এক অসাধারণ গল্পের জন্ম দিয়ে নেপাল জাতীয় ক্রিকেট দল তাদের ইতিহাসের দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচেই জয় তুলে নিয়েছে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। ১ রানের এই জয় তাদের পৌঁছে দিয়েছে ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ে।
১৯২০ এর দশকের দিকে তৎকালীন শাসক পরিবার রানাদের পরিবারের চেষ্টায় ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় নেপালে। শুরুতে আর সব দেশের মতোই এটা ছিলো অভিজাত লোকেদের খেলা। কিন্তু নেপালে বিপ্লবের পর এবং মূলত ১৯৮০ সালের পর থেকে এই ছোট্ট দেশটিতেও গণ মানুষের খেলা হয়ে উঠতে থাকে ক্রিকেট।
১৯৯৬ সাল থেকে নেপালের ক্রিকেট দল এশিয়া ক্রিকেট কাউন্সিলের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ নেপালের ক্রিকেট ইংল্যান্ডের মাটিতে এই জয়ের দুয়ারে পৌঁছে গেছে।
নেপালের অধিনায়ক প্রকাশ খাড়কা বলছিলেন, এই অবধি আসাটা ছিলো তাদের জন্য অসাধারণ এক অভিযান,
‘এটা ছিলো নেপাল ক্রিকেটের জন্য দীর্ঘ ও অসাধারণ এক যাত্রা। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এই ওয়ানডে অন্য অর্থে আমাদের জন্য একটা শুরু মাত্র।’
প্রকাশ খাড়কা অবাক হয়ে ভাবেন, মাত্র আট বছর আগেও তারা আইসিসির পঞ্চম বিভাগের একটা দল ছিলেন। আজ সেখান থেকে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়া একটা দল হয়ে গেছেন,
‘আমরা সবসময়ই এই জায়গাটায় এসে পৌঁছাতে চেয়েছি। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জটা ছিলো সময়ের সাথে উন্নতি করা। আট বছর আগে আমরা আইসিসির ‘ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগের’ পঞ্চম ডিভিশনে খেলতাম। আর এখন আমরা বিশ্বের ১৬টি দেশের একটি। আগামী চার বছরের জন্য আমরা ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে গেছি।’
‘আমি আশা করি, এখান থেকে আমরা আমাদের এই ধারাটা ধরে রাখবো এবং আরও উন্নতি করতে থাকবো। কারণ, আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য টেস্ট খেলুড়ে দেশ হওয়া। আমরা ওয়ানডে স্ট্যাটাসের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। আর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এই খেলাগুলো আমাদের নিজেদের তুলে ধরার জন্য অসাধারণ এক সুযোগ। অভিজ্ঞতা গ্রহণের দারুণ এক সুযোগ এসেছে। আশা করি, এখানে আমরা দারুণ পারফর্মেন্স করতে পারবো।’
প্রকাশ নিজে স্কুলে থাকতে আর দশটা নেপালি শিশুর মতো ক্রিকেট-ফুটবল, সবই খেলতেন। সেখান থেকে আস্তে আস্তে কী করে ক্রিকেটে চলে এলেন, সেটাই বলছিলেন তিনি,
‘এটা ভাবতেও অসাধারণ লাগে যে, আমরা কত দূর এসে পড়েছি। একেবারে নিজের কথা বললে, আমি কাঠমুন্ডুতে যখন একটা স্কুলে পড়ি, তখন ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলাম। সবই খেলতাম তখন। সবসময় খেলতাম। বৃষ্টির সময় ফুটবল এবং বাকিটা সময় ক্রিকেট খেলতাম।’
‘আমার ওই অর্থে কোনো ক্রিকেট হিরো ছিলো না। কিন্তু কয়েক বছর আগে অবধি গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান দলকে খুব অনুসরণ করতাম।’
প্রকাশ বলছিলেন, অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলাটাই তাদের ক্রিকেটের ভাগ্য বদলে দিতে শুরু করে। ওখান থেকেই তারা অসাধারণ কিছু অভিজ্ঞতা পেয়েছেন,
‘ওই স্তরে থাকতে আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে, জীবনে একদিন আমি আমার দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলবো। কিন্তু নিয়তির মনে অন্যরকম কিছু ছিলো। আমাকে যখন প্রথম অনুর্ধ্ব-১৫ দলে নির্বাচন করা হলো, তখন থেকে সবকিছু বদলে যেতে শুরু করলো।’
‘এরপর আমরা আইসিসি অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেললাম। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে দু’বার হারালাম। আর নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েকেও হারালাম। ওখানে আমরা বিভিন্ন দেশের বিশ্বেসেরা কিছু ক্রিকেটারের সাথে খেলার সুযোগ পেলাম।’
এরপর নেপাল ক্রিকেট দল বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেললো। আর এটাই প্রকাশের মতে তাদের ইতিহাসের বাঁক। এখান থেকেই তারা বদলে যেতে শুরু করলেন বলে বলছিলেন,
‘এরপর আমাদের ক্রিকেটের জীবনে সবচেয়ে খুশির দিনটা এলো। ২৭ নভেম্বর, ২০১৩। এই দিনে আমরা হংকংকে শেষ বলে এসে হারিয়ে ২০১৪ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার করলাম। বাংলাদেশে হলো সেই টুর্নামেন্ট।’
‘আমার মনে আছে, আমার খুব নার্ভাস লাগছিলো। আমি এসব সময় বছরের পর বছর ধরে কেবল স্বপ্ন দেখেছি। অবশেষে সেই স্বপ্নটা এসে সামনে দাড়ালো। স্বপ্নটা তখন সাড় তিন ঘন্টা দূরে। আমরা আমাদের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের দীর্ঘতম পদক্ষেপটা দিলাম ঐ সময়ে এসে। আমরা আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা কিছু সময় উপহার দিলাম ওই টুর্নামেন্টে। হংকং, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বিপক্ষে অসাধারণ তিনটি ম্যাচ খেললাম আমরা।’
সর্বশেষ নেপালের অর্জন হলো ওয়ানডে স্ট্যাটাস। আর সেই অর্জটা করলো তারা খুব নাটকীয়ভাবে। নামিবিয়াতে অনুষ্ঠিত আইসিসির দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে চলে এলো তারা বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলতে। আর এখানে পেয়ে গেলো তারা স্ট্যাটাস।
প্রকাশ সেই কথা মনে করে বলছিলেন,
‘এরপর এ বছর আমরা নামিবিয়ায় আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগের দ্বিতীয় বিভাগ থেকে উঠে এলাম। আইসিসি বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেললাম জিম্বাবুয়েতে। এটা ছিলো আমাদের জন্য আরেকটা অনন্য অর্জন। এগুলোই আমাদের ইতিহাসের সেরা সময়। এই বছরটা আমাদের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বছর। কারণ, এমন একটা জায়গায় আসার জন্যই আমরা অনেক পরিশ্রম করেছি।’
প্রকাশের মতে তাদের দলের মূল সম্পদ হলো দলীয় চেতনা ও সমর্থক গোষ্ঠী,
‘আমাদের দারুণ একটা দলীয় চেতনা আছে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক বিষয়। আমরা প্রতিটা রান ও প্রতিটা উইকেটের জন্য লড়াই করি। আমাদের সব খেলোয়াড় অত্যন্ত সত ও পরিশ্রমী। আমরা এমনভাবে খেলি যেন মনে হয়, কেউ একজন আমাদের ওপর সবসময় নজর রাখছে।’
‘আমরা যখন যেখানেই খেলি না কেন, আমাদের দারুণ একটা সমর্থক গোষ্ঠী আছে। নেপালের লোকেরা, যারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্থায়ী হয়েছেন, আমাদের খেলা থাকলেই তারা অনেকে একসাথে মাঠে চলে আসেন। এটা আমাদের জন্য একটা আশীর্বাদ। এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট অনুপ্রেরণা।’
‘আমরা ২০১৬ সালে প্রথম যখন লর্ডসে খেললাম, তখন এই সমর্থনটা প্রথম খেয়াল করলাম। আমি পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম, ‘আমরা কি আসলেই লর্ডসে খেলে ফেলেছি?’
‘যে ড্রেসিংরুমে বিশ্বের সব গ্রেট খেলোয়াড়রা কখনো না কখনো এসেছেন, আমরা সেই ড্রেসিংরুমে ছিলাম। এটা অসাধারণ, বিস্ময়কর একটা অভিজ্ঞতা। আমরা খুবই খুশি যে, এই সপ্তাহে এমসিসি ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে আবার সেই সুযোগটা পেলাম আমরা।’
এখন প্রকাশরা সামনে তাকাচ্ছেন। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলাটাকে পাখির চোখ করেছেন তারা। সেভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করছেন,
‘আমরা এখন আইসিসি ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের দিকে চেয়ে থাকা শুরু করেছি। এটা একটা অসাধারণ সুযোগ আমাদের জন্য। নেপালের সরকার আমাদের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করছেন। আশা করছি, আমরা খুব দ্রুত একটা পুরোপুরি সক্রিয় ক্রিকেট বোর্ড পেয়ে যাবো। আমরা যদি সব রসদ পেয়ে যাই এবং সব ধরনের সমর্থন পাই, আমি মনে করি, নেপালের ক্রিকেটের সামনে খুবই সুদিন অপেক্ষা করছে।’
নেপালের ক্রিকেটের সুদিনটা পুরোটা চোখের সামনে দেখলেন প্রকাশ। আস্তে আস্তে তারও হয়তো বিদায় বলার সময় চলে আসবে। প্রকাশ বলছেন, তার আগে দেশের জন্য যতটা সম্ভব করে যেতে চান,
‘আমি ১৫ বছর ধরে ক্রিকেট খেলছি। কখনো ভাবিনি এই এত দূর আসতে পারবো। একটা সময় তো আসবে, যখন মনে হবে, যথেষ্ট হয়েছে। সেটা ছয় মাস পর হতে পারে, ছয় বছর পর হতে পারে। কিন্তু এখন আমি নেপালের ক্রিকেটের জন্য যথেষ্ট অবদান রেখে যেতে চাই। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব করতে চাই।’
‘একজন অধিনায়ক হিসেবে এটা অসাধারণ একটা যাত্রা। আমি আশা করি, এটা চলতে থাকবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পারফর্ম করতে থাকা এবং দলকে উন্নতিতে সহায়তা করা।’