চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল: গার্দিওলা-টুখেল দ্বৈরথের কৌশলগত ব্যবচ্ছেদ

যেকোনো ক্লাসে এমন কিছু শিক্ষার্থী থাকে যারা ক্লাসের সিলেবাস সম্পর্কে আগাগোড়া খুব ভালো করে জানে। পরীক্ষায় এদের কোনো সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু সিলেবাসের আগাগোড়া শেষ করেও তারা পরীক্ষার হলে বসে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। এই তালগোল পাকানোর পেছনে অন্যতম কারণ থাকে সব পারা সত্ত্বেও পরীক্ষা নিয়ে অতিশয় চিন্তা। 

সবকিছু জানার পরও পরীক্ষার হলে গিয়ে সবকিছু গুবলেট করে ফেলা এমন একজন শিক্ষার্থীর সাথে ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলার উদাহরণটা বেশ ভালো যায়। সেই বার্সেলোনা থেকে বিদায় নেবার পর বায়ার্ন মিউনিখ ঘুরে ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে প্রায় ১০ বছর কাটিয়ে দিলেও তার অর্জনের ঝুলিতে একটিও চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি যোগ হয়নি। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রত্যেকবার থমকে যেতে হয় তার চ্যাম্পিয়নস লিগের যাত্রা। চ্যাম্পিয়নস লিগে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার পেছনে তার যেমন অবদান, তেমনই হেরে বাদ পড়ার পেছনেও তার দোষ কম নয়। 

এই শিরোপা কী আর জেতা হবে না? Image Source: Reuters

গার্দিওলা সাধারণত পাসিং ফুটবল খেলান। ম্যাচ হারুক বা জিতুক, তার দলের পজেশন থাকে সবসময় বেশি। স্পেন ও জার্মানি ঘুরে এই পাসিং ফুটবল খেলিয়ে সুনাম অর্জন করে তিনি যখন ইংল্যান্ডে কোচিং করাতে আসলেন, অনেকেই মতামত দিয়েছিল তার এমন ফুটবল কৌশল প্রিমিয়ার লিগে টিকবে না। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে গার্দিওলা ঠিকই রাজত্ব করেছেন প্রিমিয়ার লিগে। পাসিং ফুটবল ঠিক থাকবে, ওয়ান টাচে বল পাস করতে হবে, আর এর সাথে খানিকটা গতি। এই টোটকা দিয়েই তিনি তার ফুটবল কৌশলকে আমূল বদলে দিলেন। 

গার্দিওলা বর্তমান ইউরোপের অন্যতম সেরা ফুটবল ট্যাকটিশিয়ান, যিনি তার নিজস্ব কৌশল নিয়েই কাটাছেঁড়া করতে পছন্দ করেন। কৌশল পাল্টে বা নতুন কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে তিনি কেমন ওস্তাদ – তার প্রমাণ মিলেছে সদ্য শেষ হওয়া প্রিমিয়ার লিগেই। পুরো মৌসুম তিনি তার দলকে খেলিয়েছেন স্ট্রাইকার ছাড়া। স্ট্রাইকার ছাড়া খেলে কৌশলগতভাবে কীভাবে লিগ জেতা যায়, তা তিনি হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়েছেন। চলতি বছর তার অন্যতম কৌশলগত পরিবর্তন ছিল নির্দিষ্ট কোনো টার্গেটম্যান না থাকা। ডি ব্রুইনা, মাহরেজ, গুন্ডোগানদের ভেতর একেক সময়ে একেকজনকে ফলস নাইন হিসেবে রেখে ক্রমাগত টার্গেট ম্যানকে রোটেশন করেছেন। এজন্য প্রতিপক্ষ প্রায় সময়ই বুঝে উঠতে পারেনি, স্ট্রাইকারের ভূমিকায় আসলে কে খেলছে! চ্যাম্পিয়নস লিগের যাত্রাও একই কৌশলে দারুণভাবে চলছিল। কিন্তু কৌশলগত দিক নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাই আবার ফাইনাল ম্যাচে কাল হয়ে দাঁড়াল। 

পেপ গার্দিওলার ৪-৩-৩ ফর্মেশনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মধ্যমাঠে থাকা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। তার কাজ মধ্যমাঠেই প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দিয়ে বল জিতে নেওয়া। একই সাথে মধ্যমাঠ থেকেই সে বল পৌছে দেয়া আক্রমণভাগে থাকা খেলোয়াড়ের পায়ে। বার্সেলোনায় থাকতে এই পজিশনে খেলে সফল হয়েছিলেন সার্জিও বুসকেটস। সিটিজেনদের দলেও এ পজিশনে খেলার জন্য উপযুক্ত দু’জন ফুটবলার ছিলেন, স্ট্রাইকারবিহীন একাদশে যারা পুরো মৌসুমে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু ফাইনালের মঞ্চে এসে প্রতিপক্ষের একটি নির্দিষ্ট দিকের কথা ভেবে গার্দিওলা আবার চিন্তা করতে বসলেন। এই চিন্তার ফসল কোনো বল-উইনার না মিডফিল্ডার নামানো। আপতদৃষ্টিতে এই কৌশলগত ব্যবচ্ছেদই সিটিজেনদের ফাইনাল হারার অন্যতম কারণ।

ফার্নান্দিনহো থাকলে ম্যাচের ফলাফল কি ভিন্ন হতে পারত? Image Credit: Rui Vieira

টমাস টুখেল চেলসির কোচের চেয়ারে বসার পর চেলসির অনেক দিকে উন্নতি হলেও তাদের আক্রমণভাগের ভেতর চূড়ান্ত মাত্রার রসায়ন এখনও গড়ে ওঠেনি। এর কারণ, একটি দলকে নিজের ফুটবল দর্শনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে যে সময়ের প্রয়োজন হয়, সেটা টুখেল এখনও পাননি। আর চেলসির আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা এখনও দলে প্রায় নতুন। এজন্যই হার্ভাজ, মাউন্ট বা ভের্নাররা যখন একইসাথে আক্রমণে এগিয়ে যান, তখন মাঝে মাঝেই তাদের ভেতর আক্রমণের সুর কেটে যায়; অথবা আক্রমণ হয় কিছুটা ধীর গতির।

আপাতদৃষ্টিতে খেলোয়াড়দের ভেতর এই রসায়নের অভাব সেভাবে বড় কোনো সমস্যা তৈরি না করলেও এই বিষয়টি গার্দিওলার দৃষ্টি কেড়েছিল। এ জন্যই হয়তো তিনি চেয়েছিলেন কোনো বল উইনার মিডফিল্ডার না রাখতে। কারণ মধ্যমাঠে তিনি যদি একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না রাখেন, তবে একজন অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় তিনি পেয়ে যাচ্ছেন। এজন্য সিলভা ও ডি ব্রুইনাকে দুইপাশে রেখে তিনি মাঝে খেলালেন গুন্ডোগানকে। আর সবাইকে চমকে দিয়ে একাদশে ফিরলেন রাহিম স্টার্লিং। তার অত্যধিক গতির কারণে রক্ষণ উন্মুক্ত হয়ে যাবার আশঙ্কায় লেফট ব্যাক পজিশনে ম্যাচ শুরু করলেন জিনচেঙ্কো।

ইনজুরিতে পরে চোখের পানিতে মাঠ ছেড়েছেন কেভিন ডি ব্রুইনা;  Image Source: Reuters

গার্দিওলা প্রথম ভুল করলেন এখানেই। তার দলে ফার্নান্দিনহো বা রদ্রি কোনোমতেই ম্যাকলেলে বা ইয়াইয়া তোরের পর্যায়ের খেলোয়াড় নন। কিন্তু তারা জানেন একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে কীভাবে খেলতে হয়। গার্দিওলা এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের কিছু দায়িত্ব দিলেন জার্মান মিডফিল্ডার গুন্দোগানকে। কিন্তু মাঝমাঠের একজন বল উইনারের কেমন দায়িত্ব, সেটা তো আর গুন্দোগানের জানার কথা নয়। পুরো ম্যাচে গুন্দোগান তাই চেলসির মিডফিল্ড সামাল দেওয়া বা আক্রমণে সাহায্য করা – কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারলেন না। 

গার্দিওলা চেলসির তুলনামূলক দূর্বল দিক নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেও তাদের সব থেকে শক্তিশালী দিক নিয়ে সেভাবে চিন্তাই করেননি। টুখেল পিএসজি ছেড়ে ব্লুজদের দায়িত্ব নেবার পর এই দলে সব থেকে বড় উন্নতি হয়েছে রক্ষণভাগে। ৩-৪-৩ বা ৩-৪-২-১ ফর্মেশনে তারা আক্রমণ একদম নিচ থেকে শুরু করে, যেখানে অংশ নেন গোলরক্ষক মেন্ডিও। বিপরীতে প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময় তারা ৫ জনের যে রক্ষণদূর্গ তৈরি করে, বর্তমানে তা ভেদ করা অন্যতম শক্ত কাজ।

টুখেলের আরও একটি সহজ কৌশল গার্দিওলার চোখে পড়েনি। দলে ডাবল পিভট হিসেবে খেলা কান্তে ও জর্জিনহো বল পায়ে দুর্দান্ত। তারা মাঝেমাঝেই নিচে নেমে এসে রক্ষণভাগের কাছাকাছি চলে আসে। এতে করে ডিফেন্ডারদের পাস দেবার জন্য আর বেশি সুযোগ তৈরি হয়। এজন্য এভাবে যখন চেলসি আক্রমণে যেতে থাকে, প্রথাগত ম্যান মার্কিং করে তাদের আটকানো সম্ভব না। এছাড়াও সমস্যার নাম এন’গোলো কান্তে ও মেসন মাউন্ট। মাউন্ট ‘ইন বিটুইন দ্য লাইনে’ ফরোয়ার্ড পাস দিতে ওস্তাদ। বিপরীতে কান্তে যেন পুরো চেলসির মস্তিষ্ক।

ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকে উভয় দল তাদের নিজস্ব কৌশলে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু প্রথম ২০ মিনিটের আক্রমণ থেমে গেছে উভয়ের রক্ষণভাগের সামনে। তবে সিটিজেনদের থেকে চেলসি প্রথম মিনিট থেকেই আক্রমণের সফলতার দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল। ম্যানচেস্টার সিটির মধ্যমাঠে প্রায় সবাই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। তাই রক্ষণের দিক থেকে তারা সেভাবে সহায়তা করতে পারেনি। আবার একই সাথে আক্রমণে গিয়ে তারা বারবার চেলসির জন্য শূন্যস্থান তৈরি করে দিয়ে আসছিল, যে ফাঁকা স্থানে গতির ঝড় তুলেছেন মাউন্ট ও কান্তে। 

কী দুর্দান্ত পাস! Image Source: Twitter

ফাইনাল ম্যাচে গার্দিওলার মূল কৌশল ছিল আক্রমণ শানিয়ে যাওয়া – উইং এবং মাঝমাঠের যেকোনো দিক থেকে। ফলস নাইন ভূমিকায় মূলত ছিলেন ডি ব্রুইনা। যদিও মাঝে মাঝে এ ভূমিকায় দেখা গেছে সিলভাকেও। তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি, গার্দিওলার এই টোটকাকে একেবারে গুড়িয়ে দিয়েছেন কান্তে। আর যে কয়েকটি আক্রমণ ব্লুজদের রক্ষণভাগ পর্যন্ত এসেছিল, তা থমকে গেছে রুডিগার ও সিলভার সামনেই।

পুরো ম্যাচে রাহিম স্টার্লিং চেষ্টা করে গেছেন সাইডলাইন বরাবর থাকার জন্য, যাতে তার গতিকে কাজে লাগিয়ে উইং দিয়ে কাট-ইন করে চেলসির ডি-বক্সে ঢোকা যায়। তবে এ কাজ করতে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন চেলসির উইং-ব্যাক রিস জেমসের কারণে। স্টার্লিং মাঠে ছিলেন ৭৫ মিনিটের মতো, এর অধিকাংশ সময় তিনি ছিলেন জেমসের পকেটে।

কান্তে ছিলেন মাঝমাঠের প্রাণ; Image Source: Reuters

এবার ম্যাচে হওয়া একমাত্র গোলের মুহূর্তে আসা যাক। এই গোলটা যতটা সিটির খেলোয়াড়দের ভুল, তার থেকেও বেশি মেসন মাউন্টের পায়ের জাদুর ঝলকানি। গোলটার শুরু হয়েছিল একদম মাঠের মাঝামাঝি অংশ থেকে, যেখানে প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময় একজন বল-উইনার মিডফিল্ডার তার দলের বাকি দুই ডিফেন্ডারের সাথে নিয়ে তিনজনের রক্ষণদেয়াল তুলে আক্রমণ রুখে দেবার চেষ্টা করেন। মেসন মাউন্ট যখন বল পেয়েছিলেন, তাকে মার্ক করার মতো কোনো মিডফিল্ডার তার কাছে ছিল না। তার সামনে ছিলেন দিয়াজ ও স্টোনস। মাউন্ট বল হার্ভাজকে পাস দেবার আগেই ভার্নার দিয়াজকে টেনে তার দিকে নিয়ে নিয়েছিলেন। হার্ভাজের সামনে একমাত্র স্টোনস থাকায় ইন বিটুইন দ্য লাইনে পাস দিতে মাউন্টের কোনো সমস্যাই হয়নি।

ডি ব্রুইনার ইনজুরির পর গার্দিওলা একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার নামিয়েছিলেন। পুরো ৪৫ মিনিট নিষ্প্রভ থাকা সিলভাকে উঠিয়ে ফার্নান্দিনহোকেও নামিয়েছিলেন মাঝমাঠে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

টুখেল আধুনিক ফুটবলে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলায় নতুন এক মাত্রা যোগ করেছেন। প্রথমার্ধ ছিল প্রতিপক্ষের দুর্বল দিককে কেন্দ্র করে গতিশীল ফুটবলের প্রদর্শন। আর দ্বিতীয়ার্ধ ছিল ৫-৩-২ ফর্মেশনে খোলসে ঢুকে আর্দশ রক্ষণাত্মক ফুটবল। পাঁচজন ডিফেন্ডারের জমাট রক্ষণ এবং কান্তে-জর্জিনহোর নিচে নেমে আসার সেই পরিখা হাজার চেষ্টা করেও গার্দিওলার দল ভেদ করতে পারেনি। নিজেদের ডি-বক্সে তারা এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে সিটির আক্রমণে চেলসি গোলরক্ষক মেন্ডিরও তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। 

এই গোল আর কে ঠেকাবে? Image source: AS

তবে ফাইনালের মঞ্চে এসে এই হার কি সম্পূর্ণ গার্দিওলার অতিরিক্ত চিন্তার ফসল? হয়তো না। ফাইনালের মতো ম্যাচে মাহরেজ, স্টার্লিং ও সিলভারা আক্রমণে আরও একটু ঝড় তুলতে পারতেন। অথবা স্টোনস-জিনচেঙ্কো এভাবে নিভে না গিয়ে পাল্লা দিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু কয়েকজন খেলোয়াড়ের সেরাটা দিতে না পারা থেকে গার্দিওলাই যেন সিটিজেনদের ফাইনাল হারার অন্যতম বড় আক্ষেপ হিসেবে থেকে যাবে। তিনি কি পারতেন না পিএসজির বিপক্ষে খেলা ঐ একাদশকে নামাতে? অথবা পুরো মৌসুমজুড়ে ব্যবহার করা ট্যাকটিক্সই প্রয়োগ করতে? টুখেল যেমন নিজের স্থান থেকে একদম সেরাটা কৌশলটি প্রয়োগ করেছেন, গার্দিওলা কি পারতেন না এমন কিছু করতে? 

মুদ্রার দুই পিঠ ; Image Source: Reuters

 

প্রশ্ন অনেক, উত্তর নেই। গার্দিওলা ইউরোপের অন্যতম সফল কোচ হলেও এই ফাইনাল ম্যাচ তাই অনেকগুলো শিক্ষা একবারে দিয়ে গেল। পুরো মৌসুমজুড়ে যে কৌশল কাজে লেগেছে, ফাইনাল বা অর্জনের মঞ্চের শেষ পর্যায়ে এসে সে কৌশল থেকে সরে আসার পরিণাম কী হতে পারে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল টুখেলের চেলসি। গার্দিওলা এবার সেটা দ্রুত অনুধাবন করতে পারলেই তার এবং ক্লাবের জন্য ভালো।

This article is in the Bangla language. It is about the UCL 20/21 final match versus Manchester City and Chelsea. This article also explains the overall tactics of both teams.

Feature Image: Reuters

Background Image Credit: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version