সেলিব্রেশন যেকোনো খেলারই অংশ। একজন খেলোয়াড় তার খেলার কোনো বিশেষ মুহূর্তের খুশিতে এই উদযাপন করে থাকেন। অনেক খেলোয়াড়ের নিজস্ব ইউনিক স্টাইল আছে এইসবের জন্য। তাদের এই সিগনেচার সেলিব্রেশনগুলো তাদের প্রচারেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। তবে এই সেলিব্রেশনগুলোর মধ্যে এমন অনেক সেলিব্রেশন আছে, যেগুলো খেলোয়াড়কে আলোচনায় তোলার পাশাপাশি অনেক সমালোচিত করে। অনেক খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারেও প্রভাব ফেলেছে সেলিব্রেশন। কয়েকজনের তো ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে গেছে! আজকে এইরকম কিছু বিতর্কিত গোল সেলিব্রেশন নিয়েই কথা হবে।
পাউলো ডিয়েগো
সুইস ফুটবল খেলোয়াড় পাউলো ডিয়েগো তখন খেলতেন সেই দেশের প্রিমিয়ার লিগের সারভেট এফসির হয়ে। সেখানে ২০০৪ সালে সাফথাউসেনের বিপক্ষের একটি ম্যাচে বল নিয়ে গোলকিপার পর্যন্ত পৌঁছে শুট না করে পাশেই পাস করে দেন তার টিমমেট জিন বিউসেজুরের কাছে। সেখান থেকে তার অ্যাসিস্টে বলা যায় ফাঁকা বারে বিউসেজুর গোল করেন। এরপর তারা একদম সাধারণ সেলিব্রেশন করতে যান। কিন্তু কেন যেন কী একটা ভূত ঢোকে ডিয়েগোর মাথায়।
তিনি অন্য টিমমেটদের সাথে না গিয়ে একা যান গোলবারের পিছনে দর্শকদের কাছে। মাঠ আর গ্যালারির মধ্যে যে উঁচু লোহার ব্যারিকেড ছিল, সেটায় উঠে পরেন। দর্শকদের সাথে অল্প সেলিব্রেশন করে লাফ দিয়ে নেমে যান। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।
কিন্তু নামার পরে দেখেন, তার বাম হাতের অনামিকার আঙ্গুলটির অর্ধেকের বেশি নেই। কি হলো সেই আঙ্গুলের?
ডিয়োগো যখন খেলতে নামেন, তখন তার ঐ আঙ্গুলে তার বিয়ের আংটিটি পড়া ছিল। তিনি যখন সেলিব্রেশন করতে সেই ফেন্সের উপরে উঠেন, তখন কোনোভাবে তার ঐ আংটিটি ফেঞ্চের লোহার শিকে আটকিয়ে যায়। ফলে তিনি যখন লাফ দিয়ে নামেন, টান খেয়ে তার আঙ্গুলটিই ছিড়ে যায়। তার ঐ আঙ্গুলের ফ্যালাঞ্জেসের উপরের দুই খণ্ডই পড়ে যায়!
এইখানে আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল, রেফারি এই কান্ডের জন্য তাকে হলুদ কার্ড দেখায়। সেলিব্রেশনে বাড়তি সময় খরচ করে সময় নষ্ট করেছিলেন, এজন্যই মূলত রেফারি তাকে এই শাস্তি প্রদান করেন।
জুরিখের হাসপাতালের ডাক্তাররা চেষ্টা করেছিলেন অবশ্য তার এই ছেঁড়া আঙুল আবার জোড়া লাগানোর। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
পল গাসকোয়েন ডেন্টিস্ট চেয়ার সেলিব্রেশন
গাসকোয়েন বা ছোট করে ‘গাজ্জা’ ছিলেন ওই সময়ের ইংল্যান্ডের প্রডিউস করা বেস্ট ট্যালেন্ট। পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই সবসময় একের পর এক কাহিনী ঘটিয়ে সবসময়ই স্পটলাইটে ছিলেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
এইখানের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ইউরোতে, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচে। এই টুর্নামেন্টটি ছিল ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হওয়া সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। সেই হিসেবে ইংল্যান্ডের সেই দলটির উপর সবারই কিছু ভাল আশা ছিল। তো, সেখানে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বক্সে লং বল পেয়ে গাজ্জা সেটি বাম পা দিয়ে ফ্লিক করে কলিন হেন্ড্রির মাথার উপর দিয়ে পার করে ডান পায়ে দুর্দান্ত শটে সেটি জালে জড়িয়ে দেন। এরপর দৌড়ে স্কটল্যান্ডের টাচলাইনে গিয়ে শুয়ে পড়েন। সেখানে তার টিমমেট তার গলায় পানি ঢেলে দেন।
এখন এই সেলিব্রেশনে সমস্যা কী ছিল?
এই ইউরোর আগে ইংল্যান্ডে একটি প্রি-টুর্নামেন্ট ট্যুর ছিল হংকংয়ে। তো সেখানে খেলাগুলো শেষ হওয়ার পরে ইংল্যান্ডের কোচ টেরি ভেনাবলস প্লেয়ারদের পাশের একটি বারে গিয়ে ড্রিংক করার অনুমতি দেন। সেখানে কথা ছিল, অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচ ব্রায়ান রবসন তাদেরকে দেখে রাখবেন। তো সেখানে যাওয়ার পর অনেকদিন পর সুযোগ পেয়ে সবাই কয়েক পেগ মেরে দেয়। আর সেখানে ব্রায়ান রবসন যখন গ্লাস হাতে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন কেউ একজন গিয়ে তার শার্টটি পুরোপুরি ছিড়ে ফেলে। খালি গায়ে তার গলায় শুধু কলারটি ঝুলছিল। কিন্তু তখনও তিনি ভাবলেশহীন ছিলেন। তাকে এই মাতাল অবস্থায় দেখার পরই প্লেয়াররা কন্ট্রোলের বাইরে গিয়ে ড্রিংক করা শুরু করে। হঠাৎ একজন খেয়াল করেন, পাশের রুমে ডেন্টিস্ট চেয়ার রয়েছে। বারে ডেন্টিস্ট চেয়ার হলো এমন ব্যাপার, যেখানে কাস্টমার চিৎ শুয়ে থাকবে আর বারটেন্ডার বিয়ার ঢেলে দিবে। এটি দেখে সবার আগে সেখানে গিয়ে চড়ে বসেন গাজ্জা , এরপরে একে একে ইয়ান ওয়াকার ও টেডি শেরিংহ্যাম। এবং এরপর… বলা যায় সবাই। বাকি পুরো সময়টাতেই সবার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ।
সেখানে থাকা অন্য মানুষদের চোখে ঘটনা এড়ায়নি। তারা তাদের ক্যামেরা দিয়ে ইংলিশ টিমের এই অবস্থার ছবি তুলে নেয়। সেটি পরে পত্রিকাওয়ালাদের হাতে চলে যায়। এই আগুনে ঘি ঢালে আরেকটি ঘটনা। ইংল্যান্ডে ফিরতি প্লেনে কেউ একজন অনাহূতভাবেই সিটের সাথে অ্যাটাচড টিভি স্ক্রিন ভেঙে ফেলেন। তো একটা পত্রিকা নিউজ করে এটি নিয়ে এই ক্যাপশনে,
“Drunken hooligans out of control”
পুরো ইংল্যান্ডেই সমালোচনার ঝড় উঠে, মূল আঙ্গুল তোলা হয় গাজ্জার দিকেই। দাবি তোলা হয় দলের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তাকে দল থেকে বহিস্কার করতে। কিন্তু ইংল্যান্ড টিম তাকে বাদ দেয়নি, উলটো প্লেয়াররা নিজেরা হোটেলে প্ল্যান করে এই নিয়ে। তারা ঠিক করে, গাজ্জা ম্যাচে গোল করলে এই ইন্সিডেন্সকে রেফার করে সেলিব্রেট করবে।
গাজ্জার গোল পাওয়া ম্যাচটা ছিল স্কটল্যান্ডের সাথেই। প্রথম ম্যাচে ‘দুর্বল’ সুইসদের সাথে ড্র করার পর এমনিতেই চাপে ছিল তারা। অ্যালান শিয়েরারের হেডে শুরুতেই এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। স্কটিশদের সুবর্ণ সুযোগে বামহাত ঢোকান টনি অ্যাডামস। এরপর আবার গ্যারি ম্যাকঅ্যালিস্টারের পেনাল্টি ফিরিয়ে দেন ডেভিড সীম্যান। এরপর গাজ্জা যখন স্কোর দ্বিগুন করেন, তখন ইংল্যান্ডের সেই সেলিব্রেশনের সুযোগটি আসে। সঠিক সময়ে একটি পানির বোতলও স্কটিশদের গোলপোস্টের পাশেই ছিল। শুয়ে থাকা গাজ্জার মুখে একে একে পানি ঢেলে দেন জেমি রেডন্যাপ, ম্যাকমানামান, ও শিয়েরার। ‘খলনায়ক’ থাকা গাজ্জা হঠাৎ বনে যান মাঠের হিরো। ইংল্যান্ড সেই টুর্নামেন্ট শেষ করে সেমিফাইনালে গিয়ে।
তবে পরবর্তীতে গাজ্জার ক্যারিয়ার সেভাবে আগায়নি। এই মাদকের জীবনটাকেই তিনি প্রায় ফুটবলের উপরে উঠিয়ে নেন। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলে ইংল্যান্ডের ‘ওয়ান অফ দ্য বেস্ট’ প্রতিভাসম্পন্ন খেলোয়াড়টিকে কিছুটা আগেভাগেই ক্যারিয়ার গুটিয়ে নিতে হয়।
রবি ফাউলার: কোকেইন স্নোর্টিং
ইংল্যান্ডের মার্সিসাইডের দুই রাইভাল ক্লাব লিভারপুল ও এভারটন। এভারটন অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও যেকোনো ডার্বির আগেই দুই দলের মধ্যে ভালোই উত্তেজনা দেখা যায়। ১৯৯৯ সালের এইরকম একটি ডার্বিতে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। সেই ম্যাচের এক পর্যায়ে পেনাল্টি পায় লিভারপুল, এগিয়ে আসেন রবি ফাউলার। সেখান থেকে সুন্দরভাবে বলটিকে জালে জড়িয়ে দেন তিনি। গোল করেই হঠাৎ সীমানা রেখায় উবু হয়ে বসে পড়েন। মুখ মাটিতে লাগিয়ে একটু সামনে আগান সেই অবস্থাতেই। তখন তার সতীর্থ আরেক লিভারপুল লিজেন্ড স্টিভ ম্যাকমানাম্যান তাকে টেনে তোলেন। সেই সেলিব্রেশনটি ফাউলার ১ বার নয়, সেখানেই ২ বার করেন।
ম্যাচের পরে লিভারপুলের তৎকালীন ম্যানেজার জেরার্ড হাউলিয়ারকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ফাউলারের সেই সেলিব্রেশনটি ছিল ক্যামেরুনের ঐতিহ্যবাহী ‘ঘাস-খাওয়া’ সেলিব্রেশন – যেটা রবি তার আরেক ক্যামেরুনিয়ান টিমমেট রিগোবার্ট সংয়ের কাছে শিখেছিল। কিন্তু ঘটনা আসলে ছিল রবি সেখানে সীমানা লাইনের সাদা দাগ ধরে নাক দিয়ে কোকেন সেবনের মতো করে অভিনয় করছিলেন, তাও একদম প্রায় মাদকসেবীদের মতো নাকের একটি ফুটো একদম চেপে ধরে।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছুদিন যাবতই এভারটন ফ্যানরা দাবি করছিল যে ফাউলার মাদকসেবী। তো গোলের পরে তাদের কথার জবাব দিতেই এমনটি করেন। ইনভেস্টিগেশনে ফাউলার এমনটিই বলেন এফএ-কে। তাই কোচ হাউলিয়ার ফাউলারকে বাঁচানোর চেস্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে স্টিভ ম্যাকমানাম্যানকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলেন যে হাউলিয়ার কোন জায়গা থেকে এমন এক্সপ্লানেশন এনেছিলেন, তা তার জানা নেই।
এ ঘটনায় ফাউলারকে ৪ ম্যাচ নিষিদ্ধ ও সাথে ৬০,০০০ পাউন্ড জরিমানা করা হয়।
জিওরজর কাতিদিস: নাৎসি স্যালুট
ঘটনাটি ২০১৩ সালের। এথেন্সের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে গ্রিক ফুটবল লিগের ম্যাচে মুখোমুখি হয় এইকে এথেন্স আর ভিয়েরা। ১-১ গোলে সমতা থাকা অবস্থায় তরুণ মিডফিল্ডার কাতিদিসের গোলে জয়ের দেখা পায় এথেন্স। কিন্তু গোল উদযাপনের সময় কাতিদিজ ডান হাত উঁচিয়ে এমন অঙ্গভঙ্গি করেন, যেটা অনেকটা নাৎসিদের স্যালুট “হেইল, হিটলার”এর মতো।
ব্যাপারটি গ্রিক ফুটবল ফেডারেশন মোটেই ভালোভাবে নেয় নি। তারা এটিকে নাৎসি বাহিনীর শিকারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অপমান হিসেবে দেখে। কাতিদিস যদিও তার টুইটারে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। সেখানে তিনি বলেন যে, তিনি কোনো ফ্যাসিস্ট নন, এইটার মানেও তিনি জানেন না। তিনি শুধু গোলের পর গ্যালারিতে থাকা তার অন্য এক টিমমেটের দিকে ইশারা করেন এইভাবে।
তিনি অবশ্য তার কোচের কাছে থেকেও সমর্থন পান। তিনি বলেন যে, কাতিদিসের বয়স অনেক কম, রাজনীতি নিয়েও জ্ঞান অনেক কম। তাই সে না জেনে এই কাজটি করেছে। অবশ্য এটা বলেও লাভ হয়নি কোন। তাকে জরিমানা করা হয় ১ লক্ষ ইউরো, এবং সেই সাথে ওই মৌসুম পুরোটাই ক্লাবে নিষিদ্ধ হন।
এরপর মৌসুম শেষে তাকে ক্লাবই ছাড়তে হয়। এখানেই থামেনি সেটা, গ্রিস জাতীয় ফুটবল দলে তাকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রিস অনূর্ধ্ব-২১ দলের এই প্রাক্তন অধিনায়কের ক্যারিয়ার পরবর্তীতে আর আগায়নি সেভাবে। ছোট ছোট ক্লাবগুলোয় খেলে পর্দার আড়ালেই ছিলেন। বর্তমানে তিনি চেক রিপাবলিকের ক্লাব এফকে প্রিব্রামে আছেন। প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় এই খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার রীতিমতো ধ্বংস হয়ে যায় এই কাজে।
সাকা–শাকিরি: আলবেনিয়ান ইগল সেলিব্রেশন
এটি মোটামুটি সাম্প্রতিক ঘটনা। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে মুখোমুখি হয় সুইজারল্যান্ড ও সার্বিয়া। ম্যচের শুরুতেই সার্বিয়া এগিয়ে যায় ১-০ গোলে। এরপর ম্যাচে ফিরতে মরিয়া সুইসরা একের পর এক অ্যাটাক চালু রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় গ্রানিত সাকা বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত একটি বুলেটের মতো ক্ষিপ্র শটে গোল করে সমতায় আনেন। এরপর দুই হাত বুকে নিয়ে ক্রস করে দুই মাথাওয়ালা ইগলের প্রতিকৃতি তৈরি করেন। এরপর আবার ৯০ মিনিটে যখন জর্ডান শাকিরি গোল করে সুইসদের জয় নিশ্চিত করেন, তখন তিনিও এই একই কায়দায় উদযাপন করেন।
কিন্তু… এর সাথে তাদের বা সুইসদের সম্পর্ক কী?
এই দুই মাথাওয়ালা ঈগল আসলে আলবেনিয়ার জাতীয় প্রতীক। আলবেনিয়াকে বলা হয় দ্য ল্যান্ড অফ ঈগল। ১৯৯৮-৯৯ সালের কসোভো যুদ্ধ নিয়ে আলবেনিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে সম্পর্ক চূড়ান্ত খারাপে পৌছায়। সাকা আর শাকিরি দুইজনের রক্তেই আলবেনীয় অংশ রয়েছে। দুজনেই সুইজারল্যান্ডে দ্বিতীয় প্রজন্মের বলকান শরণার্থী।
সাকার বাবা ছিলেন এই আলবেনিয়ার নাগরিক। যখন সাবেক যুগোস্লাভিয়ার সাথে যুদ্ধ হয়, তখন তিনি রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে তারা সুইজারল্যান্ড চলে আসেন। সাকার জন্ম হয় সুইজারল্যান্ডেই। কিন্তু শাকিরি ব্যাপার আরো গভীর, তা জন্ম হয় কসোভোতে। ২০০৮ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেও সার্বরা এখনো কসোভোকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। শাকিরি এই ম্যাচে নামেন কসোভোর পতাকাখচিত বুট পরে। এই দুই খেলোয়াড় ম্যাচের শুরু থেকেই ছিলেন উগ্র সার্ব দর্শকদের বিদ্রুপের শিকার।
খেলার মাঝে এইভাবে রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে আসা এবং তা দিয়ে বিপক্ষ দলের ফ্যানদের উত্তেজিত করার অপরাধে ফিফার শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় তাদের। এই ঘটনায় ফিফা তাদেরকে প্রথমে ২ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ও সাথে দশ হাজার সুইস ফ্রাঁ এবং অধিনায়ক স্টিফেন লিখ্ট্স্টাইনারকে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ জরিমানা করে শাকিরির সাথে সেলিব্রেশন করায়। নিষেধাজ্ঞা পরবর্তীতে তুলে নেয় ফিফা। এতে আবার নাখোশ হয় সার্বিয়া। তারা বলে, ফিফাও তাদের এই ব্যাপারে অপমান করছে। কারণ, সেই ম্যাচে সার্বিয়াকে ফিফা ৫৪ হাজার ফ্রাঁ জরিমানা করে উগ্র ব্যানার আর টি-শার্টের জন্য। তারা কয়েকজন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী রাতকো ম্লাদিচের সমর্থনে তার ছবি সম্বলিত সোয়েটার পরে আসে। ব্যাপারটাকে আরো উসকে দেয় আলবেনিয়া। তাদের প্রধানমন্ত্রী এডি রামা একটি ফান্ড খুলেন সাকা আর শাকিরি’র জরিমানার টাকা উঠানোর জন্য। ‘Don’t Be Afraid Of The Eagle’ নামের সেই ফান্ডে ১ দিনেই ১৯ হাজার ডলার উঠে আসে।
সাকা পরবর্তীতে এই নিয়ে ক্ষমা চাইলেও শাকিরি কিছু করেননি। এই ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় উত্তর দেন, তিনি এমন কোন কাজ করেননি যেটা সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে যায়। তাই ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
নিকোলাস বেন্টনার: শোয়িং আন্ডারপ্যান্টস
ইউরো ২০১২ তে গ্রুপ বি-এর ম্যাচ চলছিল পর্তুগাল আর ডেনমার্কের মধ্যে। দুই গোলে শুরুতেই পিছিয়ে পরে ডেনমার্ক। এরপর নিকোলাস বেন্টনারের গোলে ম্যাচে ফিরে আসে তারা। একটু পরেই বেন্টনার তার দ্বিতীয় গোল করে খেলাটি ২-২ সমতায় নিয়ে আসেন। গোল করার পরই তিনি তার জার্সি একটু উপরে তুলে নেন। এরপর তার শর্টসটি সামান্য নিচে নামিয়ে সবাইকে দেখান তার আন্ডারপ্যান্ট। সেখানে বড় করে লেখা ছিল একটি বেটিং কোম্পানি ‘Paddy Power’-এর লোগো।
উয়েফা এটিকে বেশ গুরুতর অপরাধ হিসেবে নেয়। এইজন্য বেন্টনারকে ১ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ও সাথে ১ লাখ ইউরো জরিমানা করে। কিন্তু শুধু এই কাজের জন্য এত বেশি জরিমানা করাকে অনেকেই ভাল চোখে দেখেনি। কারণ সে বছরই ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড় মারিও বালোতেল্লির উদ্দেশ্যে বর্ণবাদী আচরণ করায় পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোকে মাত্র বিশ হাজার ডলার জরিমানা করে। আবার বর্ণবাদের প্রতিবাদে ম্যানচেস্টার সিটি যখন মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে, সেই ঘটনার জন্য তাদেরকে ত্রিশ হাজার ইউরো জরিমানা করে। এছাড়াও প্রায় সমসাময়িক অন্যান্য বেশ কিছু ব্যাপারেও উয়েফা এত বেশি জরিমানা কখনোই করেনি। উয়েফার ইউরোর রুলস ও রেগুলেশনে শুধু লেখা ছিল, এই ধরনের টুর্নামেন্টে জার্সিতে অফিরিয়াল স্পন্সর ছাড়া আর কারোর লোগো থাকতে পারবে না। সেখানে শুধু এইটুকু ভঙ্গের জন্য বিশাল পরিমাণ জরিমানা নিতান্তই অনুচিত ছিল।
If racism made money for Uefa like advertising does do you think Uefa would take it as serious?? #priorities
— Rio Ferdinand (@rioferdy5) June 18, 2012
নিজের সমর্থনে বেন্টনার বলেন, এরকম কোনো নিয়ম রয়েছে বলে তার জানা ছিল না। তিনি যে আন্ডারপ্যান্টটি দেখিয়েছিলেন, সেটা নাকি ছিল তার লাকি আন্ডারপ্যান্টস। সেটি তিনি আগেও অনেক ম্যাচেই ব্যবহার করেছেন, কিন্তু দেখিয়েছেন শুধু এই ম্যাচেই।
রুড ফন নিস্তলরয়
নেদারল্যান্ড আর অ্যান্ডোরার ম্যাচে নিস্তলরয় পেনাল্টি মিস করার পর অ্যান্ডোরার ডিফেন্ডার অ্যান্টনি লিমা নিস্তলরয়ের সামনে এসে মুখের সামনে এসে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে। সেই ম্যাচেই পরে প্রায়শ্চিত্ত করেন নিস্তলরয়, দারুণ একটা ক্রস লিমাকে ছাড়িয়ে তার পায়ে এসে পড়তেই বলটাকে জালে জড়িয়ে দেন। উইনিং গোল করে নিস্তলরয়ও এবার উদ্দাম উল্লাসে মেতে ওঠেন। ২০ গজ জগিং করেন, সেই লিমার সামনে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েন, ঠাণ্ডা এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, এরপর উদ্ধত ভঙ্গিমায় দু’হাত উঁচু করে উদযাপন করেন। এজন্য হলুদ কার্ড দেখলেও তাতে নিস্তলরয়ের থোড়াই কেয়ার!
ফ্যাবিয়ান ডি লা মোরা এবং আলবার্টো মেডিনা
মেক্সিকান লিগের ম্যাচে ডি লা মোরা গোলের পর সাইডলাইনের দিকে দৌড়ে যান। সেখানে তাকে অনুসরণ করে যান মেডিনা। সেখনে ডি লা মোরার অঙ্গভঙ্গি ছিল হাতে পিস্তল নিয়ে , সেটি লোড করে মেডিনার মাথায় মারা এনং মেডিনার মাটিতে শুয়ে পড়া। মাদকজনিত ইস্যুতে তখন মেক্সিকোতে নাজেহাল অবস্থা, প্রায় প্রতিদিন এ ধরনের সহিংসতায় মানুষের প্রাণ যাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে তাই মেক্সিকোতে এটা ছিল পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। তাই তাদের দু’জনকেই জরিমানা করা হয় ৫০ হাজার পেসো করে। আবার তাদের ক্লাব চিভাসকে বাধ্য করা হয় ১ মিলিয়ন পেসো জুয়ারেজের একটি এতিমখানায় দান করতে।
ডেভিড নরিস
ইপসউইচ টাউনের ফুটবলার ডেভিড নরিসের বন্ধু ছিলেন প্লাইমাউথের গোলরক্ষক লুক ম্যাককরমিক। লুক ম্যাককরমিক মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর সময় রাস্তায় দুইটি ছোট বাচ্চা ছেলেকে মেরে ফেলেন, সেজন্য তাকে জেলে আটকানো হয়। নরিস তার বন্ধুর সমর্থনে পরের ম্যাচে গোলের পর হাত দিয়ে হ্যান্ডকাফ বোঝানোর মতো অঙ্গভঙ্গি করেন, আর সেটার জেরে তাকে ইপসউইচ টাউন ২৫ হাজার পাউন্ড জরিমানা করে।
এমানুয়েল আদেবায়োর
যারা তাকে চেনেন ভালোভাবে, তারা বলতে পারেন, আদেবায়োর একটু কেমন যেন। তার সোশাল মিডিয়ার পোস্টের কমেন্টে কেউ নেগেটিভ কিছু বললে আদেবায়োর উত্তর দিতে দেরি করেন না। তো সাবেক এই আর্সেনাল খেলোয়াড় যখন ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে আর্সেনালের বিপক্ষে খেলতে নামেন, তখন গোলের পর প্রায় ১০০ গজ দৌড়ি আর্সেনাল ফ্যান গ্যালারির কাছে আসেন, এবং প্রকাণ্ড একটা চিৎকার দিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে অপমানজনক অঙ্গভঙ্গি করেন।
নিকোলাস আনেলকা
ওয়েস্ট ব্রমউইচ এলবিওনে খেলার সময় আনেলকা হাত দিয়ে একধরনের অঙ্গভঙ্গি করেন, যেটিকে বলা হয় ‘Quenelle’। এটিকে আবার ‘রিভার্স নাৎসি স্যালুট’ও বলা যায়। এই কাজে আনেলকা নিষেধাজ্ঞা পান ৫ ম্যাচের জন্য।
ফুটবলের সাথে সেলিব্রেশন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকবে। সম্প্রতি এই সেলিব্রেশন নিয়ে একরকম টুইটার-যুদ্ধ হয়ে গেছে রিয়াল মাদ্রিদের জার্মান মিডফিল্ডার টনি ক্রুস আর আর্সেনালের গ্যাবানিজ ফরোয়ার্ড পিয়েরে এমেরিক অবামেয়াংয়ের মধ্যে। টনির কোনো বাড়তি সেলিব্রেশন পছন্দ নয়, উপরন্তু তিনি টুইটে অবামেয়াং আর গ্রিজমানের নাম উল্লেখ করেই বলেন, তাদের অতিরিক্ত সেলিব্রেশন তরুণদের মধ্যে নেগেটিভিটি ছড়াবে।
কিন্তু যত যা-ই হোক, ফুটবলে সেলিব্রেশন রীতিমতো অবিচ্ছেদ্য। প্রতিটি খেলোয়াড়ের আত্মিক আবেগের পরিপূর্ণ পরিস্ফুটন দেখা যায় উদযাপনের মধ্য দিয়েই। অনেক খেলোয়াড় তার সাবেক ক্লাবের বিরুদ্ধে করেন সেলিব্রেশন, কেউ বা নম্রতার স্রোতে ভাসিয়ে নেন। উদযাপনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন তাদের দেশের ঐতিহ্য, ক্লাবের ঐতিহ্য, কারোর জন্য সমর্থন, সমবেদনা, শ্রদ্ধা, এমনকি চলমান কোনো সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। প্রতিটি উদযাপন যেন জীবনেরই আরেক পরিভাষা।
তাই সেলিব্রেশন চলবেই। সেটা যেখানে হোক, যেকোনো অবস্থাতেই হোক।