ক্লাব ফুটবলে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নামক এক আসরের দিকে। ইউরোপের সব বাঘা বাঘা ক্লাব এখানে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তাই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচ মানেই ফুটবল ফ্যানদের জন্য আশীর্বাদ। ৩২টি ক্লাব নিয়ে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়া চ্যাম্পিয়নস লিগের সিস্টেম অনেকটা ফুটবল বিশ্বকাপের মতোই। চার দল করে আট গ্রুপে ভাগ হয়ে যাওয়া দলগুলো হোম এবং অ্যাওয়ে ম্যাচের ভিত্তিতে একে অপরের সাথে লড়াই করে। সব ম্যাচ শেষে গ্রুপের সেরা দুই দল যায় পরবর্তী রাউন্ডে। তবে অনেকবারই দেখা গিয়েছে প্রায় বাদ হয়ে যাওয়া দলগুলোও শেষ দুই-এক ম্যাচের চমকে জায়গা করে নেয় পরবর্তী রাউন্ডে। ফোর ফোর টু’র সৌজন্যে আজ আমরা জানবো এমনই কিছু ঘটনা সম্পর্কে।
নিউক্যাসল (২০০২/০৩)
ববি রবসনের নিউক্যাসল প্রিমিয়ার লিগে দারুণ শুরু করলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম তিন ম্যাচেই তারা যথাক্রমে ডায়নামো কিয়েভ, ফেইনুর্ড এবং জুভেন্টাসের সাথে কোনো গোল না করেই হারে।
তবে ম্যাগপাইরা তখনো হাল ছাড়েনি। চতুর্থ ম্যাচে জুভেন্টাসের সাথে অ্যান্ডি গ্রিফিনের গোলে অঘটন ঘটায় নিউক্যাসল। ক্রেইগ বেলামির শেষ মিনিটের গোলে পিছিয়ে থেকেও ইউক্রেন থেকে কিয়েভের সাথে জয় ছিনিয়ে আনে রবসনের দল। জিতে যায় ফেইনুর্ডের সাথেও। আর এরই সুবাদে প্রথম তিন ম্যাচ হেরেও নক আউট পর্বে উঠে রেকর্ড গড়ে নিউক্যাসল ইউনাইটেড।
আর্সেনাল (২০০৩/০৪)
সেই বছরের লিগে অপরাজেয় আর্সেনাল কাকতালীয়ভাবে খাবি খাচ্ছিলো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ গ্রুপ পর্বে। প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতেই হেরে যায় গানাররা, যার মধ্যে ইন্টারের সাথে ৩-০ ব্যবধানে হারও রয়েছে।
চার নাম্বার ম্যাচে এসে অ্যাশলি কোলের ৮৮ মিনিটের গোলে ডায়নামো কিয়েভকে হারিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় আর্সেনাল। সেই আত্মবিশ্বাসে চুরমার হয় ইন্টার মিলান। এমিরেটসে তারা হারে ৫-১ গোলে। আর শেষ ম্যাচে লোকোমোটিভ মস্কোকে ২-০ গোলে হারিয়ে ১০ পয়েন্ট অর্জন করে আর্সেনাল। আর তাতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন নিশ্চিত করেই দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রাখে ওয়েঙ্গারের আর্সেনাল।
লোকোমোটিভ মস্কো (২০০৩/০৪)
আর্সেনালের সাথে সেবার লোকোমোটিভ মস্কোই দ্বিতীয় স্থান দখল করে পরবর্তী রাউন্ড নিশ্চিত করে। তবে আর্সেনালের মতোই প্রত্যাবর্তন করে মস্কো। প্রথম দুই ম্যাচে মস্কোর পয়েন্ট ছিলো ১। সেটিও আর্সেনালের সাথে গোলশূন্য ড্রতে। কিন্তু ইন্টারের সাথে পরবর্তী দুই ম্যাচে মস্কো অর্জন করে চার পয়েন্ট। নিজেদের মাঠে তারা ইন্টার মিলানকে হারায় ৩-০ গোলে। শেষ ম্যাচে আর্সেনালের সাথে হারলেও পঞ্চম ম্যাচে ডায়নামো কিয়েভকে ৩-২ গোলে হারিয়ে আগেই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে মস্কো।
পোর্তো (২০০৩/০৪)
পোর্তো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতবে সেবার তা ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি। কিন্তু স্পেশাল ওয়ান খ্যাত মরিনহো সেই কাজটিই করে দেখিয়েছেন সেবার। তবে তার আগে পোর্তো গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে মুক্তি পায় অল্পের জন্য।
নিজ মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে ৩-১ এ হারার পাশাপাশি প্রথম দুই ম্যাচে পোর্তোর সংগ্রহ ছিলো মাত্র ১ পয়েন্ট। কিন্তু শেষ চার ম্যাচে পোর্তো এক ড্রয়ের সাথে জিতে নেয় বাকি তিনটি ম্যাচ। মার্শেই ও বেলগ্রেডের সাথে জেতার পর রিয়াল মাদ্রিদের সাথে ড্র করে পরবর্তী রাউন্ড নিশ্চিত করে এই পর্তুগিজ ক্লাব।
লিভারপুল (২০০৪/০৫)
গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মোনাকোর সাথে ১-০ গোলে হেরে তালগোল পাকিয়ে ফেলে লিভারপুল। শেষ ম্যাচে অলিম্পিয়াকোসের সাথে ২ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে এই সমীকরণ নিয়ে মাঠে নামে তারা।
কিন্তু শুরুতেই রিভালদোর ফ্রি কিক গোলে পিছিয়ে পড়ে অল রেডরা। দুই মিনিট পরেই অবশ্য সেই গোল শোধ করে দেয় রাফা বেনিতেজের শিষ্যরা। ৮১ মিনিটে নিল মেলোরের গোলে ২-১ গোলে এগিয়ে গেলেও আরেকটি গোল দরকার ছিলো লিভারপুলের। ম্যাচের অন্তিম মূহুর্তে ২৫ গজ দূর থেকে জেরার্ডের দুর্দান্ত ভলিতে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকেট পায় লিভারপুল।
ওয়ের্ডার ব্রেমেন (২০০৫/০৬)
প্রথম পাঁচ ম্যাচ থেকে মাত্র চার পয়েন্ট পাওয়া ওয়ের্ডার ব্রেমেনের প্রয়োজন ছিলো অলৌকিক কিছু। শেষ ম্যাচে প্যানাথিনাইকোসের সাথে জেতার পাশাপাশি দলটিকে তাকিয়ে থাকতে হবে বার্সেলোনা-উদিনেস ম্যাচের দিকেও। সেই ম্যাচে বার্সেলোনার জিততে হবে ৪ গোলের ব্যবধানে। এমন সব সমীকরণ মিললেই উদিনেসকে টপকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করবে ব্রেমেন।
প্যনাথিনাইকোসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের কাজ আগে করে রাখে ওয়ের্ডার ব্রেমেন। বাকি ছিলো বার্সেলোনার কাজ। অলৌকিকভাবে শেষ পাঁচ মিনিটে দুই গোল করে তারাও নক আউট করে দেয় উদিনেসকে। বার্সেলোনার সাথে দ্বিতীয় রাউন্ডের সঙ্গী হয় ওয়ের্ডার ব্রেমেন।
অলিম্পিয়াকোস (২০০৭/০৮)
সেই বছরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে আসা ৩২ দলের মধ্যে অলিম্পিয়াকোসের র্যাংকিং ছিলো শেষের দিক থেকে পাঁচ নাম্বারে। কিন্তু তারপরও রিয়াল মাদ্রিদ, ওয়ের্ডার ব্রেমেন ও লাজিওকে নিয়ে গড়া গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডের টিকেট কাটে অলিম্পিয়াকোস।
ওয়ের্ডার ব্রেমেনের সাথে দুই ম্যাচেই জয় লাভের পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদের সাথে এক ড্রয়ে দ্বিতীয় স্থান নিশ্চিত করে অলিম্পিয়াকোস। রিয়াল মাদ্রিদের পিছে থাকলেও তৃতীয়তে থাকা ওয়ের্ডার ব্রেমেন থেকে তারা এগিয়ে ছিলো পাঁচ পয়েন্টে।
লিভারপুল (২০০৭/০৮)
২০০৫ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল ২০০৭/০৮ মৌসুমে এসে নিজেদের হারিয়ে খুঁজছিলো। মার্শেই, পোর্তো ও বেসিকতাসের সাথে প্রথম তিন ম্যাচে অলরেডদের সংগ্রহ ছিলো মোটে এক পয়েন্ট।
তবে এরপরই ঘুরে দাঁড়ায় লিভারপুল। পরবর্তী ম্যাচে বেসিকতাসের জালে গুনে গুনে আটবার বল পাঠায় লিভারপুল। অ্যানফিল্ডে পোর্তোকে হারায় ৪-১ গোলে। শেষ ম্যাচে মার্শেইকে ৪-০ গোলে হারিয়ে প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে মার্শেইয়ের মাঠ থেকে জয় ছিনিয়ে আনে তারা। পাশাপাশি নিশ্চিত করে দ্বিতীয় রাউন্ডও।
বায়ার্ন মিউনিখ (২০০৯/১০)
প্রথম চার ম্যাচে সেবার বাভারিয়ানরা অর্জন করে মাত্র চার পয়েন্ট। তার উপর হোম এবং অ্যাওয়েতে টানা দুই ম্যাচে হেরে যায় ফরাসি ক্লাব বোর্দোর কাছ। তৎকালীন বায়ার্ন কোচ লুই ভ্যান গালের চাকরি নিয়েও টানাটানি শুরু হয়। জুভেন্টাসের চেয়ে চার পয়েন্ট পিছিয়ে তিন নাম্বারে থাকা বায়ার্নকে শুধু শেষ দুই ম্যাচ জিতলেই হতো না, তাকিয়ে থাকতে হতো অন্য ম্যাচের দিকেও।
ম্যাকাবির সাথে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ১-০ গোল জয়ের পর বাভারিয়ানরা তুরিনে গিয়ে জুভেন্টাসকে হারায় ৪-১ গোলে। আর তাতে ১০ পয়েন্ট নিয়ে জুভেন্টাসকে টপকে গ্রুপের শীর্ষে চলে যায় বায়ার্ন। সেবার লুই ভ্যান গালের দল পৌঁছায় ফাইনাল পর্যন্ত। যদিও মরিনহোর ইন্টারের কাছে হেরে শিরোপা খুইয়েছিলো তারা।
সেল্টিক (২০১২/১৩)
প্রথম তিন ম্যাচে চার পয়েন্ট অর্জন করলেও চতুর্থ ম্যাচে সেল্টিকের প্রতিপক্ষ ছিলো বার্সেলোনা। সেই ম্যাচেই অঘটন ঘটায় তারা। মাত্র ১৬.৪% বলের দখল রেখেও সেল্টিক বার্সেলোনার সাথে জিতে যায় ২-১ গোলে। ভিক্টর ওয়ানইয়ামা ও টনি ওয়াটের গোলে শুরুতেই ২-০ গোলে এগিয়ে যায় সেল্টিক। শেষে মেসির গোলেও হার এড়াতে পারেনি বার্সেলোনা।
তবে গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম ম্যাচে তারা বেনফিকার সাথে হেরে যায়। তাতে বেনফিকা ও সেল্টিকের পয়েন্ট সমান হলেও গোল ব্যবধানে তৃতীয় স্থানে ছিলো সেল্টিক। শেষ ম্যাচে ৮১ মিনিটের পেনাল্টিতে সেল্টিকের জয়ের পাশাপাশি বেনফিকাও হেরে যায় বার্সেলোনার কাছে। আর তাতেই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হয় সেল্টিকের।
ম্যানচেস্টার সিটি (২০১৪/১৫)
আগের দুই আসরে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার শঙ্কা ২০১৪/১৫ মৌসুমে দেখা শুরু করে ম্যানসিটি। প্রথম চার ম্যাচের একটিতেও জয়ের দেখা পায়নি সেবার সিটিজেনরা। এর মধ্যে রয়েছে ইতিহাদে সিএসকে মস্কোর সাথে হারও।
পঞ্চম ম্যাচে জিততেই হবে এমন সমীকরণ সামনে রেখে সিটিজেনরা মুখোমুখি হয় তৎকালীন পেপ গার্দিওলার বায়ার্ন মিউনিখের। সেই ম্যাচে ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকেও আগুয়েরোর শেষ পাঁচ মিনিটে দুই গোলের সুবাদে জিতে যায় ম্যানচেস্টার সিটি। সেই রাতে রোমা ও সিএসকে মস্কোর ম্যাচ ড্র হওয়ায় পয়েন্ট সমান হয়ে যায় ম্যানচেস্টার সিটি ও রোমার। তবে গোল ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলো সিটিজেনরা। শেষ ম্যাচে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে রোমে গিয়ে জাবালেতা ও সামির নাসরির গোলে ২-০ তে জয় নিয়ে ফেরে পেলেগ্রিনির দল। আর তাতেই দ্বিতীয় স্থান নিশ্চিত করে ম্যানচেস্টার সিটি।
আর্সেনাল (২০১৫/১৬)
সেবার গ্রুপ এফ-এ আর্সেনালের সঙ্গী ছিলো বায়ার্ন, ডায়নামো জাগরেব ও অলিম্পিয়াকোস। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই তারা ডায়নামো জাগরেবের সাথে ২-১ গোলে হেরে যায়, যা ছিলো ১৯৯৯ সালের পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এই ক্রোয়েশিয়ান ক্লাবের প্রথম জয়। দ্বিতীয় ম্যাচে দুবার পিছিয়ে থেকে ফিরে এসেও অলিম্পিয়াকোসের সাথে হেরে যায় ৩-২ গোলে। তিন নাম্বার ম্যাচে এমিরেটসে বায়ার্নকে ২-০ গোলে হারিয়ে কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় গানাররা। কিন্তু সেই সুখস্মৃতি মিলিয়ে যায় দ্রুতই। আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ৫-১ এর লজ্জাজনক হার বরণ করে ওয়েঙ্গারের শিষ্যরা।
চার ম্যাচ শেষে আর্সেনালের পয়েন্ট তিন। ডায়নামো জাগরেবের পয়েন্ট ৩ হলেও অলিম্পিয়াকোসের পয়েন্ট ছিলো তখন ৯। পরের ম্যাচে আর্সেনাল জাগরেবকে ৩-০ গোলে হারানোর পাশাপাশি অলিম্পিয়াকোস বায়ার্নের সাথে হেরে যায় ৪-০ গোলে। বাঁচা মরার লড়াইয়ে শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় অলিম্পিয়াকোস ও আর্সেনাল। অলিভিয়ের জিরুডের অনবদ্য হ্যাটট্রিকে অলিম্পিয়াকোসকে টপকে দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে গানার বাহিনী।