১.
ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সম্মিলিতভাবে ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন করে। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে শ্রীলঙ্কার মাটিতে গ্রুপপর্বে নিজেদের ম্যাচ খেলতে যায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়া। এই দু’টি ম্যাচেই শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার মাটিতে খেলতে না যাওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে তেমন সমস্যা হয়নি। তিন জয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে গ্রুপ ‘এ’ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে না খেলার পর কেনিয়ার বিপক্ষেও পরাজিত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এতে করে তাদের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার সমীকরণ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত বড় ধরণের অঘটন ঘটেনি। গ্রুপ ‘এ’ থেকে চতুর্থ অবস্থানে থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল তারা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসাবে পায় গ্রুপপর্বে পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিতে জয় পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে। গ্রুপপর্বে দুর্দান্ত খেললেও কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রায়ান লারার অসাধারণ ব্যাটিংয়ের পর রজার হার্পারের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১৯ রানে হেরে বিদায় নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
অস্ট্রেলিয়া তাদের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে প্রতিবেশী নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বড় রান তাড়া করে জয় পায়। যার ফলে শেষ চারে আবারও মুখোমুখি হয় গ্রুপ ‘এ’তে দুই দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়া। কেনিয়ার বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরাজিত হলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের গ্রুপপর্বের জয় পেয়েছিল তারা।
২.
গ্রুপপর্বে ধুঁকতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেমিফাইনালের আগে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে গ্রুপপর্বের ম্যাচে পরাজিত করেছিল তারা। মোহালিতে ‘৯৬ সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মার্ক টেলর। মোহালির পেস সহায়ক উইকেটে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে উইন্ডিজ পেসারদের তোপের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। মাত্র ১৫ রান তুলতেই সাজঘরে ফিরে যান মার্ক টেলর, দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মার্ক ওয়াহ, রিকি পন্টিং এবং স্টিভ ওয়াহ। এই চার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মোট চার রান যোগ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে।
দলের বিপর্যয়ের মুখে বুক চিতিয়ে লড়াই করার ক্ষেত্রে মাইকেল বেভানের বিকল্প হয় না। সেমিফাইনালেও তিনি দলের বিপদে ব্যাট হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যান স্টুয়ার্ট ল’কে। এই দুইজন ব্যাটসম্যান ধীরগতিতে ব্যাটিং করে বড় জুটি গড়েন। নিজেদের ইনিংসের শুরুতে রান তোলার চেয়ে উইকেটে টিকে থাকাকেই বেশি প্রাধান্য দেন তারা। তাদের ১৩৮ রানের অসাধারণ জুটি ভাঙে স্টুয়ার্ট ল রান আউট হয়ে ফিরে গেলে। তিনি দলীয় ১৫৩ রানের মাথায় ১০৫ বলে পাঁচটি চারের মারে ৭২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তার বিদায়ের পর মাইকেল বেভানও দ্রুত ফিরে যান, তিনি ১১০ বলে চারটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৬৯ রান করেছিলেন।
এই দুইজনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের পর উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ইয়ান হিলি ২৮ বলে দ্রুত ৩১ রানের ইনিংস খেলে দলকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দেন। শেষদিকে তার দ্রুত রান তোলার ফলে অস্ট্রেলিয়া নির্ধারিত ওভার শেষে আট উইকেটে ২০৭ রান সংগ্রহ করে। ম্যাচের প্রথমভাগের ব্যর্থতার পর ল, বেভান এবং হিলির ব্যাটে চড়ে বেশ ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরেছিল অস্ট্রেলিয়া।
৩.
মোহালিতে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই পেসার কার্টলি অ্যামব্রোস এবং ইয়ান বিশপ আগুনঝড়ানো বোলিংয়ে মাত্র ১৫ রানেই চার উইকেট হারিয়ে বসেছিল অস্ট্রেলিয়া। মার্ক টেইলর এবং স্টিভ ওয়াহকে সরাসরি বোল্ড করেছিলেন বিশপ। মার্ক ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেছিলেন অ্যামব্রোস। অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা আরও শোচনীয় হতে পারতো, যদি বিশপ তার পা দাগের মধ্যে রাখতে পারতেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ৭২ রান করা স্টুয়ার্ট ল তার বলে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিল, কিন্তু বিশপ সেই বলটি নো করে বসেন। এরপর থেকে ল এবং বেভান জুটি অস্ট্রেলিয়াকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দিয়েছিলেন।
নিজের করা নো বল নিয়ে ইয়ান বিশপের আফসোস ইতি ছিল না। এই সম্পর্কে তিনি বলেন,
‘আমার নো বলে স্টুয়ার্ট ল ক্যাচ উঠিয়েছিল। আমার মনে হয়, সে মিড উইকেটে ফ্লিক করেছিল। সে সময় এটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু হতে পারতো। এখনও এটা আমাকে পীড়া দেয় যে, আমি আমার পা দাগের ভেতরে রাখতে পারিনি।’
মাইকেল বেভান এবং স্টুয়ার্ট ল দুইজনেই বেশ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ছিলেন। তবে স্টুয়ার্ট ল সেই তুলনায় অনভিজ্ঞ ছিলেন। ল’কে আউট করা বলটি যদি বিশপ নো বল না করতেন, তাহলে অস্ট্রেলিয়া বেশ চাপে পড়ে যেতো। শেষ পর্যন্ত ভাগ্য সহায় থাকার কারণে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি।
৪.
অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২০৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শিবনারায়ণ চন্দরপলের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে জয়ের পথেই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অন্যদিকে, মোহালিতে শিশিরের কারণে অস্ট্রেলিয়ার দুই লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন এবং স্টুয়ার্ট ল’র বোলিং করতে সমস্যা হচ্ছিল। শিশির খুব বেশি ছিল না, কিন্তু যতটুকু ছিল তাতেই সমস্যায় পড়েছিলো স্পিনাররা। একের পর এক ফুলটস দিতে থাকেন তারা। এই সুযোগই ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে দলের রানের চাকা এগিয়ে নিতে থাকেন লারা-চন্দরপলরা।
উদ্বোধনী উইকেট জুটি ২৫ রানে ভেঙে যাওয়ার পর জুটি বাঁধেন চন্দরপল এবং ব্রায়ান লারা। তারা দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৬৮ রান যোগ করেন। ৪৫ বলে ৪৫ রান করা লারা দলীয় ৯৩ রানে ফিরে গেলে এই জুটি ভাঙে। এরপর অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন ব্যাট করতে নেমে চন্দরপলকে সাথে নিয়ে দলকে জয়ের পথে রাখেন।
এক পর্যায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ছিল দুই উইকেটে ১৬৫ রান। জয়ের জন্য আট উইকেট হাতে রেখে মাত্র ৪৩ রান প্রয়োজন ছিল তাদের। এমন পরিস্থিতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে ১৯৮৩ সালের পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার হাতছানি দেয়।
শিবনারায়ণ চন্দরপল দলীয় ১৬৫ রানের মাথায় ৮০ রান করে সাজঘরে ফিরে গেলে রিচার্ডসন এবং তার মধ্যকার ৭২ রানে জুটি ভাঙে। এই জুটি ভাঙার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভাবেনি, তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। জিমি অ্যাডামস এবং কীথ আর্থারটনকে ব্যাটিংয়ে না নামিয়ে রজার হার্পার এবং ওটিস গিবসনকে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খামখেয়ালিপনার সুযোগ কাজে লাগায় অস্ট্রেলিয়া। শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং ফ্লেমিংয়ের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে দুই উইকেটে ১৬৫ রান থেকে ১৮৭ রান তুলতেই সাত উইকেট হারায় তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপপর্বেও কেনিয়াকে ‘সহজভাবে’ নিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল।
৫.
দলের মিডল-অর্ডার এবং লোয়ার মিডল-অর্ডারে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানরা নিজেদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসলেও একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন রিচি রিচার্ডসন। দলীয় ১৯৪ রানের মাথায় ইয়ান বিশপ তিন রান করে শেন ওয়ার্নের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফেরেন। দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা শেন ওয়ার্নের ম্যাচে এটি চতুর্থ উইকেট ছিল। শুরুতে শিশিরের জন্য বল করতে সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৬ রান দিয়ে চার উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের পথ দেখান তিনি।
বিশপ যখন ৮ম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাজঘরে ফেরেন, তখনও জয়ের জন্য ১৪ রান প্রয়োজন ছিল উইন্ডিজের। তখনও এক প্রান্ত আগলে রেখে লড়াই করে যাচ্ছিলেন রিচি রিচার্ডসন। ডেমিয়েন ফ্লেমিং যখন ইনিংসের শেষ ওভারে বোলিং করতে আসেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল দশ রানের। স্ট্রাইকে ছিলেন রিচার্ডসন, তিনি প্রথম বলেই চার হাঁকিয়ে উইন্ডিজকে ম্যাচে ফেরান। এরপর যে ভুলটি করলেন, তার জন্য হয়তো অনেকদিন ধরে তিনি আফসোস করেছেন। দলের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো পাঁচ বলে ছয় রান। তখনই দ্রুত সিঙ্গেল নিতে গিয়ে কার্টলি অ্যামব্রোস রান আউট হয়ে ফিরে যান। সেই সাথে রিচার্ডসনও স্ট্রাইক হারিয়ে ফেলেন।
শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলতে নামা কোর্টনি ওয়ালশ প্রথম বলে বোল্ড হয়ে গেলে পাঁচ রানে পরাজিত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্লেমিংয়ের বলে ওয়ালশ যখন বোল্ড হন, তখন অপর প্রান্তে থাকা রিচার্ডসন ৪৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। শেষ ওভারে সিঙ্গেল নিতে যাওয়ার ভুলে এবং সতীর্থদের ব্যর্থতার দিনে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে পারেননি তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ সাত ব্যাটসম্যান মিলে মাত্র দশ রান সংগ্রহ করলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পরাজিত হয়ে মাঠ ত্যাগ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর আগে তিনবার সেমিফাইনালেও উঠলেও কখনও পরাজিত হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
নব্বইয়ের দশকে উপমহাদেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলাটা বেশ কঠিন ছিল। এখনকার আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়াটাও তাদের কাছে এক ধরনের পরীক্ষা ছিল। গ্রুপপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে পরাজয়ের পর সেমিফাইনালেও দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফাইনাল খেলে অজিরা। তাদের এই জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন শেন ওয়ার্ন। তিনি ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপেও এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমিফাইনালে দুর্দান্ত বোলিং করে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে উঠানোর পর চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয়ে ফাইনালে ওঠার পর অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মার্ক ওয়াহ তার বায়োগ্রাফিতে বলেন,
‘How the bloody hell did we win that?’
১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল খেলেছিল ভাগ্যগুণে এবং প্রশংসনীয় মনোবলে। তা না হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হাল না ছেড়ে দুইবার ঘুরে দাঁড়িয়ে জয় পাওয়াটা কল্পনাতীত।