ধরুন, ঠিক এই আর্টিকেলটার মতোই ক্রিকেট আর্টিকেল লেখা আমার পেশা। একইভাবে এই পেশায় নিয়োজিত আছেন আরো অনেকেই। আপনি বা আপনারা তা পড়েন। ক্রিকেট আর্টিকেলের সঙ্গে তাহলে দুই শ্রেণির মানুষ জড়িত হয়ে পড়ছে। একদল লেখক ও অন্যদল পাঠক। ক্রিকেট-লিখিয়েরা অসাধারণ সব রচনা আপনার সামনে উপস্থিত করেন, আপনি সেসব পড়ে তৃপ্ত হন। তারা পরিসংখ্যানের গলি-ঘুপচি ঘেঁটে আপনার জন্য তুলে আনেন অদ্ভুত সব মণিমাণিক্য, পড়ে আশ্চর্য হন আপনি। ক্রিকেট পাঠ আনন্দের বিনোদনের সাথে আপনার জ্ঞানকোষ সমৃদ্ধ হয় নানান ক্রিকেট তথ্য ও সংখ্যায়। ক্রিকেটপাঠ করে আপনি পুলকিত হন।
কিন্তু একসময় গিয়ে আপনার মনে হয়, আগের মতো ঠিক জমছে না ক্রিকেট রচনা। লিখিয়েরা আপনার মনের খোরাক মতো যোগান দিতে পারছে না ক্রিকেট-লেখা। ফলে ক্রিকেট আর্টিকেলে আগের মতো আগ্রহ পান না আপনি, আপনার মতো আরো অনেকেই পায় না, ক্রিকেট লিখিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বুঝতে পারেন এইসব রচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পাঠক। অর্থাৎ, আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে ক্রিকেট পাঠকের সংখ্যা। এই যখন পরিস্থিতি, ক্রিকেট-লিখিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নেবে তাহলে?
আপনি বলবেন, খুব সহজ। গলদ কোথায় হচ্ছে, লেখার মান পড়তির দিকে কি না, লেখার গতি আরো সাবলীল, স্বচ্ছন্দ ও তথ্যপূর্ণ সহকারে কীভাবে পরিবেশন করা যায়, তা-ই নিয়ে কাজ করবে। লিখিয়েদের লেখার মান আরো বাড়াতে মনোযোগী হওয়া লাগবে। এই তো!
অথবা এমনও হতে পারে, ক্রিকেট রচয়িতারা চান যে আরো বাড়ুক ক্রিকেট পাঠকের সংখ্যা। ছেলে, বুড়ো, জোয়ান থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ হয়ে উঠুক ক্রিকেট-লেখার পাঠক। তখনই বা কেমন নীতিমালা আশা করেন?
লেখার বনেদিয়ানা বজায় রেখে সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় যেন ক্রিকেটটা উপস্থাপন করা হয়। ঢংয়ে, গল্পে, বর্ণনায়, বিবরণে নতুনত্ব আসুক — কিন্তু তা সস্তা হওয়া চলবে না। সবার বোধগম্য হোক, কিন্তু চটুল বা খেলো যেন না হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে, কিন্তু ‘ক্লাস’ বিসর্জন দেয়া যাবে না।
এরকম কিছুই বলবেন আপনি? আপনার পরামর্শ এই ধরনেরই তো হবে, নাকি?
প্রিয় পাঠক! এতক্ষণ আপনি আসলে ভুল বুঝেছেন। ভুল পথে হেঁটেছেন। ভুলভাবে ভেবেছেন। ক্রিকেট আর্টিকেল-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আসলে এসবের কিছুই করবেন না। আমি বলছি আপনাকে কীভাবে চিন্তা করতে হবে, কীভাবে পাঠক বাড়াতে হবে।
কর্তৃপক্ষ কোনো কোনো ফিচারের পরিসর কমিয়ে দেবেন। ইয়া বড় ‘কেলোর কীর্তি’ পড়ার সময় কই এই যুগে? তাই আর্টিকেল নামিয়ে আনতে হবে একশ-দেড়শ শব্দের মধ্যে; তোমার যা গল্প, যা তথ্য-উপাত্ত, সমস্ত ওই শ’দেড়েকের মধ্যে নামিয়ে আনো। সবধরনের মানুষকে আকর্ষণ করতে হবে। তাই লেখার মাঝে মাঝে একটু বিনোদন, কিছুটা নায়ক-নায়িকা, কিঞ্চিৎ রূপচর্চা আর কিছুটা হাল ফ্যাশনের খবরাখবর… এবং অতি অবশ্যই সামান্য ক্রিকেট; এইসবের মেলানো-মেশানো ঝালমুড়ি পাঠকের সামনে পরিবেশন করো। ফলে যারা ক্রিকেটের পাতা আগে এড়িয়ে যেত, তারাও তখন ক্রিকেট পড়বে। ক্রিকেট-রচনা তখন আর নীরস শব্দের বকবক থাকবে না। তার সঙ্গে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ যুক্ত হয়ে ‘ক্রিকেটেইনমেন্ট’ হয়ে যাবে। চমৎকার হবে না?
আচ্ছা, এটুক পড়ে আইডিয়াটা আপনার হাস্যকর মনে হচ্ছে? পাগলের প্রলাপ? আপনার সময় নষ্ট করছি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার? এই ধরনের লেখায় সময় না দিয়ে ভালো কিছু কাজে আত্মনিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন?
হুম, মেনে নিলাম। মাথা একটু খারাপ হয়েছে বৈকি! এবার তাহলে আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক। পাগলের প্রলাপে এতটা যখন সঙ্গী হয়েছেন, আশা করি আরেকটু হবেন!
ক্রিকেটাররা বিনোদনের ফেরিওয়ালা, ক্রিকেট ফেরি করেন তারা নানান আঙ্গিকে, আর দর্শক অসম্ভব মুগ্ধতা নিয়ে তা উপভোগ করেন। ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের যখন মনে হলো ঠিক জমছে না ক্রিকেটটা, ব্যস্ত সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষকে অত দীর্ঘ সময় ক্রিকেটে ধরে রাখার জো নেই, তখন পাঁচদিনের ক্রিকেট নেমে এল একদিনে, তারপর আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে এক বেলায়। টেস্ট থেকে ওডিআই, এবং টি-টোয়েন্টি। আজকের ক্রিকেট দুনিয়ায় এই তিনটি ফরম্যাটই দারুণ জনপ্রিয়। বেশ ক’বার সিক্স-আ-সাইড খেলাও হয়েছে বটে। এর মাঝেই আবার দশ ওভারের খেলাও এলো — টি-টেন। আর এখন ক্রিকেট মাঠের নবতর সংযোজন — দ্য হান্ড্রেড, ১০০ বলের ক্রিকেট।
এবারকার ইংলিশ গ্রীষ্মে দারুণ রোমাঞ্চ ছড়িয়ে প্রথম মৌসুম সফলভাবেই সমাপ্ত হয়েছে দ্য হান্ড্রেড-এর। লক্ষণীয় পর্যায়ের শিশু-কিশোর ও নারী দর্শকের উপস্থিতি ছিল এই টুর্নামেন্টে। পুরুষ ও নারী দুই বিভাগেই সমানতালে ক্রিকেট হয়েছে, যা অভিনব ও চমৎকার।
ইংলিশ নারী ক্রিকেটের কিংবদন্তি শার্লট এডওয়ার্ডস মুগ্ধতা ও উত্তেজনা নিয়ে বলেছেন,
‘ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো নারী ক্রিকেট দলের ম্যাচে হাজার হাজার দর্শক উপস্থিতি, কমপ্যাক্ট গ্যালারি, বিশ্বাসই করা যায় না। আমার জীবনের সুন্দরতম চারটি সপ্তাহ গেছে। মেয়েরা খেলছে, গ্যালারী থেকে দেখছে মেয়েরা, আর সবাই ক্রিকেটে আগ্রহ পাচ্ছে, খেলাটাকে ভালোবাসছে।’
এমন সফল আয়োজনের পরও একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ক্রিকেটে এই নবতর ফরম্যাট সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা কতটা ছিল আসলে?
টি-টোয়েন্টি থেকে মাত্র কুড়ি বল কমিয়ে হয়তো বড়জোর মিনিট চল্লিশেক ছেঁটে ফেলা হয়েছে। অথচ কুড়ি-কুড়ি শুরুর সময়েও আশি মিনিট করে দুই দলের ব্যাটিং ও মধ্যবর্তী কুড়ি মিনিটের বিরতি দিয়ে তিন ঘন্টার ক্রিকেট রেসিপি প্রকাশ করা হয়েছিল। তারপর স্ট্র্যাটেজিক টাইম-আউট, ডিআরএস ইত্যাদি সংযুক্তির ফলে তিন ঘন্টায় খেলাটার সমাপ্তি অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ‘চার মিনিটে এক ওভার’ এটা প্রজেক্ট হিসেবে বেশ মানিয়ে গেলেও বাস্তবে কঠিন। কুড়ি-কুড়ি ক্রিকেটের ব্যাপ্তি তাই তিন ঘণ্টারও অনেক বেশি হয়ে গেছে এখন।
বিশুদ্ধবাদীদের অনেকে টি-টোয়েন্টির বিপক্ষে থাকলেও এখন মেনে নিয়েছেন। আর যারা নেননি, তারা বুঝে গেছেন এই ফরম্যাট অস্বীকারের উপায় নেই আর। বিসিসিআই মহাসচিব ভ্রু কুঁচকে বলেছিলেন, টোয়েন্টি-টোয়েন্টি? তাহলে টেন-টেন বা ফাইভ-ফাইভ নয় কেন? কিংবা ওয়ান-ওয়ান? ভারত কক্ষনো এই ধরনের ক্রিকেট খেলবে না।
আর এখন সেই ভারতেই গড়ে উঠেছে সেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সর্ববৃহৎ বাজার। অর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেছিলেন, ক্রিকেট-ফিকেট কিছু না, এটা আসলে দু’মিনিটের ম্যাগি নুডলস।
দ্য হান্ড্রেড বা একশো বলের এই ক্রিকেটের বিপক্ষে এখন অনেকে থাকলেও এই আঙিনা যদি পরে পেখম মেলে ওড়ে, তখনও নিশ্চয়ই একে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কিন্তু এখনকার আলোচ্য হচ্ছে, প্রায় কাছাকাছি দু’টি আঙিনা ক্রিকেট মাঠে আদৌ কি দরকার আছে? দ্য হান্ড্রেড — পেখম মেলবে কি গুটিয়ে নেবে সে পরের আলোচনা, এই ক্রিকেটকে স্থান দেয়া দেয়ার যৌক্তিকতা কী?
ইয়ান চ্যাপেল ক্রিকইনফোতে চমৎকার লিখেছেন,
‘যেকোনো সমস্যার দুটি সমাধান থাকে। একটা সহজ, অন্যটা জটিল। খেলোয়াড়ি জীবন থেকে লক্ষ্য করেছি, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড এই দু’টি দেশ সবসময় জটিল সমাধানের পথে হাঁটে।’
দর্শককে ক্রিকেটমুখী করতে ‘দ্য হান্ড্রেড’ আয়োজন চ্যাপেলের কাছে মনে হচ্ছে বরাবরের মতোই ইংলিশ ক্রিকেট বেছে নিয়েছে জটিলতর সমাধান।
ইংলিশ ক্রিকেট ক্যালেন্ডারেই এই টুর্নামেন্টের জায়গা প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় আছে। টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ, ওয়ানডে কাপ — এই তিনটি টুর্নামেন্ট চলছেই। এর মধ্যে ফাঁকফোকর বের করে তিন-চার সপ্তাহ’র জন্য অন্য একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন বেশ কষ্টসাধ্য হতে পারে। মূল টার্গেট অবশ্যই তরুণ দর্শক, নারী দর্শক। সন্দেহ নেই, নারী দর্শক খুব টেনেছে এই আয়োজন। নারী ক্রিকেটাররাও উপকৃত হয়েছে দারুণভাবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ইংলিশ ক্রিকেটের অর্থভান্ডারে জমা হয়েছে অতিরিক্ত ‘কিছু’ অর্থকড়ি। ইয়ান চ্যাপেল তার কলামে তুলেছেন এই প্রশ্নও।
‘ক্রিকেটটা যখন খেলার চেয়ে মেলা (পড়ুন, বিনোদন) বেশি হয়ে পড়ে, কী হয় তখন? ক্রিকেটারদের চেয়ে বেশি কদর পায় বাণিজ্যলক্ষ্মী বা পৃষ্ঠপোষক।’
তরুণ বা নারী দর্শক টানতে একটা ফরম্যাট করলেন, ক’দিন পর বুড়ো টানতে আরেকটা, তারপর শ্রমিকশ্রেণি টানতে একটা, বুর্জোয়াদের টানতে একটা… মানে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে আসলে? টি-টোয়েন্টির উৎপত্তির সময়ই তো বলা হয়েছিল, তরুণ ও নারী দর্শক টানতে এই আয়োজন। তা ফরম্যাটটা কি ব্যর্থ মনে হচ্ছে দ্য হান্ড্রেড-এর আয়োজকদের?
চ্যাপেল ভাইদের বড়জন থেকে আরো একটু ধার করি, মাইকেল ক্লার্কের মতো ব্যাটসম্যান ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাঁচ ম্যাচ খেলে সর্বসাকুল্যে খেলতে পেরেছেন চারটি বল। একজন ব্যাটসম্যানের আত্মবিশ্বাস কোথায় গিয়ে ঠেকছে তাহলে? তাছাড়া কেউ একজন ধুমধাম পিটিয়ে ‘হিরো’ হয়ে গেল, এক-দু’টি ওভারে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিল, ফলে ক্রিকেটারদের মধ্যে অল্প তুষ্টি ভাব জেগে ওঠা আশ্চর্যের নয় কিন্তু!
“ফিল্ডিং ভালোবাসতাম আমি। আনন্দ নিয়েই মাঠে দাঁড়াতাম। কিন্তু কুড়ি ওভার ফিল্ডিং করে দু’টি বলও ব্যাটিংয়ের জন্য পেলাম না — কল্পনা করলেও আমার গা শিউরে ওঠে।”
চ্যাপেল চিরকেলে বিশুদ্ধবাদী। কিন্তু তার কথাগুলোকে হেলায় উড়িয়ে দেবেন, সে উপায় নেই।
বিরাট কোহলি টেস্ট অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, তিনি দলকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ টেস্ট দলে পরিণত করতে চান। তিনি ভারতের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে বিপ্লব আনতে চান। দর্শকরা মাঠে শুধুমাত্র চার-ছক্কার ফুলঝুরি দেখতে আসবে না, বরং টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্যও উপভোগ করতে জানবে। কেউ একজনের সলিড ডিফেন্স, ব্যাটসম্যানের আত্মবিশ্বাসী বল ছেড়ে দেয়া দেখেও মাঠে তালি পড়বে, শিস বাজবে। আপনি যদি ক্রিকেটের নিয়মিত দর্শক হন, তাহলে জানেন বিরাটের এই টেস্ট দল বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের দর্শককেই মুগ্ধ করে। ভারত-দলপতি যে সংস্কৃতি চান, তা নিশ্চিতভাবেই আরো বহু দূরের পথ, কিন্তু তার পথচলা প্রশংসাযোগ্য। ক্রিকেট মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে আপনাকে ভাবতে হবে সেভাবেই।
ইয়ান চ্যাপেল বলেছেন যেমনটা,
‘মানুষকে ক্রিকেট সম্পর্কে আগ্রহী করতে হলে ‘বিগ স্ক্রিন’ ব্যবহার করুন। খেলাটার বিভিন্ন টুকিটাকি তুলে ধরুন। বাচ্চারা কীভাবে ক্রিকেটে আসক্ত হবে, তা নিয়ে কাজ করুন। কিন্তু আপনি করছেন কী? বড় স্ক্রিনে দেখাচ্ছেন — এভ্রি বল কাউন্টস। মানে কী ভাই? এতটা বছর তাহলে কোনো কোনো বল ‘কাউন্ট’ করা হতো না? তাহলে আমার ক্যারিয়ারের ছত্রিশটা বছরই তো মিথ্যা হয়ে যায়।’
অলিম্পিকে ক্রিকেটকে স্থান করে নিতে হলে ছোট ফরম্যাটের প্রয়োজন আছে। যুগের চাহিদা বলেও একটা কথা আছে। তা সেসব মেটানোর জন্য টি-টোয়েন্টি তো আছেই। বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি লিগ হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে দু’টি-তিনটি-চারটি টুর্নামেন্টও আয়োজিত হয়। তাছাড়া প্রত্যেকটি খেলার নির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শক থাকে, সব খেলা সর্বসাধারণের হয় না। অলিম্পিকে কত রঙ-বেরঙের খেলা আছে, তার ক’টা আপনি জানেন? বাংলাদেশে বা অন্য যেকোনো দেশে জনপ্রিয়? দাবা, টেনিস, গলফ… এক-একটি খেলার একেক রকম দর্শক, ভাব, আবহ। আপনি যদি চান সকল মানুষের কাছে দাবা খেলা জনপ্রিয় করবেন, তা তো হয় না। সম্ভব না। ক্রিকেটেরও নির্দিষ্ট ভাব-দাপট-মেজাজ আছে। সেই মেজাজের সঙ্গে সব মানুষ একাত্ম হবে না, সে আপনি ক্রিকেটের মেজাজ ‘ভারী’ থেকে ‘হালকা’ করুন বা না-ই করুন।
অবশ্যই সব শ্রেণির মানুষের কাছে খেলাটাকে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা থাকবে, তবে খেয়াল রাখা দরকার কিছুতেই যেন খেলাটার ‘বিশেষত্ব’ না হারায়। তাহলে যে খেলাটারই আর নিজস্বতা বলতে কিছু থাকবে না!
ফিচারের গল্পটা ছোট আকারে বলতে হবে আমাদের। ইনফোগ্রাফিকস, এক-দুই মিনিটের ভিডিও বার্তায় সেই চেষ্টাও করা হবে। কিন্তু তাই বলে ফিচারের আবেদন হারাতে দেয়া যাবে না। যুগের চাহিদা, সময়ের প্রয়োজন ইত্যাদি বলে ফিচার বা আর্টিকেল লিখিয়েদের যদি আমরা একশো-দেড়শো শব্দে বন্দী করে ফেলি, তাহলে দেখা যাবে ক্রিকেট রচনা ‘মান’ হারিয়ে কিছু শব্দের আবর্জনায় পরিণত হবে। ফলে সত্যিকার সমঝদার যারা, যে পাঠক-সমাজ আগ্রহ ভরে পড়তে চান ক্রিকেট-লেখা, তারা হারিয়ে ফেলবেন মনোযোগ। সবশেষে ব্যাপার এমন দাঁড়াবে যে, ক্রিকেট সাহিত্যই পড়ে যাবে অস্তিত্বের সংকটে।
মাঠের ক্রিকেটেও ঠিক এই ব্যাপার ঘটতে পারে। বাণিজ্যলক্ষ্মীর পিছু পিছু চলার লিপ্সা, ক্রিকেটের এই সংক্ষেপিত আয়োজন — স্কিলফুল ক্রিকেটার প্রাপ্তিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর যে ‘ক্লাসি’ দর্শক ক্রিকেটের মেজাজ-ভাব বুঝে ক্রিকেট দেখেন, তারাও এই ‘ভাঁড়ামো’ দেখে বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন ক্রিকেট থেকে। তাই ক্রিকেটকে ক্রিকেটের মতো করেই মানুষের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন, রঙ-চঙ মাখিয়ে, সঙ সাজিয়ে নয়। যুগের চাহিদা মেটাতে হবে, সময়ের পরিসর নিয়ে ভাবতে হবে, তা সেসবের সমাধান-স্বরূপ ক্রিকেটকে ‘খেলা’ না রেখে ‘মেলা’ করে ফেলা কতটা যৌক্তিক?