ভারতীয় ক্রিকেট নাড়িয়ে দেয়া ফিক্সিং-কাণ্ডের ইতিবৃত্ত: ১ম পর্ব

কি বললেন, বিপর্যয়? তা সে-রকম বিপর্যয়ে ভারতীয় ক্রিকেট এর আগেও পড়েছিল। একবার দলের প্রধানতম ছয় ক্রিকেটার বোর্ডের বিরুদ্ধে নেমেছিলেন আইনি লড়াইতে, অন্যবার বিশ্বকাপে বাজে ক্রিকেট খেলে বাদ পড়েছিল গ্রুপপর্ব থেকে, আরেকবার তো অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল বানর-বিতর্কে; চাইলে খুঁড়ে-টুঁরে বের করা যাবে এমন হাজার কেচ্ছা। কিন্তু ২০১৩ সালে যা হয়েছিল, তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, এমন বিতর্কের জন্ম নতুন করেই দেয়া লাগবে। আর সববার তো প্রতিদ্বন্দ্বী মিলেছিল, সেবারে যে লড়াইটা নিজের সঙ্গেই লড়তে হয়েছিল!

২০১৩ আইপিএল ফিক্সিং-কেলেঙ্কারি, তিন বছরের সময়কালে ভারতীয় ক্রিকেটকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল।

আইপিএল আর বিতর্ক চলেছে পাশাপাশিই; Image credit: livemint.com

প্রারম্ভিকা 

এপ্রিল, ২০১৩। দিল্লি পুলিশের লোধি কলোনির বিশেষ শাখা এক গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, ৩রা এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া আইপিএলের ষষ্ঠ আসরের কিছু ম্যাচ পাতানোর কারসাজি চলছে এবং যারা এই ম্যাচ গড়াপেটায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন (বুকি/এজেন্ট/খেলোয়াড়), তাদের অনেকের কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হচ্ছে দিল্লি থেকে। কিছু প্রাথমিক অনুসন্ধান চালিয়ে দিল্লি পুলিশ নিশ্চিত হয়, সংবাদটি উড়ো নয়।

ওই প্রাথমিক অনুসন্ধানেই দিল্লি পুলিশ জানতে পেরেছিল; শ্রীশান্ত, অঙ্কিত চাভান এবং অজিত চান্দিলা (যারা তিনজনই সেবার খেলছিলেন রাজস্থান রয়্যালসের জার্সিতে) – ম্যাচ গড়াপেটা হতে চলেছে এই তিন ক্রিকেটারের হাত ধরে; তাই পুলিশকে নজর রাখতে হবে এই তিন ক্রিকেটারের ওপরই। জোরেশোরে তদন্তকার্য শুরুর পর পুলিশ জেনে যায় কী করে ম্যাচ গড়াপেটা হবে, সে প্রণালীও। জুয়াড়িদের সঙ্গে ক্রিকেটারদের চুক্তি হয়ে যাবে ম্যাচের আগেই, অগ্রীম কিছু টাকাও পেয়ে যাবেন তারা। ম্যাচের মধ্যে পরিকল্পনায় কোনো রদবদল না এলে ফিক্সিংয়ের অংশ হিসেবে ওই ক্রিকেটাররা বুকিদের কিছু না কিছু সংকেত পাঠাবেন, আর সংকেত পেলেই জুয়াড়িরা বাজির দরটা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের পকেট গরম করবেন।

সব তাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালাবার পরে বাকি থাকে একটিমাত্র বিষয়, হাতে-কলমে প্রমাণ। যা তারা পেয়ে যান ৫ থেকে ১৫ মে, এই সময়কালে।

  • প্রমাণ ১

৫ মে, ২০১৩-তে অনুষ্ঠিত রাজস্থান রয়্যালস বনাম পুনে ওয়ারিয়র্সের ম্যাচে অজিত চান্দিলা কাঁধে বুকিরা দায়িত্ব দিয়েছিলেন, নিজের দ্বিতীয় ওভারে ১৪ রান খরচার। চান্দিলা কাজটা পালন করেছিলেন ঠিকঠাক, কিন্তু বাড়তি উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিলেন ওভার শুরুর আগে বুকিদের কাছে সংকেত পাঠাতে। আর সংকেত না পাঠানোয় বুকিরা বাজিও ধরেনি সে ওভারে; ম্যাচশেষে চান্দিলার সঙ্গে তাদের একপ্রস্থ বসচাও হয়ে যায় অগ্রীম প্রদত্ত অর্থকড়ি ফেরত দেয়া নিয়ে।

  • প্রমাণ ২

৯ মে, ২০১৩-তে হওয়া কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব বনাম রাজস্থান রয়্যালসের ম্যাচে গড়াপেটার দায়িত্ব ছিল শ্রীশান্তের হাতে। শ্রীশান্ত সেদিন এমন সংকেত পাঠানোজনিত কোনো ভুল করেননি। বুকিদের সঙ্গে এদিনও তার চুক্তি হয়েছিল দ্বিতীয় ওভারে ১৪ রান দেয়ার, বিনিময়ে পাবেন ৪০ লাখ রুপি। প্রথম ওভারে তার কোমরে রুমাল না থাকলেও দ্বিতীয় ওভারে কোমরে রুমাল গুঁজে বুকিদের জানিয়েছিলেন, কাজটা তিনি করছেন৷ এমনকি জুয়াড়িরা যেন বাজির দরটা বাড়াতে একটু বেশি সময় পান, এজন্যে দ্বিতীয় ওভার শুরুর আগে একটু স্ট্রেচিংমতোও করে নিয়েছিলেন তিনি, অথচ সেটি তার টানা দ্বিতীয় ওভার ছিল। শ্রীশান্ত অবশ্য পুরোপুরি পূরণ করতে পারেননি বাজিকরদের চাহিদা, ওই ওভারে তিনি দিয়েছিলেন ১৩ রান।

  • প্রমাণ ৩

পরের ঘটনাটি ১৫ মে’র, রাজস্থান রয়্যালস বনাম মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স ম্যাচে। এবারে ১৪ রান দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল অঙ্কিত চাভানের ওপরে। এই চাভানের সঙ্গে জুয়াড়িদের পরিচয়টা ঘটেছিল চান্দিলার কল্যাণে। নিজের দ্বিতীয় ওভারে ১৪ রান দিতে পারলে যে তার পকেটে আসবে ৬০ লাখ রুপি, চান্দিলা চাভানকে প্রলুব্ধ করেছিলেন এমন কথাতেই। এমন বিপুল পরিমাণ অর্থের অঙ্কে গলে গিয়ে চাভান নিজের দ্বিতীয় ওভারে দিয়েছিলেন ১৫ রান, যেখানে নিজের প্রথম ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র দুই।

তিনজনের ক্রিকেটারের তিনটি প্রমাণ হাতে আসার পরে দিল্লি পুলিশ শুরু করে তাদের গ্রেফতার অভিযান। ১৬ মে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে ম্যাচের পর দিল্লি পুলিশের একটি দল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আর ট্রাইডেন্টে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেন শ্রীশান্ত, চাভান আর চান্দিলাকে। একই সময়ে স্পেশাল সেলের আরেকদল গ্রেফতার করেন কিছু জুয়াড়িকে, যাদের ভেতরে ছিলেন অমিত সিং বলে গুজরাটের এক সাবেক ক্রিকেটারও।

ম্যাচ-ফিক্সিংয়ের অভিযোগে আটককৃতরা; Image credit: Ravi Kanojia

সবশুদ্ধ সেদিন আটক হন ১৪ জন; তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ৫১টি মোবাইল ফোন, ৫টি ল্যাপটপ, এবং একটি রেকর্ডিং মেশিন। আর কোনো খেলোয়াড় এরপর গ্রেফতার না হলেও আরও বেশ কিছু জুয়াড়ি আটক হয়েছিলেন পরবর্তী কয়েকদিনে, তিনজন ক্রিকেটারসহ সব মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪২-য়ে।

শুধু ক্রিকেটাররাই জড়িত নন… 

এই গ্রেফতার অভিযানের পরবর্তী কয়েকটা দিন স্বভাবতই কেটেছিল চরম উৎকণ্ঠায়। রাজস্থান রয়্যালসের অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় এ ঘটনাকে উল্লেখ করেছিলেন ‘দুঃখজনক’ বলে, ওই তিন ক্রিকেটারের সঙ্গে তদন্ত শেষ না হওয়া অব্দি চুক্তি স্থগিত করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জ আনয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রয়্যালস কর্তৃপক্ষ। ১৬ তারিখে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের রিমান্ড চেয়ে দিল্লি পুলিশ আবেদন আদালত মঞ্জুর করেন পাঁচদিনের রিমান্ড। ওই রিমান্ডে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই দিল্লি পুলিশ ২১ মে গ্রেফতার করে বাবুরাও যাদব নামের আরেক ক্রিকেটারকে

কেলেঙ্কারির মূল তিন কারিগর; Image source: The Daily Star

আইপিএলটা তখনও শেষ হয়নি, বরং প্লে-অফ আর ফাইনালের মতোন ম্যাচগুলোই ছিল বাকি। ‘মাঠের ক্রিকেট ভুলে এখন ক্রিকেট দুর্নীতিই আগে দমন করাটা হবে যথাযথ’, এমন ভাবনায় সুদর্শ অবস্তি বলে এক সমাজ-সংস্কারক ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে এক জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন, আইপিএলের শেষ চার ম্যাচ স্থগিত চেয়ে। অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট তার সে অভিযোগে কর্ণপাত করবার প্রয়োজন মনে করেনি। তবে সতর্কতার অংশ হিসেবে বিসিসিআই কোয়ালিফায়ারের চার দলের জন্যে নিযুক্ত করেছিল চারজন আকসু কর্মকর্তা

এমনি করে সপ্তাহখানেক কাটবার পর যখন চাঞ্চল্য মিলিয়ে গিয়েছিল খানিকটা, তখনই ঘটনা-পরম্পরায় নতুন মোড় এনেছিলেন মুম্বাই পুলিশের কর্তারা। এবার কোপটা গিয়ে পড়েছিল চেন্নাই সুপার কিংসের ঘরে।

মায়াপ্পনের মারপ্যাঁচ 

বাজিকরদের ধরপাকড় শুরু হয়ে গিয়েছিল পুরো দেশজুড়েই। কলকাতা পুলিশ বাজিতে জড়ানোর কারণে আটক করেছিল দশজনকে। ওদিকে মুম্বাই পুলিশ ২১ মে দুবাইগামী একটি বিমান ভারতের জমিন ছাড়বার মিনিটখানেক আগে গ্রেফতার করে প্রেম তার্নেজা বলে এক বুকিকে। সেই তার্নেজাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই বেরিয়ে আসে, ১৬ মে থেকে যখন বুকিদের ধরপাকড় শুরু হয়, তখন ভারতীয় অভিনেতা বীরেন্দর ‘বিন্দু’ দারা সিং দুবাইতে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত জুয়াড়ি চাওদা ভাইদের। ফলত, গ্রেফতার হন এই বিন্দু দারা সিং। এই বিন্দু দারা সিংকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েই বিস্ফারিত হয় সবচেয়ে বড় বোমা, বিন্দুর সঙ্গে জুয়ার যোগাযোগ ছিল গুরুনাথ মায়াপ্পনের। এই মায়াপ্পনের পরিচয়টা হচ্ছে, উনি তৎকালীন বিসিসিআই সভাপতি এবং চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক এন শ্রীনিবাসনের জামাতা।

শুধু মেয়ে-জামাই বলেই নন, তাকে বেশিরভাগ লোকে চিনতেন সিএসকের হর্তাকর্তা হিসেবেই। তার টুইটার অ্যাকাউন্টেও পরিচয় হিসেবে লেখা ছিল সিএসকের ‘টিম প্রিন্সিপাল’। মায়াপ্পনের ছিল গোল্ড ক্যাটাগরির অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড, যা পাওনা ছিল কেবলমাত্র ফ্র‍্যাঞ্চাইজির মালিকসহ নির্দিষ্ট কিছু মানুষের। এমনকি ফ্র‍্যাঞ্চাইজি মালিকদের একাধিক সভাতেও তাকে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল বলে নিশ্চিত করেছিল বিশ্বস্ত কিছু সূত্র। সিএসকের ডাগআউট থেকে নিলামের টেবিল, তার যাওয়া-আসা ছিল সর্বত্র।

মায়াপ্পনের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডেও লেখা ছিল, ‘মালিক’; Image credit: ESPNCricinfo 

২৪ মে গুরুনাথ মায়াপ্পনকে প্রতারণা, জালিয়াতি আর ধাপ্পাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার করে মুম্বাই পুলিশ। ফ্র‍্যাঞ্চাইজির সঙ্গে আইপিএল গভর্নিং বডির চুক্তি অনুযায়ী, মায়াপ্পনের গ্রেফতারের পরে চেন্নাইয়ের বহিষ্কারাদেশ আসবার কথা ছিল তৎক্ষণাৎ; এমনকি ২৬ এপ্রিল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের সঙ্গে ফাইনালে লড়বারও কোনো সুযোগ ছিল না তাদের। কেননা, দু’পক্ষের চুক্তির ১১.৩ এর ‘সি’ ধারায় লেখা ছিল:

“A franchise may be terminated immediately if the Franchisee, any Franchisee Group Company and /or any Owner acts in any way which has a material adverse effect upon the reputation or standing of the League, BCCI-IPL, BCCI, the Franchisee, the Team (or any other team in the League) and/or the game of cricket.”

গুরুনাথ মায়াপ্পন গ্রেফতার; Image credit: Reuters

মায়াপ্পনের গ্রেফতার হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্র‍্যাঞ্চাইজিটি একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়, গুরুনাথ মায়াপ্পন কোনোকালেই তাদের মালিকপক্ষের কেউ ছিলেন না, সুতরাং তাদের বহিষ্কৃত হবার প্রশ্নই আসে না। ২০১৯ সালে নির্মিত ‘রোর অব দ্য লায়ন’ নামক এক ওয়েব সিরিজে সিএসকের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিও বলেছিলেন একই কথা। দলের অন্দরে-বন্দরে মায়াপ্পনের যাওয়া-আসা থাকলেও খেলোয়াড়েরা তাকে মালিক হিসেবে জানতেন না, জানতেন মেয়ে-জামাই হিসেবেই

“Initially when Guru’s name came up, whatever said and done, he was part of the team. In what capacity, that is debatable. Was he the owner? Team Principal? Team Motivator? What exactly was his role? I don’t think anybody from the franchise side introduced Guru to the team as, you know, he’s the owner. We all knew him as the son-in-law.”

আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নিয়েছিল ফ্র‍্যাঞ্চাইজির এ দাবিই। চেন্নাই সেবার ফাইনাল খেলেছিল ঠিকই।

আধঘণ্টার ব্যবধানে পরিচয় বদল; Image credit: ESPNCricinfo 

বিসিসিআই বিশৃঙ্খল 

আইপিএলের ষষ্ঠ আসরের ফাইনাল শেষ হবার দু’দিন বাদে, ২৮ মে’তে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল তিন সদস্যের এক কমিশনকে নিয়োগ দেয়। শ্রীনিবাসনের ভাষ্যমতে, ‘তারাই ঠিক করবেন, মায়াপ্পন সিএসকের মালিকপক্ষের কেউ ছিল না।’ তবে এই তদন্ত কমিশনকে কে বা কারা নিয়োগ দিয়েছিল, তা নিয়েও ছিল রাজ্যের প্রশ্ন। কেননা, ২৬ মে মায়াপ্পন গ্রেফতার হবার পরে শ্রীনিবাসন জানিয়েছিলেন, গঠনতন্ত্র মেনে তদন্ত কমিশন গঠিত হবে বিসিসিআই সচিব সঞ্জয় জাগদালে, বিসিসিআই কোষাধ্যক্ষ অজয় শিরকে, আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল চেয়ারম্যান রাজিব শুক্লা, গভর্নিং কাউন্সিল সদস্য রবি শাস্ত্রী আর অরুণ জেটলিকে নিয়ে। কিন্তু বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে দু’দিন বাদে কমিটি ঘোষিত হয় তামিলনাড়ুর অবসরপ্রাপ্ত দু’জন বিচারপতিকে জায়গা দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই জনমনে প্রশ্ন জাগে, তড়িঘড়ি করে গঠনতন্ত্রের বাইরের গিয়ে দু’জন তামিলনাড়ুর বিচারককে নিয়োগদানের উদ্দেশ্য কি তামিলনাড়ুর ফ্র‍্যাঞ্চাইজিটিকে রক্ষা করা?

এই অনিয়মের কমিশনে থাকাকে নৈতিকভাবে যৌক্তিক মনে না করায় কমিশনের মেয়াদ তিনদিন পেরোবার আগেই ওই কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং বিসিসিআইর তৎকালীন সচিব সঞ্জয় জাগদালে পদত্যাগ করেন দায়িত্ব তথা বিসিসিআই থেকে। ‘কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নয়, বরং একজন সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে যা হচ্ছে, তা মেনে নিতে পারছি না বলেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি’, বলে জানিয়েছিলেন তিনি। সঞ্জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগ করেন কোষাধ্যক্ষ অজয় শিরকে, যিনি নিজেও জায়গা পেয়েছিলেন রাজস্থান রয়্যালসের ম্যাচ গড়াপেটার তদন্ত কমিশনে। পদত্যাগের মিছিল শেষ নয় এখানেই। জুনের পয়লা দিনে আইপিএল চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান রাজীব শুক্লা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল যাকে নিয়ে, সেই নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন পদত্যাগ করেন জুনের ২ তারিখে। নানামুখী চাপের মুখে তদন্ত কমিশনের কাজ শেষ না হওয়া অব্দি বিসিসিআইর দায়ভার জগমোহন ডালমিয়ার হাতে তুলে দিয়ে সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

জগমোহন ডালমিয়া, আরও একবার ক্রান্তিলগ্নে দায়িত্ব কাঁধে; Image credit: AFP 

বিসিসিআইতে শ্রীনিবাসনের জায়গা নেবার পরে সংবাদ সম্মেলনে ডালমিয়া জানিয়েছিলেন, তার কাজই হবে, বিসিসিআই থেকে সমস্ত জঞ্জাল সরানো। গালভরা একটা নামও দিয়েছিলেন বিসিসিআইর ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার এই পদক্ষেপের, ‘অপারেশন ক্লিন-আপ।’

তবে এই অপারেশন চালাবার আগে গঙ্গা-যমুনায় জল গড়িয়েছিল অনেক। চেন্নাই সুপার কিংসের পরে রাজস্থান রয়্যালসের মালিকপক্ষও জড়িয়ে গিয়েছিল বাজির মচ্ছবে।    

রাজ কুন্দ্র গ্রেফতার 

৩১ মে’তে দিল্লির সাকেট জেলা কোর্টে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারা মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এজাহার দেন রাজস্থান রয়্যালসের পেসার সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী। পুলিশ জানায়, ম্যাচ গড়াপেটায় ত্রিবেদীর কোনো অংশ ছিল না। তাকে বরং পূর্বেই আটককৃত তিন ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানের জন্যে ডাকা হয়েছিল, কেননা তিনি ছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী, এবং তাকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দেয়া হলেও তিনি সবসময়ই ‘না’ করে এসেছিলেন।

শ্রীশান্ত, চাভান কিংবা চান্দিলার বিরুদ্ধে ত্রিবেদী কি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তা প্রকাশ পাবার আগেই দিল্লি পুলিশ ডেকে পাঠায় উমেশ গোয়েঙ্কাকে। অভিযোগ, ত্রিবেদী তার এজাহারে বলেছেন, গোয়েঙ্কা নাকি ম্যাচের আগে দল নির্বাচনের তথ্য জানতে চাইতেন তার কাছে।

এই তথ্য পেয়ে দিল্লি পুলিশ তলব করে উমেশ গোয়েঙ্কাকে। উমেশ গোয়েঙ্কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসে রাজ কুন্দ্রর নাম। এই দু’জনে ছিলেন রাজস্থান রয়্যালস ফ্র‍্যাঞ্চাইজির ১১.৭ শতাংশের মালিক এবং তাদের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের অভিযোগ ছিল, আইপিএল ম্যাচ নিয়ে নিয়মিতই বাজি ধরেছিলেন তারা দু’জন, এমনকি তার মধ্যে ছিল রাজস্থান রয়্যালসের ম্যাচও।

তাদের দু’জনকে প্রায় বারো ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে ৬ জুন দিল্লি পুলিশের কমিশনার নীরাজ কুমার জানান, বাজি লাগানোর অভিযোগটা মিথ্যে ছিল না। রাজ কুন্দ্র নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন অভিযোগের সত্যতা।

রাজ কুন্দ্র আর শিল্পা শেঠী; Image credit: IANS

ওদিকে মায়াপ্পন আর বিন্দু দারা সিংকে নিয়ে চলছিল জেল-বেলের খেলা। গ্রেফতার হবার পর থেকে তারা ছিলেন পুলিশি হেফাজতে। ৩রা জুন জানানো হয়, তারা সেখানেই থাকবেন জুনের ১৪ তারিখ অব্দি। কিন্তু এরপরের দিনই মুম্বাই কোর্ট ২৫,০০০ রুপি এবং ভারত না ত্যাগের শর্তে জামিন মঞ্জুর করেন তাদের। এর আগে জুনের ১১ তারিখে জামিনে মুক্তি মিলেছিল শ্রীশান্ত আর চাভানেরও। তবে তাদের সতীর্থ চান্দিলা জামিনপ্রাপ্তির আপিলই করেননি, এবং আদালত তাকে পুলিশি হেফাজতে রাখবার নির্দেশ দেন জুলাইর ২ তারিখ পর্যন্ত।

তদন্ত কমিশন: বৈধ/অবৈধ? 

যে দু’টো তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল মে’র ২৮ তারিখে, তারা ২৮ জুলাই তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের কাছে। এবং, যা অনুমিত ছিল, দুই বিচারক মিলে ঠিক তাই তাই লিখেছিলেন তাদের প্রতিবেদনে। তাদের মতে, রাজস্থান রয়্যালসের মালিক রাজ কুন্দ্র এবং চেন্নাই সুপার কিংসের স্বত্ত্বাধিকারী ইন্ডিয়া সিমেন্টস কোনো অন্যায়ের ধার দিয়েই হাঁটেনি।

কিন্তু, তামিলনাড়ুর দু’জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমন লিখেছেন বলেই তা মেনে নিতে হবে নাকি? ভারতীয় ক্রিকেটের এই ভাবমূর্তি সংকটের মুহূর্তে নৈতিকতার ঝাণ্ডা উড়িয়ে বিসিসিআই’র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বিহারের (সিএবি) কর্তারা। বিসিসিআইকে নিয়ে গিয়ে তারা দাঁড় করিয়েছিলেন আদালতে এবং তাদের দায়ের করা পাবলিক ইন্টারেস্ট পিটিশনের জবাবে বোম্বে হাইকোর্ট জুনের ৩০ তারিখে জানিয়ে দেয়, যে তদন্ত কমিশন এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সে-ই তদন্ত কমিশনই অবৈধ

বিসিসিআইকে আদালতে দাঁড় করানো সিএবি সচিব আদিত্য ভার্মা; Image credit: Zee News

এই তদন্ত কমিশন যে বিসিসিআইর গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল, তা তো জানিয়ে দেয়া হয়েছে আগেই। বিসিসিআই নিজেও যে এই তদন্ত কমিশনকে অবৈধ মানে, তা বোঝা গিয়েছিল পয়লা আগস্ট বোর্ডের ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিরঞ্জন শাহ’র দেয়া বিবৃতিতে। যদিও বলেছিলেন ব্যক্তিগত মতামত, তবে গোপনে জিজ্ঞাসা করলে বিসিসিআইর সব সদস্য বোধহয় একই কথাই বলতেন:

“It is my personal opinion that following the Bombay High Court order, it is in the best interest of the board to appoint a fresh probe panel.”

কিন্তু সে মুহূর্তে নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসনের এসব বৈধ-অবৈধ আদেশ মানতে বয়েই গেছে। ‘তদন্ত কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করে ফেলেছে, এখন আর আমার বিসিসিআইর সভাপতির আসন অলংকৃত করতে আর কোনো বাধা নেই’, এই মর্মে শ্রীনিবাসন ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডেকে কাজে ফিরতে চেয়েছিলেন আগস্টের ২ তারিখে। কিন্ত বোর্ড সদস্যদেরই কয়েকজনের বিরোধিতার মুখে ওই সভা হয়েছিল সাঙ্গ, শ্রীনিবাসনও ছিলেন বিসিসিআইর বাইরে।

শ্রীশান্ত, চাভান এবং অমিত সিং আজীবন নিষিদ্ধ 

ফ্র‍্যাঞ্চাইজিগুলো ফিক্সিংয়ে জড়িত কি না, তা নির্ণয়ে গঠিত তদন্ত কমিশন নিয়ে একদিকে বিসিসিআইকে পোহাতে হচ্ছিল ভীষণ হ্যাপা; অন্যদিকে যাদের ঘিরে এই ফিক্সিং কেলেঙ্কারির শুরু, সেই অভিযুক্ত ক্রিকেটারদের বিচার করতেও বিসিসিআই তখন নিয়োগ দিয়েছিল আকসু সদস্য রবি সাওয়ানিকে। দিল্লি পুলিশের প্রদান করা প্রমাণাদি এবং অভিযুক্ত ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, শ্রীশান্ত, অঙ্কিত চাভান, অজিত চান্দিলা এবং অমিত সিং ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে। আকসুর ম্যাচ-পাতানো বিরোধী প্রোগ্রামগুলোতে সক্রিয় অংশগ্রহণ সত্ত্বেও তারা যখন খেলাটির বিশ্বাসযোগ্যতা সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তাই তাদের আজীবন নিষিদ্ধ করাটাই যৌক্তিক বলে মত দেন তিনি।

সাওয়ানির কাছ থেকে এমন রিপোর্ট পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিসিসিআই আজীবন নিষেধাজ্ঞা জারি করে শ্রীশান্ত আর চাভানের ওপরে, চান্দিলা তখনও পুলিশি হেফাজতে ছিলেন বিধায় তার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও জানান এক বিসিসিআই কর্মকর্তা। অবশ্য, সেই পরবর্তী যে কবে আসবে, তা ঠিক নিশ্চিত নয়। চান্দিলার পরবর্তী এখনো আসেনি।    

এদিকে দিল্লি পুলিশের কাছে প্রত্যক্ষদর্শীরূপে সাক্ষ্য দেয়া সিদ্ধার্থ ত্রিবেদীকেও দেড় বছরের জন্যে নিষিদ্ধ করতে বলেন তিনি। কেননা, দুর্নীতি-প্রতিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কোনো ক্রিকেটারের কাছে ম্যাচ-পাতাবার প্রস্তাব এলে কিংবা সতীর্থদের কাছে কোনো বাজিকর প্রস্তাব নিয়ে এসেছে এমন জানলে সঙ্গে সঙ্গে ঐ ক্রিকেটারের তা জানাবার কথা আকসুকে। সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী তা জানাননি তৎক্ষণাৎ, এবং একই অভিযোগে ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার হারমিত সিংয়ের জন্যেও শাস্তির সুপারিশ হয় অনুরূপ।

শাস্তির সারসংক্ষেপ; Image credit: Rezwan Rahman Sadid  

তবে এরা তো চুনোপুঁটি; বিসিসিআইর ফিক্সিং-কেলেঙ্কারির রাঘব বোয়ালদের শাস্তি বিধান করাটা তখনও যে বহুদূরের পথ, এবং এই শাস্তি বিধানের পুরো প্রক্রিয়ার তদারকিতে ছিলেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। যে রাঘববোয়ালদের নিয়ে বিসিসিআই’র দুশ্চিন্তা ছিল, তাদের ভেতরে কোনো ক্রিকেটারও আছেন কি না, তা নিয়েও তো তখন মাঘ কুয়াশার আচ্ছন্নতা।

This article is in Bangla language. This article is on 2013 ipl fixing-scandal. Necessary hyperlinks and images are attached inside.

Featured images ©Amit Dave/Reuters.           

Related Articles

Exit mobile version