এশিয়ার দেশ চীনে ফুটবল খেলাটা আবিষ্কৃত হলেও আধুনিক ফুটবলে শুরু থেকেই ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকানদের দাপট চলে আসছে। সেই দাপটে ভাগ বসানো তো বহুদূর, বিশ্বফুটবলে এশিয়ানদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই বহুদিন লেগে গেছে। তবে শুরুর দিকের বিশ্বকাপে এশিয়ানরা যেমন অবহেলিত ছিল, এখন আর তেমনটি নেই। এখন প্রতি বিশ্বকাপেই এশিয়া থেকে কমপক্ষে চারটি দেশ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। তবে এশিয়ার দেশগুলো এই সুযোগের ঠিকঠাক সদ্ব্যবহার করতে পারছে না, করতে পারলে হয়তো এতদিনে এশিয়া থেকে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা আরো বাড়তো। তবে বহু ব্যর্থতার মাঝেও বেশ কিছুবারই সাফল্যের সূর্যকিরণে আলোকিত হয়েছে এশিয়ার দেশগুলো। আজ আমরা এখন পর্যন্ত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপে এশিয়ার দেশগুলোর পারফর্মেন্স সম্পর্কে জানবো, চেষ্টা করবো এশিয়ার দেশগুলোর এমন পারফর্মেন্সের কারণ ব্যাখা করতে।
বৃহত্তম মহাদেশের কোনো দল ছাড়াই প্রথম দুটি বিশ্বকাপ!
আয়তন কিংবা জনসংখ্যা– দু’দিক থেকেই পৃথিবীর বৃহত্তম মহাদেশ হচ্ছে এশিয়ার মহাদেশ। অথচ প্রথম দুই বিশ্বকাপে এশিয়া মহাদেশের কোনো দলই অংশ নিতে পারেনি! প্রথন বিশ্বকাপটি ছিল ইতিহাসের একমাত্র বাছাইপর্বহীন বিশ্বকাপ, সেবার চাইলেই ফিফার পূর্ণ সদস্য হয়েছে এমন কোনো এশিয়ার দল বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারতো। কিন্তু সেই আসরের স্বাগতিক দল উরুগুয়েতে জাহাজে করে যাওয়াটা এশিয়ার দলগুলোর জন্য বেশ দুরূহ ছিল, তাই সেবার আর এশিয়ার কোনো দল অংশ নেয়নি। ১৯৩৪ বিশ্বকাপে খেলার জন্য এশিয়ার হয়ে বাছাইপর্বে অংশ নেয় সেসময়ে ব্রিটেনের অধীনে থাকা ফিলিস্তিন। বাছাইপর্বে সেবার মিশরের সাথে পেরে না উঠায় বিশ্বকাপের মূলপর্বে আর খেলা হয়নি ফিলিস্তিনের, তবে এশিয়ার প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশ নিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় ফিলিস্তিনের সেই দলটি। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা বিতর্ক আছে, ব্রিটিশদের মতে সেসময়ের ফিলিস্তিন দলে যারা ছিলেন, তারা সবাই ইহুদী কিংবা ব্রিটেনের অধিবাসী ছিলেন। সেই হিসেবে ঐ দলটিকে বর্তমান ইসরাইলের পূর্বসূরীই বলতে হয়।
অবশেষে বিশ্বকাপে এশিয়ার কোনো দল
অবশেষে ১৯৩৮ বিশ্বকাপে এশিয়ার একটি দেশ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। বাছাইপর্বে তৎকালীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ ও জাপান এক গ্রুপে পড়লেও জাপান নিজেদের নাম প্রত্যাহার করলে প্রথম এশিয়ান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। তবে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে মোটেও সুবিধা করতে পারেনি ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ, হাঙ্গেরির কাছে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয় দলটিকে। পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখা দরকার, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ হচ্ছে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার পূর্বনাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে দীর্ঘ ১২ বছর বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। অবশেষে ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর। সেই আসরে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন ও বার্মা বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিলে প্রথমবারের মতন বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় ভারত। কিন্তু অলিম্পিকে বেশি মনোযোগ দিতে চাওয়া এবং খালি পায়ে ফুটবল খেলার ব্যাপারে ফিফা আপত্তি জানানোয় শেষপর্যন্ত সেবার ভারতের আর বিশ্বকাপে খেলা হয়নি। ফলে এশিয়ার কোনো দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ বিশ্বকাপ।
১৯৫৪ বিশ্বকাপে একমাত্র এশিয়ান দেশ হিসেবে সুযোগ পায় দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু হাঙ্গেরি ও তুরস্কের কাছে সর্বমোট ১৬ গোল হজম করায় নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য মোটেও সুখকর কিছু ছিল না। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে তাও এশিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে একটি দেশ বিশ্বকাপের মূলপর্বে গিয়েছিলো, কিন্তু ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপে এশিয়ার কোনো দেশ বাছাইপর্বের বাধাই টপকাতে পারেনি।
অবশেষে জ্বলে উঠলো এশিয়ার কোনো দেশ
উত্তর কোরিয়া ১৯৬৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পার হলে দুই আসর পর আবারো বিশ্বকাপে এশিয়ার কোনো দেশকে দেখা যায়। তবে সেবার শুধুমাত্র অংশগ্রহণে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি উত্তর কোরিয়া, নজরকাড়া পারফর্মেন্স দিয়ে চমকে দিয়েছিলো পুরো বিশ্বকে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে গোলশূন্য ড্র করে প্রথম এশিয়ান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে পয়েন্ট পায় উত্তর কোরিয়া। পরের ম্যাচে চিলির বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে উত্তর কোরিয়া। তবে সমাজতান্ত্রিক এই দেশটি বড় চমক দেখায় গ্রুপপর্বের শেষম্যাচে, পাক ডু-ইকের একমাত্র গোলে পরাশক্তি ইতালিকে ১-০ গোলে হারিয়ে প্রথম এশিয়ান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে জয়ের দেখা পায় উত্তর কোরিয়া। শুধু তা-ই নয়, এই জয়ের ফলে গ্রুপ রানার্স আপ হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালেও পৌঁছে যায় উত্তর কোরিয়া।
কোয়ার্টার ফাইনালে ইউসেবিওর পর্তুগালকে রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছিলো উত্তর কোরিয়া। পাক সিউং-জিন, লি ডং-ইন ও ইয়াং সিউং-কুকের গোলে মাত্র ২৫ মিনিটের মাঝেই ৩-০ তে এগিয়ে গিয়েছিলো উত্তর কোরিয়া। কিন্তু কালোচিতা ইউসেবিও একাই চার গোল করলে সেমিফাইনালে খেলার আশা আর পূরণ হয়নি উত্তর কোরিয়ার। ৫-৩ গোলে ম্যাচটি হেরে গিয়ে থেমে যায় উত্তর কোরিয়ানদের স্বপ্নযাত্রা। কিন্তু সেদিনের হার সত্ত্বেও জয়ীর বেশেই দেশে ফিরেছিলো উত্তর কোরিয়া, প্রথম এশিয়ান দেশ হিসেবে বহু রেকর্ড গড়ার গৌরবটা তো ঠুনকো কিছু নয়।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এমন অসাধারণ পারফর্মেন্স সত্ত্বেও ১৯৭০ বিশ্বকাপ খেলা হয়নি উত্তর কোরিয়ার। কারণ সেবার বাছাইপর্বে ইসরাইলের মাঠে খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো উত্তর কোরিয়া। এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে সেবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলো ইসরাইল। সেবার উরুগুয়ের কাছে প্রথম ম্যাচ হারলেও সুইডেন ও ইতালির সাথে ড্র করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলো ইসরাইল। তবে এই দুই ড্র সত্ত্বেও ইসরাইলকে বিদায় নিতে হয় গ্রুপপর্ব থেকেই। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আবারো ব্যর্থ এশিয়ার দেশগুলো ফলে এশিয়ান দেশছাড়া বিশ্বকাপের সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ছয়ে। সেটিই ছিল শেষ বিশ্বকাপ, যেখানে এশিয়ার কোনো দেশ মূলপর্বে অংশ নিতে পারেনি।
১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বকাপে যায় ইরান। তবে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলের ড্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ইরানকে, বাকি দুই ম্যাচ হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ে তারা। ১৯৮২ বিশ্বকাপে মোট দলের সংখ্যা ১৬ থেকে ২৪ এ উন্নীত হলেও এশিয়ার প্রতিনিধির সংখ্যা সেই ১ এই রয়ে যায়। সেবার প্রথমবারের মতন বিশ্বকাপ খেলতে যায় কুয়েত। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচে চেকস্লোভাকিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে বেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো কুয়েত। কিন্তু বাকি দুই ম্যাচে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় কুয়েতকে।
অবশেষে বিশ্বকাপে একাধিক এশিয়ার প্রতিনিধি
৫৬ বছর অপেক্ষার পর অবশেষে বিশ্বকাপে একাধিক এশিয়ার প্রতিনিধি সুযোগ পায়। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে সুযোগ পায় এশিয়ার দুই দেশ দক্ষিণ কোরিয়া আর ইরাক। কিন্তু দু দলের পারফর্মেন্সই ছিল হতাশাজনক। দক্ষিণ কোরিয়া তাও বুলগেরিয়ার সাথে ম্যাচটা ড্র করেছিলো, কিন্তু নিজেদের অভিষেক বিশ্বকাপে ইরাক গ্রুপপর্বের সবগুলো ম্যাচেই হেরে বিদায় নেয় গ্রুপপর্ব থেকেই। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও এশিয়ার প্রতিনিধি ছিল দুটি, এবার দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গী হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। ব্যর্থতার ধারা এবারো অব্যাহত থাকে, দুই দলই সবগুলো ম্যাচে হেরে বিদায় নেয় গ্রুপপর্ব থেকেই।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করে প্রথম এশিয়ান দেশ হিসেবে টানা তিন বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার রেকর্ড গড়ে দক্ষিণ কোরিয়া, এবার তাদের সঙ্গী হয় সৌদি আরব। এই আসরে অবশ্য এশিয়ার দলগুলোর পারফর্মেন্সে কিছুটা উন্নতির দেখা মিলে। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী স্পেনকে সাথে ২-২ গোলে রুখে দেয় দক্ষিণ কোরিয়া। দ্বিতীয় ম্যাচে বলিভিয়ার সাথে গোলশূন্য ড্র করে দক্ষিণ কোরিয়া। শেষ ম্যাচেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে কোরিয়ানরা কিন্তু জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয় দক্ষিণ কোরিয়াকে।
তবে এশিয়ার আরেক প্রতিনিধি সৌদি আরব কিন্তু সেবার অবাক করে দেয় সবাইকে। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের কাছে ২-১ গোলে হেরে গেলেও পরের ম্যাচে মরক্কোকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় সৌদিরা! উত্তর কোরিয়ার পর দ্বিতীয় এশিয়ান দল হিসেবে বিশ্বকাপে জয়ের দেখা পায় সৌদি আরব। তবে শুধুমাত্র একটা জয়ে সন্তুষ্ট থাকেনি সৌদি আরব, গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে বেলজিয়ামকে ১-০ গোলে হারিয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত করে তারা। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে অবশ্য সুইডেনের কাছে হেরে বিদায় নেয় সৌদি আরব, তবে ২৮ বছর পর আবারো এশিয়ান প্রতিনিধি হিসেবে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করায় আলাদা করে একটা অভিনন্দন সৌদি আরব পেতেই পারে।
এক বিশ্বকাপে এশিয়ার চারটি প্রতিনিধি!
১৯৯৮ বিশ্বকাপ থেকে ফিফা অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ২৪ থেকে ৩২ এ উন্নীত করায় বিশ্বকাপে এশিয়ার প্রতিনিধির সংখ্যাটাও ২ থেকে বেড়ে ৪ এ উন্নীত হয়। সেবার দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, ইরানের সাথে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে আসে জাপান। কিন্তু সেবার এশিয়ার কোনো দলই তেমন সুবিধা করতে পারেনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব তিন দলই সেই আসরে কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি, নিজেদের গ্রুপে শেষ দল হয়েই তারা সে বিশ্বকাপ শেষ করেছিলো। তবে ব্যতিক্রম ছিল ইরান, হাড্ডাহাড্ডি এক লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ২-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম জয়টি তুলে নেয় ইরান। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে এই জয়টা ইরানের কাছে বিশেষ কিছুই ছিল।
অবশেষে এশিয়ার মাটিতে বিশ্বকাপের আসর!
সেই শুরু থেকেই ঘুরেফিরে ইউরোপ ও দুই আমেরিকাতেই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছিলো, সেই ধারা ভাঙ্গে ২০০২ আসরে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান যৌথভাবে বিশ্বকাপের আয়োজক হয়। এশিয়ার মাটিতে বিশ্বকাপ তাই স্বাভাবিকভাবেই এশিয়ার দলগুলোর ব্যাপারে সেবার প্রত্যাশার পারদটাও বেশ উঁচুতে ছিল। আগের আসরের মতো এই আসরেও এশিয়া থেকে চারটি দেশ বিশ্বকাপে সুযোগ পায়। স্বাগতিক দু দলের সাথে যোগ দেয় সৌদি আরব ও চীন। তবে সৌদি আরব আর চীন দু দলই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। গ্রুপপর্বের সব ম্যাচ হারার সাথে জার্মানির সাথে ৮-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় হারের লজ্জাজনক রেকর্ড গড়ে সৌদি আরব। অন্যদিকে নিজেদের অভিষেক বিশ্বকাপে চীনের পারফর্মেন্সও ছিল হতাশাজনক, গ্রুপপর্বের সবগুলো ম্যাচে হেরে বিদায় নেয় চীনারা।
এশিয়ার মাটিতে এশিয়ার দু দল হতাশ করলেও হতাশ করেনি দুই স্বাগতিক দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। নিজেদের প্রথম ম্যাচে বেলজিয়ামের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে জাপান। তবে পরের দুই ম্যাচে রাশিয়া ও তিউনিসিয়াকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই রাউন্ড অফ সিক্সটিনে যায় জাপানিরা। কিন্তু রাউন্ড অফ সিক্সটিনে তুরস্কের কাছে ১-০ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয় স্বাগতিক জাপানকে।
ওইদিকে আরেক স্বাগতিক দল দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ার ফুটবলের ইতিহাসকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। গ্রুপপর্বে পর্তুগাল, পোল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই রাউন্ড অফ সিক্সটিনে যায় দক্ষিণ কোরিয়া। তবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েও রাউন্ড অফ সিক্সটিনে সেসময়ে তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালির মুখোমুখি হতে হয় দক্ষিণ কোরিয়াকে। চূড়ান্ত নাটকীয় ম্যাচে ইতালিকে গোল্ডেন গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যায় কোরিয়ানরা।
কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল স্পেনের মতো পরাশক্তি। কোয়ার্টার ফাইনালেও দুর্দান্ত খেলে কোরিয়া। পুরো ১২০ মিনিট স্প্যানিশ আক্রমণভাগকে আটকে রেখে খেলা নিয়ে যায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারে স্পেনকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে প্রথম এশিয়ান দল হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠার অনন্য এক কীর্তি গড়ে দক্ষিণ কোরিয়া। এই জয়ের মাধ্যমে এশিয়ার দেশ হিসেবে ১৯৬৬ বিশ্বকাপে উত্তর কোরিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার রেকর্ড টপকে যায় দক্ষিণ কোরিয়া। যদিও এই দুই ম্যাচেই রেফারি বেশ দৃষ্টিকটুভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে কয়েকটি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, তা-ও এশিয়ান কোনো দল হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে খেলাটা অবশ্যই বিশাল এক অর্জন ছিল।
সিউলে সেমিফাইনালে জার্মানির মুখোমুখি হয় দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার জার্সি রঙের সাথে মিল রেখে পুরো স্টেডিয়াম লাল কৃষ্ণচূড়ায় রাঙিয়ে তোলে দর্শকরা। কিন্তু সেদিন আর কোরিয়ানরা পেরে ওঠেনি, জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে থামে সেই স্বপ্নযাত্রা। পরে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তুরস্কের কাছে ৩-২ গোলে হেরে সেই আসরে চতুর্থ হয় দক্ষিণ কোরিয়া। এশিয়ার একটি দেশ বিশ্বকাপে চতুর্থ এটা পুরো এশিয়ার জন্যই বিশাল গর্বের একটি ব্যাপার ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার ডিফেন্ডার হোং মিয়ং বো বিশ্বকাপের তৃতীয় সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ব্রোঞ্জ বল জেতায় তাদের গর্বের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের এমন পারফর্মেন্সের পর মনে হচ্ছিলো এশিয়ার ফুটবল বুঝি সত্যিই উন্নতির পথ খুঁজে পেলো।
আবারো ছন্নছাড়া এশিয়ার প্রতিনিধিরা
দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এশিয়ার দলগুলো ২০০২ বিশ্বকাপের সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। ২০০৬ বিশ্বকাপে এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে খেলতে যায় দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইরান ও সৌদি আরব। সেই আসরে কোনো এশিয়ার দলই গ্রুপপর্ব পার হতে পারেনি! ২০১০ বিশ্বকাপ থেকে অস্ট্রেলিয়া এশিয়ান জোনে খেলা শুরু করায় এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করাটা আরেকটু দুরূহ হয়ে যায়। সেই আসরে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বকাপে খেলতে যায় উত্তর কোরিয়া,দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। এদের মধ্যে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া রাউন্ড অফ সিক্সটিনে উন্নীত হয়। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপে এশিয়ার দেশগুলোর পারফর্মেন্স ছিল চূড়ান্ত হতাশাজনক। দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান কিংবা জাপান প্রতিটি দল গ্রুপপর্ব শেষ করে নিজ নিজ গ্রুপের একদম তলানিতে থেকে! ২০০২ বিশ্বকাপ যেই আশার আলো জ্বালিয়েছিলো, পরের আসরগুলোতে এশিয়ার দলগুলোর দুর্দশা এক দমকা হাওয়া হিসেবে এসে সেই আশার প্রদীপ প্রায় নিভিয়েই ফেলেছে।
ফুটবলে এশিয়ার দলগুলো কেনো এতটা পিছিয়ে?
ফুটবলে এশিয়ার দেশগুলোর পিছিয়ে থাকার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় এশিয়ায় সেরকমভাবে ফুটবলের ঐতিহ্য না থাকা। ইউরোপ কিংবা লাতিন আমেরিকায় জন্ম নেওয়া শিশু তার জন্মের পর থেকেই ফুটবলের মাঝে বড় হয়। সেখানে এশিয়ার খুব কম দেশেই ফুটবল সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। চীনে জিমন্যাস্টিকই বেশি জনপ্রিয়, দক্ষিণ কোরিয়া বেশি মনোযোগী আর্চারিতে। জাপানে জুডো কিংবা সুমো রেসলিংয়ের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। আর দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে তো ক্রিকেটের একচ্ছত্র দাপট। ঐতিহ্য না থাকলে বিশ্ব ফুটবলে ভালো করা কিছুটা হলেও দুরূহ।
তাছাড়া অবকাঠামোগত দিক থেকেও এশিয়ার দেশগুলো বেশ পিছিয়ে। ফলে নতুন ফুটবলাররাও ইউরোপ কিংবা লাতিন আমেরিকার তুলনায় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে না। এব্যাপারে দীর্ঘদিন এশিয়ায় কোচিং করানো কোচ উলরিখ স্টাইলিক বলেন,
“এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর মাঝে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ আছে। জাপান কী করছে, সেদিকে কোরিয়া তাকিয়ে থাকে আবার জাপান তাকিয়ে থাকে চীনের দিকে। কিন্তু এভাবে প্রতিবেশীদের দিকে নজর রাখতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই যে সেই সময়ে ইউরোপের দেশগুলোর সাথে আমাদের দূরত্ব আরো বেড়ে চলেছে।”
স্টাইলিকের কথাতে এশিয়ার পিছিয়ে পড়ার কারণ খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
এশিয়ার পিছিয়ে থাকার আরেকটি বড় কারণ জন্মগতভাবে শারিরীক দিক থেকে ইউরোপ, লাতিন কিংবা আফ্রিকানদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা। ফুটবলে স্কিলের সাথে স্ট্যামিনাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হওয়াটাও এশিয়ার দলগুলোর পিছিয়ে থাকার পেছনে বেশ বড় ভূমিকা পালন করছে।
শেষ কথা
এতসব হতাশার মাঝেও চাইনিজ লিগ কিংবা জাপানিজ লিগে বিশাল পরিমাণে অর্থের বিনিয়োগ আশার আলো ছড়াচ্ছে। অস্কার, তেভেজ, ল্যাভেজ্জি, ইনিয়েস্তা কিংবা জাভির মতো তারকাদের এশিয়ার লিগে খেলাটা অবশ্যই এশিয়ার জন্য ভালো খবর। এসব বড় তারকাদের সাথে খেললে এশিয়ার ফুটবলাররা নিজেদের উন্নতির জায়গাটা আরো ভালোভাবে খুঁজে পাবে, তাদের কাছ থেকে শিখতেও পারবে অনেককিছু। যদিও শুধুমাত্র লিগে টাকা বিনিয়োগ করেই উন্নয়ন সম্ভব নয়, একদম নিচের স্তরেও সেই উন্নতির ছোঁয়া নিয়ে যেতে হবে। তাও এই বিনিয়োগ অবশ্যই আশার আলো হয়ে এসেছে।
এবার এশিয়ার প্রতিনিধি হয়ে পাঁচটি দেশ রশিয়া বিশ্বকাপে অংশ নিতে যাচ্ছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও ইরানের সাথে ওশেনিয়ার দেশ অস্ট্রেলিয়াও বিশ্বকাপে এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবে। আমরা আশা করবো গত আসরের ব্যর্থতা ভুলে এশিয়ার দেশগুলো এবার সাফল্যের কক্ষপথে ফিরবে। সুন্দর ফুটবল উপহার দেবে এশিয়ার সকল প্রতিনিধি, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ফিচার ইমেজ : FourFourTwo