বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) শেষ হয়েছে আগেই। ২০১৯ আসরের মতো আগের কোনো আসর এমন সাদামাটা ছিল কি না, তা বোঝা দায়। অবস্থাটা এতোটাই সঙিন যে, দর্শকহীনতায় ভোগা বিশ্বের অন্যতম ‘জনপ্রিয়’ এই টুর্নামেন্টে দর্শক টানতে ‘অনুরোধ করতে’ হয়েছে ক্রিকেটারদেরকেও। তাতে অবশ্য বিশেষ ফল মেলেনি। তবে হ্যাঁ, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্ব থেকে দর্শক সমাগম বেড়েছে অনেকখানি। সেই সমাগমের বাঁধ ভেঙেছে ফাইনাল ম্যাচে।
দর্শক থাকুক বা না-ই থাকুক, বিপিএলে ক্রিকেটারদের কাজ থেমে ছিল না। তারা খেলেছেন, নিজেদের উজাড় করেই পারফরম্যান্স করেছেন। সবকিছু মিলিয়েই কেউ সফল, কেউ বা ব্যর্থ। টুর্নামেন্টজুড়ে কেমন ছিল এবারের বিপিএলের পারফরম্যান্স? সর্বোচ্চ রান ও উইকেটে শিকারের তালিকা অনুযায়ী ব্যাট হাতে সবচেয়ে বেশি আলো কেড়েছেন বিদেশি ক্রিকেটাররা। তবে বল হাতে পুরো কৃতিত্ব বাংলাদেশিদেরই।
ব্যাট হাতে আগের আসরে ঝড় তুলেছিলেন রংপুর রাইডার্সের ক্রিস গেইল। এই আসরে তিনি ছিলেন একরকম নিষ্প্রভ। অর্থাৎ, ২০১৮ বিপিএলে পরিবর্তন আর নতুনত্বের হাওয়া ছিল প্রবল।
-
সেরা ব্যাটসম্যান
রাইলি রুশো (রংপুর রাইডার্স)
২০১৭ আসরের চ্যাম্পিয়ন রংপুর রাইডার্সের ক্রিকেটার রাইলি রুশো। দক্ষিণ আফ্রিকান এই ব্যাটসম্যান এবারের বিপিএলে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান সংগ্রাহক। এবারের টুর্নামেন্টে সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলেছিলো মাশরাফি বিন মুর্তজার রাইডার্স। সেই ধারাবাহিকতায় রুশো ১৪ ম্যাচে তুলেছেন ৫৫৮ রান। প্রতি ম্যাচে গড়ে ৬৯.৭৫ রান তুলেছেন এই প্রোটিয়া হার্ডহিটার। সর্বোচ্চ ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন। হাফ সেঞ্চুরি ছিল পাঁচটি। এর মধ্যে আবার দুই ম্যাচে শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন রুশো। পুরো টুর্নামেন্টে তার ছক্কা হাঁকানোর সংখ্যা ২৪, চার মেরেছেন ৪৯টি।
সত্যি বলতে, রাইলি রুশো রংপুর রাইডার্সে ক্রিস গেইলের পারফরম্যান্সের অভাবটুকু দারুণভাবে পূরণ করতে পেরেছিলেন।
তামিম ইকবাল (কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স)
গেল আসরেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সে ছিলেন তামিম ইকবাল। বাংলাদেশ জাতীয় দলের এই ওপেনার সেবার সর্বোচ্চ রানের তালিকায় ছিলেন চতুর্থ। এবারও তা-ই হতে পারতেন। কিন্তু সাকিব আল হাসানের ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে বিপিএলের ফাইনাল ম্যাচে রেকর্ড সেঞ্চুরি গড়ে পার করলেন আরও দুই ধাপ। অর্থাৎ টুর্নামেন্ট শেষে তার অবস্থান দুই নম্বরে। ১৪ ম্যাচে মাঠে নেমেছেন, ৩৮.৯১ গড়ে মোট ৪৬৭ রান তুলেছেন। সব মিলিয়ে ছিল একটি সেঞ্চুরি ও দু’টি হাফ সেঞ্চুরি। ছক্কা হাঁকিয়েছেন ২৩টি, তার ব্যাটে চার এসেছে ৪১টি।
ফাইনাল ম্যাচে তামিম মাত্র ৬১ বলে অপরাজিত ১৪১ রানের টর্নেডো ইনিংস খেলেন। ২০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে যেকোনো অবস্থানে এটিই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রানের ইনিংস। এর আগের ইনিংসটি ছিল ১৩০ রানের, সেটিও এসেছিলো তামিমের ব্যাটেই।
মুশফিকুর রহিম (চিটাগং ভাইকিংস)
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম বিপিএলেও ছিলেন ঝলমলে। অধিনায়কত্ব থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স, সব ক্ষেত্রেই মুশফিক ছিলেন মনে রাখার মতো। এই প্রথমবার চিটাগং ভাইকিংস পয়েন্ট টেবিলের প্রথম চারে জায়গা করে নিতে পেরেছিলো।
এই আসরে মুশফিকের মোট সংগ্রহ ৪২৬ রান। ৩৫.৫০ গড়ে তোলা এই সংগ্রহের মধ্যে কোনো সেঞ্চুরি নেই, আছে তিনটি হাফ সেঞ্চুরি। পুরো টুর্নামেন্টে তার সর্বোচ্চ ইনিংসটি ছিল ৭৫ রানের। ছক্কা হাঁকিয়েছেন ১৮টি, বাউন্ডারি ৩৬টি।
নিকোলাস পুরান (সিলেট সিক্সার্স)
সিলেট সিক্সার্সের ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার নিকোলাস পুরান শুরু থেকেই ফর্মে ছিলেন। যদিও দল হিসেবে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি দল, তারপরও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের দিক থেকে দারুণ কিছু করে দেখিয়েছেন এই দলের কয়েকজন সদস্য। ১১ ম্যাচে ৩৭৯ রান তুলতে গিয়ে সর্বোচ্চ ৭৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন তিনি, গড় ৪৭.৩৭। পুরো টুর্নামেন্টে তার ব্যাটে ছক্কা এসেছে ২৮টি, চার ২৭টি। বলে রাখা ভালো, আন্দ্রে রাসেল ও নিকোলাস পুরান এবারের বিপিএলে সর্বোচ্চ সংখ্যক (২৮টি) ছক্কা হাঁকিয়েছেন।
লরি ইভানস (রাজশাহী কিংস)
বিপিএলে রাজশাহী কিংস দলের সদস্য লরি ইভানস। ১১ ম্যাচে মাঠে নেমে ৩৩৯ রান করেছেন তিনি, ম্যাচপ্রতি গড় রান ৩৭.৬৬। সর্বোচ্চ ১০৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলা এই ক্রিকেটার পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে ১০টি ছক্কা ও ৩৭টি চার মেরেছেন।
-
সেরা বোলার
এবারের বিপিএলে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকা দেখলে ভালো হয়ে যেতে পারে আপনার মন। সেরা পাঁচের সবাই বাংলাদেশি। শুধু তা-ই নয়, পাঁচজনের মধ্যে এক সাকিব আল হাসান ছাড়া সবাই পেসার। অর্থাৎ, বাংলাদেশের উইকেটেও পেসারদের সুদিন আসছে, এই আশা আপনি করতেই পারেন। তবে একটু মন খারাপ করার মতো খবরও আছে। সেরা পাঁচ তো বটেই, দশের মধ্যেও নেই কোনো নতুন মুখ।
সাকিব আল হাসান (ঢাকা ডায়নামাইটস)
ফাইনাল পর্যন্ত ১৫টি ম্যাচই খেলেছেন ঢাকা ডায়নামাইটস অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। সব মিলিয়ে উইকেট নিয়েছেন ২৩টি, খরচ করেছেন ৪০৬ রান। সেরা বোলিং ফিগার ১৬ রানে ৪ উইকেট। তবে সর্বোচ্চ উইকেট পেলেও, ভীষণ রকম খরুচে ছিলেন সাকিব।
তাসকিন আহমেদ (সিলেট সিক্সার্স)
এবারের বিপিএল তাসকিন আহমেদের জন্য ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর টুর্নামেন্ট। দফায় দফায় ইনজুরি আর অফ ফর্মের কারণে বারবার ছিটকে যাচ্ছিলেন জাতীয় দল থেকে। সিলেট সিক্সার্সের হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার মাধ্যমে আবারও দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন, এটাই ছিল তার মিশন। সেই মিশনে দারুণ সফল হয়েছিলেন ফাস্ট বোলার তাসকিন। ১২ ম্যাচে ৩১৮ রান খরচ করে তুলে নিয়েছিলেন ২২ উইকেট। সেরা বোলিং ফিগার ছিল ২৮ রানে ৪ উইকেট। মোট দুইবার চার উইকেট নিয়েছেন তিনি এবারের বিপিএলে, যে কীর্তি এবার কেবল তাসকিনেরই পাশে লেখা হয়েছে। ২২ উইকেট নিতে গিয়ে তিনি খেলেছেন ১২ ম্যাচ। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার, এই ম্যাচটিই ছিল বিপিএলে সিলেটের শেষ ম্যাচ, যেখানে ফিল্ডিং করতে গিয়ে পায়ে চোট পান তাসকিন। যে জাতীয় দলে জায়গা পেতে কষ্ট করেছিলেন, সেই কষ্টের ফল পেয়েছিলেন নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দলে নাম লিখিয়ে। কিন্তু সেই চোট তাকে আবারও দর্শক বানিয়ে দিল।
মাশরাফি বিন মুর্তজা (রংপুর রাইডার্স)
গেল আসরের মতো এই আসরেও নজর কেড়েছেন পেসার মাশরাফি বিন মুর্তজা। রংপুর রাইডার্সের এই অধিনায়ক ১৪ ম্যাচে ২২ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকার তিন নম্বরে নাম লিখিয়েছেন। খরচ করেছেন ৩৮৭ রান। ১১ রানে ৪ উইকেট ছিল এ বছর তার সেরা বোলিং ফিগার।
রুবেল হোসেন (ঢাকা ডায়নামাইটস)
১৫ ম্যাচে ২২ উইকেট নেওয়া ঢাকা ডায়নামাইটসের ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেন এবারের বিপিএলে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় চার নম্বরে রয়েছেন। সেরা বোলিং ফিগার ২৩ রানে ৪ উইকেট। রুবেলের ওভারপ্রতি গড় রান ছিল ১৮.৫০।
মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন (কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স)
এবারের বিপিএলে চ্যাম্পিয়ন দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের পেসার মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন নজর কেড়েছেন সবদিক থেকে। একে তো তরুণ হিসেবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় পাঁচ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছেন, পাশাপাশি পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে দলকে দারুণভাবে এগিয়ে দিয়েছেন নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে। যদিও দলের হয়ে সবগুলো ম্যাচে সুযোগ হয়নি তার, কিন্তু ১৩ ম্যাচে ২০ উইকেট নেওয়ার পথে ছিলেন বেশ কৃপণ। দু’টি মেডেনও ছিল তার। এই কথাটি এ কারণে উল্লেখ্য যে, কেবলমাত্র শহীদ আফ্রিদি এবার সর্বোচ্চ ৩ ওভার মেডেন দিয়েছেন। তারপরই রয়েছেন সাইফুদ্দিন, যার দু’টি ওভার মেডেন। এছাড়া আর কারো একের অধিক ওভারে মেডেন নেই।