শ্রীলঙ্কায় যখন বাংলাদেশ ব্যস্ত নিদাহাস ট্রফি নিয়ে, ঘরের মাঠে মাশরাফি বিন মুর্তজা-নাসির হোসেনদের তখন কপালের ঘাম ঝরছে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের ম্যাচ সামলাতে গিয়ে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত লিস্ট ‘এ’ ম্যাচের এই টুর্নামেন্ট, নিদাহাস ট্রফির পর্দা নামতে নামতে প্রথম রাউন্ডের খেলাও শেষ করে ফেলেছে। টি-টোয়েন্টি দলের বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের সবাই অংশ নিয়েছে এই টুর্নামেন্টে। আর যারা জাতীয় দলের কারণে যোগ দিতে পারেনি, তারা খেলবে সুপার লিগ থেকে।
মোট ১২ ক্লাবের অংশগ্রহণে আয়োজিত টুর্নামেন্টে ৬টি দল জায়গা করে নিয়েছে সুপার লিগে। শেষ ৩ দল, অর্থাৎ ১০, ১১ ও ১২তম অবস্থানে থাকা ক্লাব তিনটি খেলবে রেলিগেশন রাউন্ড। এখানে শেষ দুই দল নেমে যাবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। বলা চলে, এই রাউন্ড হলো পিঠ বাঁচানোর লড়াই। টুর্নামেন্টের প্রথম রাউণ্ড শেষে সর্বোচ্চ উইকেট আর রান সংগ্রহের তালিকাটাও বেশ নজরকাড়া। দেশি-বিদেশি ক্রিকেটারদের মিলিত পারফরম্যান্সে পয়েন্ট টেবিলের মতো ব্যক্তিগত হিসেবনিকেশও জমকালো।
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগের প্রথম রাউন্ড শেষে সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান ও সেরা পাঁচ বোলারদের অবস্থাটা দেখে নেওয়া যেতে পারে।
সেরা পাঁচ বোলার
প্রথম রাউন্ড শেষে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় প্রথম পাঁচজনের চারজনই পেস বোলার। টুর্নামেন্টের সর্বশেষ আসরে উইকেট নিয়ে সমালোচনায় মুখর ছিল পেসাররা। স্পিনারদের সঙ্গে উইকেট শিকারের উৎসবে পেরে ওঠাই ছিল দুষ্কর। এ বছর সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
উইকেট শিকারের তালিকায় সবার উপরে আছেন বাংলাদেশের বর্তমান ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। আবাহনী লিমিটেডের হয়ে খেলছেন তিনি। মজার ব্যাপার হল, এ বছর শুরু থেকেই তিনি আবাহনীতে ছিলেন না।
৩৪ বছর বয়সী মাশরাফি লিগের শুরুতে প্লেয়ার বাই চয়েসে লটারি ভাগ্যে জায়গা পেয়েছিলেন নবাগত ক্লাব শাইনপুকুরে। সেখান থেকে ওই ক্লাবের সঙ্গে আলোচনা করে তথা ‘প্লেয়ার একচেঞ্জ’ চুক্তিতে আবাহনী লিমিটেড মাশরাফিকে দলে ভেড়ায়। যদিও দুটি ক্লাবই একই মালিকের।
আবাহনীর হয়ে শুরু থেকেই দাপুটে ছিলেন মাশরাফি। প্রথম পর্বে ১১ ম্যাচ খেলেছেন, নিয়েছেন ৩০ উইকেট। ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিকের দেখাও পেয়েছেন এই ১১ ম্যাচের মধ্যে। কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের বিপক্ষে ৪ উইকেট নিয়ে লিগের ‘রাজকীয়’ শুরু করেছিলেন তিনি। যে ম্যাচেই অংশ নিয়েছেন, সেই ম্যাচেই চেষ্টা করেছেন দলকে কিছু দেওয়ার। ওই ১১ ম্যাচে মোট ৩৯৮ রান খরচ করেছেন। তাতে হিসেবের খাতা জানাচ্ছে, ম্যাচে ওভার প্রতি মাশরাফি দিয়েছেন মাত্র ৪.৩৮ রান। বলে রাখা ভালো, কেবল ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিকই এবারের প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে নেননি মাশরাফি, প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিকের দেখাও পেয়েছেন। যে অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন তিনি, সেই ম্যাচে ৪ বলে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন। সেরা বোলিং ফিগার ৪৪ রানে ৬ উইকেট।
টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন কাজী অনিক। দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্লাব মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের এই সদস্য ১১ ম্যাচ খেলে মোট ২৮ উইকেট নিয়েছেন। প্রথম রাউণ্ড পর্যন্ত ৯৮.৫ ওভার বল করে খরচ করেছেন ৫৩৫ রান। ওভার প্রতি দিয়েছেন ৫.৪১ রান। টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত অনিকের সেরা পারফরম্যন্স ৪৯ রান খরচে ৬ উইকেট। কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের বিপক্ষে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মাঠে এই পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছিলেন বাঁহাতি এই পেসার। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। মাশরাফির পর নিজের নাম লেখাতে পারলেও লিগে নিজের ঝলক আর দেখানো হল না। কারণ তার দল সুপার লিগে ওঠার লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
তৃতীয় অবস্থানে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের বাঁহাতি স্পিনার আসিফ হাসান। নিজের ঝুলিতে ১১ ম্যাচ খেলে পুরেছেন ২৩ উইকেট। ৪.১১ রান ওভার প্রতি খরচ করে ১০২ ওভার বল করেছেন আসিফ। সেরা বোলিং ফিগার ২৩ রানে ৪ উইকেট।
চতুর্থ অগ্রণী ব্যাংকের জার্সিতে খেলা পেসার শফিউল ইসলাম। এই মুহূর্তে জাতীয় দলের বাইরে থাকা এই পেসার মোট ১১ ম্যাচ খেলে ২২ উইকেট নিয়েছেন। তার সেরা বোলিং ফিগার ৪৮ রানে ৪ উইকেট। ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে এই পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ১১ টেস্ট, ৫৬ ওয়ানডে আর ১২ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা শফিউল ওভার প্রতি গড়ে ৪.৯২ রান দিয়েছেন।
সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে নাম লিখিয়েছেন লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের পেসার মোহাম্মদ শহীদ। মোট ২১ উইকেট নিয়েছেন তিনি। প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগের প্রথম রাউন্ডের মোট ১১ ম্যাচে তার সেরা সাফল্য ৪১ রানে ৪ উইকেট নেওয়া। জাতীয় দলে হয়ে ৫ টেস্ট ও একটিমাত্র টি-টোয়েন্টি খেলা শহীদ অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন।
সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান
জাতীয় দলের কারণে দলে নেই তামিম ইকবাল কিংবা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মতো ব্যাটসম্যানরা। নেই সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্ব বিখ্যাত তারকা। তারপরও ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে ব্যাট হাতে ঝলকানি দেখা গেছে হরহামেশাই। টি-টোয়েন্টি দলের বাইরে থাকা জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সেরা পাঁচের তালিকায় নেই কোনো তারকা ব্যাটসম্যান।
লিগের প্রথম রাউণ্ড শেষে পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, রানের হিসেবে সেরা ব্যাটসম্যানের জায়গাটা নিজের করে নিয়েছেন খেলাঘর সমাজ কল্যাণ সমিতির ভারতীয় ব্যাটসম্যান আল মেনারিয়া। রাজস্থানের এই ক্রিকেটার ১১ ম্যাচে মোট ৫৪০ রান তুলেছেন। সর্বোচ্চ ১১৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন। এখন পর্যন্ত সেঞ্চুরি ওই একটিই। হাফ সেঞ্চুরি মোট ৬টি। মেনারিয়ার ম্যাচ প্রতি গড় রান ৮১.৪২।
দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের ওপেনার আব্দুল মজিদ। ১১ ম্যাচে তার সংগ্রহ ৫৩৬ রান। সর্বোচ্চ ১১০ রানের ইনিংস খেলেছেন। একটি সেঞ্চুরি রয়েছে, হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন চারবার।
সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন জাতীয় দলে এক সময়ের নিয়মিত ক্রিকেটার নাঈম ইসলাম। আব্দুল মজিদের মতো তিনিও খেলছেন লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জ ক্লাবে। প্রথম রাউন্ড শেষে ১১ ম্যাচের ১১ ইনিংসে মোট ৫২৯ রান পেয়েছেন নাঈম। সতীর্থ মজিদের মতো তারও হাফ সেঞ্চুরি চারটি, সেঞ্চুরি একটি। সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি ছিল অপরাজিত ১১৬ রানের। নাঈম সর্বশেষ ২০১৪ সালে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন। ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের হয়ে ৮ টেস্ট, ৫৯ ওয়ানডে ও ১০টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন।
প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের আল-আমিন জুনিয়র সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের তালিকায় রয়েছেন চার নম্বরে। ১১ ম্যাচে তার মোট রান ৪৯৫। সেঞ্চুরি একটি। হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন তিনটি। সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি ছিল ১১০ রানের।
পঞ্চম অবস্থানে আবাহনী লিমিটেডের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান এনামুল হক বিজয়। ১১ ম্যাচে তিনি তুলেছেন ৪৯০ রান। জানুয়ারিতে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজ দিয়ে দীর্ঘদিন পর জাতীয় দলে ফেরেন বিজয়। এরপর আবার দলে বাইরে তিনি। কিন্তু নিজের সামর্থ্যের পরিচয় ঘরোয়া লিগে দিতে ভুলছেন না। ১১ ম্যাচের ১১ ইনিংসে গড়ে ম্যাচ প্রতি ৪৯ রান পেয়েছেন। একটিমাত্র সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরি তিনটি। লিগের প্রথম রাউন্ডে সর্বোচ্চ ১১৬ রানের ইনিংস খেলেছেন বিজয়।
ব্যাট হাতে প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে সবচেয়ে দুর্ভাগা বলা যায় জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলকে। প্রথম রাউণ্ডে তার ব্যাটেই এসেছে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি। কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলতে গিয়ে ১১ ম্যাচে মোট তিনটি সেঞ্চুরি তুলেছেন তিনি। তারপরও ধারাবাহিক হতে পারেননি। তিন ম্যাচে আউট হয়েছেন শূন্য রানে। সর্বোচ্চ ১২৭ রানের ইনিংস খেলেছেন। একটি হাফ সেঞ্চুরিও আছে তার। মোট রান ৪৬০। সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছেন ১১ নম্বরে। শুধু তা-ই নয়, তার দল কলাবাগান সুপার লিগে জায়গা পায়নি। উল্টো রেলিগেশন রাউন্ডে মান বাঁচানোর লড়াইতে নাম লিখিয়েছে।
ফিচার ইমেজ- Walton