২০১৪ সালের পর থেকে যেন ক্লাবটি যেন ইউরোপীয় ফুটবলের মহারণ থেকে নিজেদের হারিয়ে ফেলার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে সফল ক্লাবগুলোর মধ্যে একটি হওয়ার গৌরব যাদের গায়ে লেগে আছে, তারা যেন হুট করে হারিয়ে গিয়েছিল পাদপ্রদীপের আলো থেকে। ইতালিয়ান ফুটবলের সৌরভ ছড়ানো ক্লাবটি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে যেন বিশ্ব ফুটবলে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছিল নিজেদের কারণেই। ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় সাফল্য তো দূরে থাক, অংশগ্রহণ করা যোগ্যতাই আর অর্জন করা হয়ে উঠছিল না তাদের পক্ষে। শত কোলাহল, ব্যস্ততার মাঝে ডুবে থাকা কোন সভ্যতা যেন হুট করে যেন মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল।
এসি মিলান এই মৌসুমের আগেও ছিল একটি আক্ষেপের নাম। প্রতি মৌসুম শুরু হয়, এসি মিলানের ভক্তরা আবারও আশায় বুক বাঁধেন, এবার বুঝি ইতালির জাতীয় লিগে ভালো করার পর আবার চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে যাচ্ছে তাদের প্রাণের ক্লাব! কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। “যে ক্লাবের ট্রফি ক্যাবিনেটে সাতটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফির রেপ্লিকা সাজানো আছে, তার সংখ্যা কি আর বৃদ্ধি পাবে না? তুরিনের বুড়িদের একাধিপত্য গুড়িয়ে দিয়ে ইতালিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে আবার কি ক্লাবটি নিজের সগর্ব উপস্থিতি জানান দিতে পারবে না?” – এসব প্রশ্ন উঁকি দেয় সমর্থকদের মনে। কিন্তু শীর্ষ চারে আর ওঠা হয় না মিলানের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির, অপেক্ষার প্রহর আরও বাড়তে থাকে। যে ক্লাব একসময় ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় ‘বাজির ঘোড়া’ হয়ে অংশগ্রহণ করতো, তাদের সমর্থকদেরই কি না এখন ‘অন্তত যেন চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে পারে’ – এ ধরনের প্রার্থনায় বসতে হয়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ একবার বলেছিলেন, “টাকাভর্তি ব্যাগকে কখনও মাঠে গোল দিতে দেখিনি।” শুধু টাকা দিয়ে ফুটবলে সাফল্য পাওয়া যায় না – এ কথাটাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন বার্সেলোনাকে ইউরোপের অভিজাত ক্লাবগুলোর কাতারে নিয়ে যাওয়া এই মহান ব্যক্তিত্ব। তার এই কথার পর অনেকগুলো বছর পার হয়ে গিয়েছে, বিশ্ব ফুটবলে অনেক ঘটনা ঘটে গিয়েছে, কিন্তু কথাটির আবেদন ফুরিয়ে যায়নি একটুও। মিলানের ক্ষেত্রেও কথাটির বাস্তব প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়।
ক্লাবটির মালিকানা বদল হয়। ইতালির তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, মিডিয়ামোঘল সিলভিও বার্লুসকোনির হাত থেকে ক্লাবটির দায়িত্ব চলে আসে একজন চীনা বিলিয়নিয়ারের হাতে। এসি মিলানকে আগের পর্যায়ে নিতে সব ধরনের বিনিয়োগ করা শুরু হলো; কিন্তু ফলাফল শূন্য। ক্লাবের ডাগ-আউটে নতুন নতুন মুখ দেখা যায়, স্পোর্টিং ডিরেক্টরের চেয়ারে রদবদল ঘটে নিয়মিত, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের আর মুখ দেখা যায় না। এরই মধ্যে আবার মালিকানা নিয়ে আরও ঝামেলা তৈরি হয়। ইউরোপীয় ফুটবলের দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা উয়েফার বেঁধে দেয়া নিয়ম ভাঙার দায়ে ইউরোপা লিগে অংশগ্রহণ করার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় ক্লাবটিকে। সব মিলিয়ে ঝামেলা শুধু বাড়তে থাকে ক্লাবটির। ভক্তদের কপালে কুঁচকানো চিন্তার ভাঁজও আরও বাড়তে থাকে। ইতালিয়ান ফুটবলে রসোনেরিদের পুনরুত্থানের পথ আরও সংকুচিত হতে থাকে।
চীনা বিলিয়নিয়ারের ঋণ শোধ করতে না পারার সুবাদে (!) ক্লাবটির মালিকানা চলে আসে মার্কিন এলিয়ট কর্পোরেশনের হাতে। এলিয়ট কর্পোরেশন ক্লাবটির জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নেয়। ক্লাবটির সাবেক তারকা খেলোয়াড় ও ফুটবলের সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারদের অন্যতম পাওলি মালদিনি বোধহয় তার ক্লাবের দুরবস্থা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি এলিয়ট কর্পোরেশনের অনুরোধে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্লাবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আর্সেনাল থেকে ইভান গাজিনিসকে নিয়ে আসা হয়। ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট ঠিক না থাকলে লম্বা রেসে যে ক্লাবকে টিকিয়ে রাখা যায় না, সফল হওয়া যায় না, সে শিক্ষাটুকু এলিয়ট কর্পোরেশন ঠিকই গ্রহণ করেছিল। এজন্য মালিকানা লাভের পর তারা প্রথমেই ম্যানেজমেন্টের ভেতরেই ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে, যেটিকে এখন পর্যন্ত তাদের সেরা পদক্ষেপ হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়।
এসি মিলান কিংবদন্তি পাওলো মালদিনি টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হওয়ার পর খেলোয়াড় ট্রান্সফার, চুক্তি নবায়ন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো তার হাতে এসে পড়ে। সাম্প্রতিক খেলোয়াড় ট্রান্সফারের ইতিহাস দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন, কীভাবে এসি মিলান অল্প ট্রান্সফার ফি-তেই ক্লাবের সংস্কৃতি ও কোচের পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ খেলোয়াড় এনেছে। সোয়ালিহো মেইতে, জেন পিটার হজ, আন্তে রেবিচ, সান্দ্রো তোনালির মতো তরুণ কিন্তু প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা অল্প ট্রান্সফার ফি-তে ক্লাবে এসেছেন, নিয়মিত দলের সাথে ভালো পারফর্ম করছেন। রাফায়েল লিয়াও, হাকান চালহানোগলু, ফ্রাংক কেসি, থিও হার্নান্দেজরা আগে থেকেই ছিলেন, কিন্তু ঠিকমতো পারফর্ম করতে পারছিলেন না। নতুন কোচ স্টেফানো পিওলির পরিকল্পনায় তারাও ফর্মে ফিরেছেন। রিয়াল মাদ্রিদের কাছ থেকে লোনে নেওয়া ব্রাহিম দিয়াজ কিংবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছ থেকে লোনে নেওয়া দিয়েগো দালোতরা স্কোয়াডের গভীরতা আরও বাড়িয়েছেন, দলের প্রয়োজনের সময় নিজেদের সেরাটা দিচ্ছেন।
ভালো খেলোয়াড় সাইন করাতে স্কাউটদের ভূমিকা যে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ, তা আর নতুন করে কিছু বলার নেই। পাওলো মালদিনি এসি মিলানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হওয়ার পর মিলানের স্কাউটিং বিভাগে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে যেন। এলিয়ট কর্পোরেশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্লাবের স্কাউটিংয়ের ক্ষেত্রে দুটো আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়েছে। ‘ডাটা এরিয়া’ (Data Area) বিভাগে শুধু সম্ভাব্য খেলোয়াড়দের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো খেলোয়াড়ের পরিসংখ্যান ভালো থাকলে ‘ডাটা এরিয়া’ বিভাগ থেকে সে খেলোয়াড় সম্পর্কে স্কাউটিং এরিয়া’-তে রিপোর্ট পাঠানো হয়। এরপর স্কাউটিং এরিয়ার অভিজ্ঞ স্কাউটরা সে খেলোয়াড়কে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করতে বের হন। পর্যবেক্ষণের পর যদি খেলোয়াড়কে মিলানের জন্য উপযুক্ত মনে হয়, তাহলে তার সম্পর্কে স্পোর্টিং ডিরেক্টর ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে জানানো হয় এবং তারা সবুজ সংকেত দিলে পরবর্তীতে ক্লাব তাকে সাইন করানোর চেষ্টা করে।
এসি মিলানে পাওলো মালদিনির ভূমিকা নিয়ে ক্লাবটির স্কাউটিং বিভাগের প্রধান জিওফ্রে মোনকাডা কথা বলেছিলেন একটি পডকাস্টে। মালদিনি ট্রান্সফার হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনেই ক্ষান্ত হন না, নবাগত খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলেন তাদের কী করতে হবে, এসি মিলানের ঐতিহ্য, তাদের প্রতিভা যেভাবে পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত হতে পারে এসব নিয়েও। নবাগত খেলোয়াড়েরা ক্লাবে পা রাখার সাথে সাথে এরকম একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের সাথে সরাসরি কথা বলার মাধ্যমে শুরুতেই জেনে যায় তাদের কর্তব্য।
তবে এসি মিলানের পুনরোত্থানের পেছনে একজনের কথা আলাদা করে বলতে হয়। শুধু ভালো, প্রতিভাবান খেলোয়াড় স্কোয়াডে থাকলেই হয় না, তাদের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে হয়। এসি মিলানের বর্তমান কোচ স্টেফানো পিওলি গত মৌসুমে ধ্বংসস্তূপ থেকে দলটিকে টেনে উঠিয়েছেন, আর এ মৌসুমে এসি মিলান পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে তার অধীনে। ইতালিয়ান ফুটবলের চিরাচরিত রক্ষণাত্মক কৌশলের বিপরীতে হাই-প্রেসিং অ্যাটাকিং ফুটবল খেলিয়ে এসি মিলানকে আবার ইউরোপীয় মঞ্চের জন্য প্রস্তুত করছেন এই ইতালিয়ান কোচ।
তবে শুরুটা ভালো হয়নি। আরেক মাস্টারমাইন্ড গ্যাস্পেরিনির আটালান্টার কাছে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর সমর্থক থেকে শুরু করে সাবেক খেলোয়াড়, সবাই তার সমালোচনায় মুখর হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এসি মিলানকে নিয়ে একের পর এক ম্যাচ জিতে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছেন, নতুন দিনের বার্তা দিয়েছেন সবাইকে।
তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন এসি মিলান পয়েন্ট টেবিলের ১৩তম অবস্থানে অবনমনের আশঙ্কায় ছিল। পিওলির অধীনে রসোনেরিরা ষষ্ঠ হয়ে মৌসুম শেষ করে, ইউরোপা লিগে অংশগ্রহণ করা নিশ্চিত করে। মূলত আটালান্টার সাথে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর থেকেই এসি মিলানের পুনরোত্থান শুরু হয়।
এসি মিলান আবারও ইউরোপ কাঁপাতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু একেবারে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে শক্ত হাতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ফ্রাংক কেসি-চালহানোলু-ইব্রাহিমোভিচরা, এটি ভেবে সমর্থকেরা আশাবাদী হতেই পারেন। এই মৌসুমের অর্ধেক ইতঃমধ্যে পার হয়ে গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত সিরি আ’র পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তারা। এই মৌসুমে যেভাবে খেলছে পিওলির শিষ্যরা, তাতে করে এসি মিলান স্কুদেত্তো জিতলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অভিজ্ঞ স্টেফানো পিওলির কোচিং, গাজিনিস-মালদিনিদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ইব্রাহিমোভিচ-চালহানোলু-লিয়াওদের আগুনঝরানো পারফরম্যান্সের সুবাদে এসি মিলান আরেকবার বিশ্বমঞ্চে নিজেদের জানান দিতেই পারে।