“টাকার জন্য সবকিছু করতে রাজি আছি, যেভাবে অন্যরা করছে” কথাটা হাসতে হাসতেই টেন নেটওয়ার্কের ধারাভাষ্যকারদের কাছে বললেন ব্রাড হজ।
সাধারণ দর্শকদের কাছে ক্রিকেট খেলাটা বিনোদনের একটা মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যারা পেশাদার ক্রিকেটার, নিজেদের নেশাকে পেশায় পরিণত করেছে তাদের আয়ের অন্যতম মাধ্যম হলো ক্রিকেট।
৪২ বছর বয়সী ব্রাডলি জন হজের এইবারের বিগ ব্যাশের আসরের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে কোনো দলের সাথে চুক্তির মেয়াদের ইতি ঘটেছে। ব্রাড হজ বিবিএলের ৬ষ্ঠ আসরে অ্যাডিলেড স্ট্রাইকারসের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। অ্যাডিলেড গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলে হজের সাথে অ্যাডিলেডের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
আইপিএলের গত আসরে গুজরাটের হয়ে কোচের দায়িত্ব পালন করা হজ বিগ ব্যাশের ৭ম আসরও অ্যাডিলেডের হয়ে খেলতে চান। অ্যাডিলেড যদি চুক্তি নবায়ন না করে তাহলে অন্য কোনো দলের হয়েও খেলতে চান হজ। বিগ ব্যাশে এর আগে মেলবোর্ন রেনেগেডস এবং মেলবোর্ন স্টার্সের হয়ে খেলেছিলেন তিনি।
বয়সকে শুধুমাত্র একটি সংখ্যায় পরিণত করে বিবিএলের ৬ষ্ঠ আসরে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত সময় অতিবাহিত করেছেন ব্রাড হজ। অ্যাডিলেড স্ট্রাইকারসের অধিনায়ক ৮ ম্যাচে ৪০.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ২৮৬ রান করেছেন তাও আবার ১৩১.১৯ স্ট্রাইক রেইটে।চলতি আসরে তারচেয়ে বেশি রান আছে মাত্র তিনজন ব্যাটসম্যানের। বেন ডাংক, ক্রিস লিন এবং অ্যারোন ফিঞ্চের পর আসরের চতুর্থ সর্বাধিক রান সংগ্রাহক ব্রাড হজ।
বর্তমান ফর্ম বিবেচনায়ও আগামী আসরে নতুন চুক্তি পাওয়ার আশা রাখতেই পারেন তিনি। দলে থাকলে একইসাথে একজন ব্যাটসম্যান, একজন অধিনায়ক এবং একজন কোচের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তার অধীনে থেকে ট্রাভিস হেড এখন জাতীয় দলে খেলছেন, অ্যালেক্স রোজের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান সঠিক পরিচর্যায় নিজেদেরকে মেলে ধরছেন।
যদি কোনো দল তার সাথে চুক্তি নবায়ন না করে তাহলে ব্যাটসম্যান ব্রাড হজের ক্যারিয়ার প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তবে কোচ এবং ধারাভাষ্যকার হিসাবে ক্রিকেটের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে জানিয়েছেন। আইপিএলের নবাগত দল গুজরাটের কোচ হিসাবে প্রথম আসর ভালোমন্দে কাটিয়েছেন। সেইসাথে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে ধারাভাষ্যকারদের সাথে কথা বলার সময় তার ধারাভাষ্যকার হওয়ার সব গুণ দেখতে পেয়েছে টেন নেটওয়ার্কের দর্শকবৃন্দ। তাই তার ব্যাটিং ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলেও ক্রিকেটের সাথে থাকতে সমস্যা হবেনা।
ব্রাড হজ সাধারণ দর্শকদের মধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন বিভিন্ন দেশে যাযাবরের মতো ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি লিগ খেলে। আইপিএল, বিপিএল, পিএসল, সিপিএল হতে শুরু করে সবজায়গার সব ধরনের ঘরোয় ক্রিকেট মাতিয়ে বেড়িয়েছেন ক্যারিয়ার জুড়ে।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার হিসাবে নিজের প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ পায়নি খুব একটা। বলতে গেলে কোনো সুযোগই পাননি ব্রাড হজ। খুব সম্ভবত ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্মেছিলো বলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ হয়ে উঠেনি।
আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগা ক্রিকেটারদের তালিকা প্রকাশ করতে গেলে নিঃসন্দেহে ব্রাড হজের নাম সবার উপরেই থাকবে।
ভিক্টোরিয়ার এই ব্যাটসম্যান ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। সেসময়ে ভিক্টোরিয়ার সেরা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার নাম উচ্চারিত হত। ধারাবাহিক ভালো খেলার পুরস্কার স্বরূপ ২০০৫ সালে অজি জাতীয় দলে ডাক পান হজ, কিন্তু পুরো সিরিজের একটি ম্যাচেও তাকে মূল দলে রাখা হয়নি।
ঐ বছরেই ‘ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ’ পান হজ, নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বেশি সময় নেননি। মাত্র ৫ম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেই সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত ২০৩ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন। তবুও তার টেস্ট ক্যারিয়ার ছিলো মাত্র ৬ টেস্টের, ঐ ৬ টেস্টে ৫৫.৮৮ ব্যাটিং গড়ে ৫০৩ রান করার পরেও আর সুযোগ পাননি। নিজের শেষ টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬৭ এবং ২৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ব্রাডলি জন হজ।
দ্বিশতক হাঁকানোর মাত্র তিন টেস্টের পরেই তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। ঐ মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে ৩৩ গড়ে রান করার কারণে তাকে দলে রাখা হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় তার বদলি সুযোগ পাওয়া ড্যামিয়েন মার্টিনের ঐ মৌসুমে ব্যাটিং গড় ছিলো তেইশের আশেপাশে।
ওডিআইতেও তাকে অল্পতেই ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মাত্র ২১ ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন হজ। এই ২১ ইনিংসের মধ্যে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি সহ ৩০.২৬ ব্যাটিং গড়ে ৫৭৫ রান করেছিলেন তিনি।
২০০৭ সালে সায়মন্ডসের ইনজুরির কারণে দলে সুযোগ পেয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৯ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলেন। ওডি’আই দল থেকে বাদ যাওয়ার ৬ দিন আগে হল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপে ৮৯ বলে ১২৩ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস খেলেছিলেন। তবুও তার দলে সুযোগ না পাওয়াতে ভাগ্যকে দোষ দিতেই পারেন। যখন কঠোর পরিশ্রম করে ভালো খেলার পরেও দলের হয়ে খেলার সুযোগ হয়ে উঠেনা তখন ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।
নিয়তিকে মেনে নিয়ে ২০০৯ সালে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন হজ। ততদিনে তার নামের পাশে ৫১ টি ফার্স্টক্লাস সেঞ্চুরি।
ব্রাড হজ ২২৩ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে সর্বোচ্চ ৩০২ রানের অপরাজিত ইনিংস এবং ৫১ টি সেঞ্চুরি ও ৬৪ টি হাফ-সেঞ্চুরির সাহায্যে ৪৮.৮১ ব্যাটিং গড়ে ১৭০৮৪ রান করেছেন। ২০০৮ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ যাওয়ার পর টি-টুয়েন্টিতে নিজের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন।
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ৪০ বছর বয়সী ব্রাড হজকে আবারো জাতীয় দলে নিতে বাধ্য হয় অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সাথে উড়ে আসেন ব্রাড হজ। বিশ্বকাপের ঠিক আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের দুই আসর মিলিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের নামটি যে তারই ছিলো। ঐ বিশ্বকাপের পর তাকে আর অস্ট্রেলিয়া দলে দেখা যায়নি, ঐ আসরে ২৭.৩৩ ব্যাটিং গড়ে ৮২ রান করেছিলেন লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করে।
ক্রিকেটের আদি পরিসরের ম্যাচ থেকে অবসর নেওয়ার পর টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়েছিলেন হজ। বিশ্বের আনাচে কানাচে সব দেশের ঘরোয়ালীগের পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন তিনি। এখন পর্যন্ত ১৯ টা ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন হজ, সফলতাও পেয়েছেন আকাশচুম্বী। ২৭০ টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচে ৩৬.৮৭ ব্যাটিং গড়ে ৭৩৩৮ রান করেছেন যা টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে ক্রিস গেইলের পর সর্বোচ্চ।
আগামী মৌসুমে কোনো দল তার সাথে চুক্তি না করলে আক্ষরিক অর্থে এই মৌসুমেই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। সময়ের সেরা অব্যবহৃত প্রতিভার ইতি ঘটল, নাকি আবারো ব্যাট হাতে মাঠ মাতাবেন সেটা সময়ই বলে দেবে।