়তো এত কিছুই হতো না। এই ম্যাচেই যেমন, অন্য যেকোনো দিন হলে হয়তো অনায়াসেই বাকি দুই বল থেকে এক রান নিয়ে নিতে পারতেন ক্লুজনার। এই ব্যর্থতার লজ্জা ঢাকতেই হয়তো আর পেছনে ফিরে থামেননি তিনি, এক দৌঁড়েই চলে গেছেন প্যাভিলিয়নে। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি, এই ম্যাচ হারার মাধ্যমেই প্রোটিয়াদের গায়ে ‘চোকার্স’ তকমাটা আটকে গেছে অনেক দৃঢ়ভাবে।
একপেশে ফাইনাল
লর্ডসের ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে সেই আসরের ফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। গ্রুপপর্বে এই অস্ট্রেলিয়াকেই হারিয়েছিল পাকিস্তান, কিন্তু এই ম্যাচে তার ছিঁটেফোঁটাও পাওয়া গেল না। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে পাকিস্তান, শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৩২ রানেই গুটিয়ে যায় তারা। সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও বল হাতে নায়ক শেন ওয়ার্ন, মাত্র ৩৩ রানে ৪ উইকেট তুলে নেন তিনি।
জবাব দিতে নেমে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ঝড়ো ফিফটিতে অজিদের একটুও বেগ পেতে হয়নি, আট উইকেটে ম্যাচটা জিতে নিয়ে উইন্ডিজের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে অস্ট্রেলিয়া। এই ম্যাচেও ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়ে অরবিন্দ ডি সিলভার পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ম্যাচসেরা হওয়ার কীর্তি গড়েন শেন ওয়ার্ন। অন্যদিকে, সেমিফাইনালের ট্র্যাজিক হিরো হলেও পুরো আসরে ব্যাট-বলে অভাবনীয় পারফর্ম করায় টুর্নামেন্ট সেরা হন ল্যান্স ক্লুজনার। আর এর মাধ্যমেই পর্দা নামে বিংশ শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপের।