শন পোলককে টপকে টেস্ট ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার হিসাবে নিজের নাম লেখাতে আর মাত্র তিন উইকেট প্রয়োজন ডেইল স্টেইনের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে গতকাল (১২ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া শ্রীলঙ্কা সিরিজেই স্টেইনের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিধ্বংসী পেসার ডেইল স্টেইন ১০ বছর ২২৫ দিন সময়ে এবং মাত্র ৮০ ম্যাচে টেস্ট ক্রিকেটে ৪০০ উইকেট শিকার করেছিলেন। ম্যাচের দিক দিয়ে তিনি যৌথভাবে সবচেয়ে দ্রুত ৪০০ উইকেট শিকার করেছেন। মুত্তিয়া মুরালিধরন ৭২ ম্যাচে এবং স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ৮০ ম্যাচে ৪০০ টেস্ট উইকেট শিকার করেছিলেন।
গত তিনবছর ডেইল স্টেইনের ক্যারিয়ার ইনজুরির কারণে থমকে রয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে ৪০০ উইকেট শিকার করার পর তিন বছরে মাত্র ছয়টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ১৭ উইকেট শিকার করেছেন স্টেইন। এখন পর্যন্ত ৮৬ ম্যাচে ৪১৯ উইকেট শিকার করেছেন। আর মাত্র তিন উইকেট শিকার করলেই শন পোলককে টপকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হিসাবে নাম লেখাবেন।
ডেইল স্টেইনের দীর্ঘদিনের অপেক্ষা
২০১৫ সালের ৩০ জুলাই, মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম সেশনে তামিম ইকবালের উইকেট তুলে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের ৪০০তম উইকেট শিকার করেছিলেন ডেইল স্টেইন। ঐ ইনিংসে তিনি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এবং মোহাম্মদ শহীদের উইকেটও শিকার করেছিলেন। মিরপুর টেস্টের শেষ চারদিন বৃষ্টির কারণে বল মাঠে না গড়ালে তিন উইকেট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় স্টেইনকে।
ডেইল স্টেইনের উইকেট সংখ্যা – ৪০২
২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর, স্পিনারদের স্বর্গ মোহালিতে ভারতের বিপক্ষে নিজের পরবর্তী টেস্ট ম্যাচ খেলেন ডেইল স্টেইন। এই ম্যাচে উইকেট শূন্য থাকেন তিনি। তার টেস্ট ক্যারিয়ারের উইকেট শূন্য থাকার ঘটনা মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো ঘটেছিলো এই ম্যাচের মধ্য দিয়ে। মোহালিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। প্রথম ইনিংসে স্টেইন ১১ ওভার বল করে ৩০ রান খরচায় উইকেট শূন্য ছিলেন।
স্টেইন উইকেট শূন্য থাকলেও অনিয়মিত স্পিনার বোলার ডেন এলগার চার উইকেট এবং ইমরান তাহির দুই উইকেট শিকার করলে ভারতের প্রথম ইনিংসে ২০১ রানে গুটিয়ে যায়। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকাও মাত্র ১৮৪ রানে সবক’টি উইকেট হারায়। সফরকারীদের সবকটি উইকেট তুলে নিয়েছিলো ভারতীয় স্পিনাররা। কুঁচকির ইনজুরির কারণে ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংস সহ পুরো সিরিজ থেকেই ছিটকে পড়েছিলেন ডেইল স্টেইন।
দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই স্পিনার হার্মার এবং তাহির চারটি করে উইকেট শিকার করলে ভারত ২০০ রানের বেশি সংগ্রহ করতে পারেনি। প্রথম ইনিংসের লিড সহ দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২১৮ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় ভারত। স্বাগতিকদের স্পিনাররা এই রান দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের জন্য পাহাড়সম করে তোলে। নিজেদের মধ্যে নয় উইকেট ভাগাভাগি করে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১০৯ রানে আটকে রাখে।
ইনজুরির কারণে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ মিস করার পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে ফেরেন ডেইল স্টেইন। ইনজুরি কাটিয়ে ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর বক্সিং ডে টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামেন তিনি। ডারবানে টসে জিতে অধিনায়ক হাশিম আমলা প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন। তার সিদ্ধান্তকে যথাযথ প্রমাণিত করতে ইনিংসে প্রথম সাত ওভারের মধ্যেই কুক এবং হেইলসের উইকেট তুলে নেন স্টেইন। শেষপর্যন্ত ২৫.১ ওভার বল করে ৭০ রানের বিনিময়ে চার উইকেট শিকার করেন তিনি।
প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ৩০৩ রানের জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ২১৪ রান সংগ্রহ করেছিলো। যার মধ্যে ওপেনার ডেন এলগার ১১৮ রান করে অপরাজিত থাকেন। প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে বল করতে নেমে বড় ধরনের ধাক্কা খায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ডেইল স্টেইন ৩.৫ ওভার বল করার পর কাঁধের ইনজুরির কারণে মাঠ ত্যাগ করেন। কাঁধের ইনজুরির কারণে প্রায় আট মাস মাঠের বাহিরে ছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত ইংল্যান্ড ২৪১ রানের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
ডেইল স্টেইনের উইকেট সংখ্যা – ৪০৬
২০১৬ সালের ১৯ আগস্ট, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডারবানেই পুনরায় টেস্ট ক্রিকেটে ফেরেন ডেইল স্টেইন। মাঠে ফিরে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে ছয় ওভারে মাত্র তিন রানের বিনিময়ে দুই উইকেট শিকার করে ক্রিকেট বিশ্বকে জানান দেন তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি।
সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ডেইল স্টেইন আরও বেশি ভয়ংকর ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ৬৬ রানের বিনিময়ে তিন উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৩৩ রান খরচায় পাঁচ উইকেট শিকার করেন তিনি। স্টেইনের বোলিং নৈপুণ্যে সেঞ্চুরিয়ান টেস্টে নিউজিল্যান্ডকে ২০৪ রানে পরাজিত করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
ডেইল স্টেইনের উইকেট সংখ্যা – ৪১৬
কাঁধের ইনজুরি থেকে ফিরে এসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত বল করে খোশমেজাজে ছিলেন ডেইল স্টেইন। ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর পার্থে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামার আগে ডেভিড ওয়ার্নার এবং স্টিভেন স্মিথের উইকেট শিকার করতে চান বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। তবে শুধুমাত্র ওয়ার্নারের উইকেটই নিজের দখলে আনতে পেরেছিলেন।
পুরো ম্যাচেই ডেইল স্টেইন বেশ উজ্জীবিত ছিলেন। নিজের ১২.৪ ওভার বল করার সময় মাঠে পড়ে যান। মাঠ থেকে উঠার সময় ডান কাঁধ ধরে উঠেন। এই ইনজুরির সারাতে সার্জারি করতে হয়। পুরোপুরিভাবে সুস্থ হতে ১৩ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ডেইল স্টেইনকে। এই সময়ে মাঠে ফেরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
ডেইল স্টেইনের উইকেট সংখ্যা – ৪১৭
প্রায় ১৩ মাস মাঠের বাহিরে থাকার পর স্টেইনের ক্যারিয়ারের ইতি দেখে ফেলেছিলেন অনেকেই। তবে তিনি থেমে যাননি। ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামেন স্টেইন। নিজের তৃতীয় ওভারেই শিখর ধাওয়ানের উইকেট তুলে নেন তিনি। এরপর ঋদিমান শাহার উইকেটও শিকার করেন স্টেইন। দীর্ঘদিন পর মাঠে ফেরার পরেও ইনজুরি তার পিছু ছাড়েনি। প্রথম ইনিংসে ১৭.৩ ওভার বল করার পর তার পা খুব বাজেভাবে মাটিতে পড়ে। যার ফলে গোড়ালির ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন স্টেইন। এই ইনজুরিতে আরও ছয় মাস মাঠের বাহিরে বসে থাকতে হয় তাকে।
ডেইল স্টেইনের উইকেট সংখ্যা – ৪১৯
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার লক্ষ্যে গত মাসে হ্যাম্পশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলেন ডেইল স্টেইন। জুন মাসে তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে ১০২ ওভার বল করেছিলেন, গত দুই বছরে টেস্ট ক্রিকেটে এর থেকে ২৯.৩ ওভার কম বল করেছিলেন তিনি। কাউন্টি ক্রিকেটে এই মৌসুমে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেন সমারসেটের বিপক্ষে। ম্যাচটি তার জন্য সুখকর ছিলো না। লিস্ট-এ ম্যাচে ১০ ওভার বল করে ৮০ রানের বিনিময়ে এক উইকেট শিকার করেছিলেন।
সারির বিপক্ষে মৌসুমের প্রথম প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এক ইনিংসে বল করার সুযোগ পান তিনি। তার দল ইনিংস ব্যবধানে পরাজিত হলে দ্বিতীয় ইনিংসে বল করার সুযোগ হয়নি তার। প্রথম ইনিংসে ২৬ ওভার বল করে ৯১ রানের বিনিময়ে দুই উইকেট শিকার করেছিলেন।
লিস্ট-এ ক্রিকেটে নিজের পরবর্তী ম্যাচেই ছন্দ ফিরে পান স্টেইন। ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে সাত ওভার বল করে ৩৪ রান দিয়ে এক উইকেট শিকার করেছিলেন। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ২৯ ওভার বল করে ৬৬ রান খরচায় পাঁচ উইকেট শিকার করে জানান দেন তিনি শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
ডেইল স্টেইন ক্রিকইনফোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
একশোটি টেস্ট ম্যাচ খেলা বিস্ময়কর এবং পাঁচশো টেস্ট উইকেট অবিশ্বাস্য!
একশো টেস্ট ম্যাচ খেলতে হলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি টেস্ট এবং ঘরের মাঠে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলার পর ২০১৯-২০২০ মৌসুমে কমপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচ খেলতে হবে স্টেইনকে। পাঁচশো উইকেট শিকার করতে হলে এখনও ৮১ উইকেট প্রয়োজন স্টেইনের, তবে শন পোলককে টপকাতে প্রয়োজন মাত্র তিন উইকেট।
ফিচার ইমেজ : Getty Images