শুরুটা যেভাবে হলো
এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষভাগে টি-২০ ক্রিকেট লাভ করে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। ফলে টেস্ট ম্যাচগুলোর প্রচারস্বত্ত্ব ক্রয়ের আগ্রহ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দিবা-রাত্রির একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা সাড়ে তিন ঘণ্টার মারকাটারি টি-২০ ক্রিকেটের যুগে পাঁচদিনের এই কুলীন ফরম্যাটের দর্শকসংখ্যা কমে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দেয়। এই আশঙ্কা থেকেই উদয় হয় দিবা-রাত্রির টেস্ট ক্রিকেটের ধারণা। নীতিনির্ধারকদের মনে হতে থাকে, দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ হয়তো মাঠের পাশাপাশি টিভি দর্শকদেরও আকৃষ্ট করবে।
২০০৯ সালে তৎকালীন ইসিবি চেয়ারম্যান জাইলস ক্লার্ক বলেন, “দর্শকরা সন্ধ্যায় ক্রিকেট দেখতে পছন্দ করে, টি-২০ ক্রিকেট দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়েছে।“
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড বলেন, “আমরা এখানে এবং পৃথিবীর অন্যান্য বিভিন্ন জায়গার টিভি নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করেছি, তারা দিবারাত্রির টেস্টের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। টিভিস্বত্ত্ব বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আমরা একটা বাজে টাইম জোনে আছি, সুতরাং একটা টেস্ট ম্যাচ একটু দেরিতে শুরু হলে বরং বেশ ভালো হয়।“
তৎকালীন আইসিসির মহাব্যবস্থাপক ডেভ রিচার্ডসন বলেন, “আইসিসি টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। এজন্য যদি কিছু ম্যাচ ফ্লাডলাইটের আলোয় খেলতে হয়, তা আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব।“
কর্মপরিকল্পনা
দিবারাত্রির টেস্ট ক্রিকেটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শুরু হয় গবেষণা। বলের রঙ পরিবর্তন করা প্রয়োজন ছিল, কেননা ফ্লাডলাইটের আলোয় লাল বল ঠিকভাবে দেখতে পাওয়া কঠিন। গবেষণার অংশ হিসেবে হলুদ, কমলা ও গোলাপি বল দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। এমনকি এমন প্রস্তাবও উঠেছিল যে, কিছুটা উন্নত সাদা বল দিয়ে খেলা হবে। বলটা ৮০ ওভারের মতো টিকবে আর খেলোয়াড়েরা রঙিন জার্সি পরবে।
প্রতিবন্ধকতা
প্রত্যাশিতভাবেই প্রথাগত ধ্যানধারণা পোষণকারীদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত আসেনি। তাদের মতে, ওয়ানডে ও টি-২০ থাকতে টেস্ট ক্রিকেটে হাত দেয়া হবে কেন?
ইসিবি ঘোষণা দিয়েছিল, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার ২০১০ এর লর্ডস টেস্ট হবে দিবা-রাত্রির এবং গোলাপি বলে। পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায় যখন দুই দলই গোলাপি বলে একটা চার দিনের ম্যাচ চাইলেও ডারহাম ও উস্টারশায়ার তা নাকচ করে দেয়।
আমি আগ্রহী ছিলাম না। এটা একটা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ছিল এবং আমার মনে হয়েছিল আমাদের খেলাটার শুদ্ধতা রক্ষা করা প্রয়োজন।
– ডারহামের কোচ জিওফ কুক
কিংবদন্তিতুল্য আম্পায়ার ডিকি বার্ড বলেন,
I am one of the old school and I am all for the game being played in white. It is the best to play a test match in white and during the day.
প্রথম সাফল্য
প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে গোলাপি বল ব্যবহার করা হয় নারীদের ক্রিকেটে। ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড নারী দলের মধ্যকার ওয়ানডে ম্যাচে প্রথম ব্যবহার করা হয় গোলাপি বল। এর কয়েক মাস পরেই ২০১০ এর জানুয়ারিতে গায়ানা ও ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর মধ্যকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ শুরু হয় দুপুরে এবং খেলা হয়েছিল গোলাপি বলে।
ইসিবি অবশেষে তাদের পরীক্ষা চালায় আগের মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন ডারহাম ও এমসিসির মধ্যকার ২০১০ এর চ্যাম্পিয়ন কাউন্টি ম্যাচ দিয়ে। এই ম্যাচটি ফ্লাডলাইটের আলোয় আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১১-তে ক্যান্টারবুরি একটি ডিভিশন টু কাউন্টি ম্যাচ আয়োজন করে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ২০১০-১১ মৌসুমের কায়েদ-এ-আজম ট্রফির ফাইনাল আয়োজন করে কমলা বলে। পরের মৌসুমে একই টুর্নামেন্টের ফাইনাল আয়োজিত হয় গোলাপি বলে। দক্ষিণ আফ্রিকাও ২০১২ সালে গোলাপি বলে পরীক্ষামূলক ম্যাচ আয়োজন করে এবং ২০১৪ শেফিল্ড শিল্ডের একটা সম্পূর্ণ রাউন্ড গোলাপি কোকাবুরা বলে খেলা হয়।
বাংলাদেশে গোলাপি বল
২০১৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) ফাইনালে মুখোমুখি হয় সেন্ট্রাল জোন ও নর্থ জোন। ম্যাচটি গোলাপি বলে মাঠে গড়ায় ও দিবা-রাত্রিতে খেলা হয়। গোলাপি বলে একমাত্র বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে এই ম্যাচে শতক হাঁকান রকিবুল হাসান। ২য় ইনিংসেও ৬৮ রান করেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। গোলাপি বলে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে পাঁচ উইকেট পান নর্থ জোনের সানজামুল ইসলাম। ৭৩ রানে ৮ উইকেট নেন তিনি। সেন্ট্রাল জোনের মোহাম্মদ আশরাফুল হ্যাটট্রিক করেন বল হাতে। সেন্ট্রাল জোন ৩১ রানে ম্যাচটি জিতে নেয়। যৌথভাবে সেরা খেলোয়াড় হন রকিবুল হাসান ও সানজামুল ইসলাম।
প্রথম দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ
২০১৫ সালের নভেম্বরে অবশেষে মাঠে গড়ায় গোলাপি বলের তথা দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার এই ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় অ্যাডিলেড ওভালে। গোলাপি বলের আকার-আকৃতি যথাসম্ভব ঠিক রাখার জন্য উইকেটে অতিরিক্ত ঘাস রাখা হয়। লো-স্কোরিং হলেও ম্যাচটি দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় এবং অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি জিতে নেয় তিন উইকেটে। বিশেষভাবে গোধূলির সময় বল দারুণভাবে সুইং করছিল এবং ফাস্ট বোলারদের যথেষ্ট সাহায্য করে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এই টেস্ট ম্যাচকে সফল ঘোষণা করে এবং ভবিষ্যতে আরও দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এক জরিপে দেখা যায়, ৮১% দর্শক চায় অ্যাডিলেডের সকল টেস্ট ম্যাচ দিবা-রাত্রির হোক। এই ম্যাচটিতে অ্যাডিলেড ওভালে কোনো নন-অ্যাশেজ টেস্ট ম্যাচে সর্বোচ্চ দর্শক সমাগম হয়েছিল।
সাফল্যের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়া
অ্যাডিলেড ওভালের প্রথম গোলাপি বলের টেস্ট ম্যাচের পর আরো এগারোটি দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে এখন নিয়মিতই দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করা হয়। যদিও ২০১৮ সালে ভারতের বিপক্ষে অ্যাডিলেড টেস্ট দিবা-রাত্রির হয়নি ভারত দলের অনভিজ্ঞতার কারণে। প্রথম দিবা-রাত্রির টেস্টের পর অস্ট্রেলিয়ায় আরো চারটি অনুরূপ ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে, এর মধ্যে দুটি অ্যাডিলেড ওভালে ও দুটি গ্যাবায়।
দুবাইয়ে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দুটো দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে; একটি করে আয়োজিত হয়েছে ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতে।
ভারতের আগ্রহ ও উপমহাদেশের প্রথম দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ
সন্ধ্যার শিশির, গোলাপি এসজি বলের চরিত্র, রিভার্স সুইংয়ের অভাব, বলের দৃশ্যমানতা- এসব কারণে বিসিসিআই শুরুতে দিবারাত্রির টেস্ট খেলতে অনিচ্ছুক ছিল। ২০১৬ সালের দুলীপ ট্রফিতে গোলাপি বল পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয় এবং খেলোয়াড়দের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসে। নির্বাচকেরা এবং সৌরভ গাঙ্গুলীসহ অনেক সাবেক ক্রিকেটারের প্রস্তাব সত্ত্বেও গোলাপি বলে পরীক্ষা চালাতে সম্মত হয়নি বিসিসিআই।
২০১৯ সালে যখন সৌরভ গাঙ্গুলী বিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন গোলাপি বলের ক্রিকেটের প্রতি বোর্ডের অবস্থান নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়। ২১ নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে অনুষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের সর্বপ্রথম গোলাপি বলের দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ।
ম্যাচটিতে ভারতের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি বাংলাদেশ। ইনিংস ব্যবধানে হেরে যায় মুমিনুল হকের দল। ভারতের পক্ষে দিবা-রাত্রির টেস্টে প্রথম শতরান করেন বিরাট কোহলি। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ৪ উইকেট পান পেসার ইশান্ত শর্মা। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট পান উমেশ যাদব। বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে কিছুটা প্রতিরোধ গড়েন মুশফিকুর রহিম। তার ৭৪ রানের ইনিংসেও ইনিংস ব্যবধানে পরাজয় এড়াতে পারেনি বাংলাদেশ।
কেমন হতে পারে গোলাপি বলের ভবিষ্যৎ?
এই পর্যন্ত প্রত্যেকটা দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচে ফলাফল এসেছে। গোলাপি বলে লাল বলের চেয়ে বেশি সুইং, পিচে ঘাসের উপস্থিতি, গোধূলিতে প্রাকৃতিক আলো থেকে কৃত্রিম আলোতে মানিয়ে নেওয়ার সময়টাতে উইকেট পতনের সমূহ সম্ভাবনা- সবকিছুই এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
শুরুর দিকে ভীতি ছিল গোলাপি বল বোলারদের বেশি সাহায্য করবে। যদিও অস্ট্রেলিয়ার দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচগুলোতে খুব বেশি রান হয়নি, অন্য জায়গায় বেশ কয়েকবারই বড় রান হয়েছে।
দিবা-রাত্রির টেস্ট আয়োজনের পেছনের মূল কারণ ছিলো প্রচার-স্বত্ত্ব বাড়ানো। অস্ট্রেলিয়াই একমাত্র দল যারা গোলাপি বলের ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নিয়েছে এবং অনেক বেশি দর্শক মাঠে টানতে পেরেছে। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও তা-ই। এক্ষেত্রে অনিচ্ছাও আছে; ইংল্যান্ড ২০১৭ এর পরে আর দিবা-রাত্রির টেস্ট আয়োজন করেনি। তাঁদের যুক্তি হলো- ইংল্যান্ডে দিনের টেস্টেও যথেষ্ট দর্শকসমাগম হয়। পাকিস্তান ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দিবা-রাত্রির টেস্ট আয়োজন করেনি এই যুক্তিতে যে, দিনের টেস্ট ম্যাচে তাদের স্পিনাররা বেশি সাহায্য পায়। দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশও জানিয়েছে, তারা দিবা-রাত্রির টেস্ট আয়োজন করবে না, মূলত গোলাপি বলের চরিত্র নিয়ে তারা সন্দিহান।
তবে গোলাপি বলের টেস্টে ভারতের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ আয়োজনের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে।