ক্রিকেটে ‘বানি’ শব্দটা বেশ প্রচলিত। কোনো নির্দিষ্ট ব্যাটসম্যান যদি নির্দিষ্ট বোলারের বলে বারবার আউট হতে থাকেন, তাহলে ওই ব্যাটসম্যানকে বলা হয় ওই বোলারের বানি।
ক্রিকেটের ইতিহাসের শুরু থেকেই এমন গল্পের অভাব নেই। বড় ব্যাটসম্যান, কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান। সারা দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করেন না। কিন্তু কোনো একজন বোলারের বিপক্ষে এসে দেখা যায়, বারবার অসহায় হয়ে পড়ছেন তিনি।
এমন ঘটনা খোদ টেন্ডুলকারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ইংল্যান্ডের তখনকার তরুণ পেসার জেমস অ্যান্ডারসনের বলে ৯ বার আউট হয়েছেন শচীন। তিনি ৮ বার আউট হয়েছেন মুত্তিয়া মুরালিধরনের বলেও। দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাশওয়েল প্রিন্স ১১ বার আউট হয়েছেন শেন ওয়ার্নের বলে। আবার মাইক আথারটন ১৯ বার আউট হয়েছেন গ্লেন ম্যাকগ্রার বলে।
এমনই সব প্রিয় শিকার ব্যাটসম্যানের ওপর বোলারদের চড়াও হওয়ার কয়েকটা গল্প শোনা যাক আজ।
১. অ্যাশওয়েল প্রিন্স বনাম শেন ওয়ার্ন
বানি ও র্যাবিট, দুটো শব্দেরই অর্থ খরগোশ। কিন্তু ক্রিকেটীয় অভিধানে অবশ্যই এই দুটো শব্দের একটু পার্থক্য আছে। র্যাবিট বলা যায় নির্দিষ্ট কোনো ব্যাটসম্যানকে, যিনি নির্দিষ্ট কোনো বোলারের বিপক্ষে রান করে উঠতে পারেন না। আর বানি বলতে হবে কোনো ব্যাটসম্যানকে, যিনি নির্দিষ্ট ওই বোলারের হাতে পড়লেই আউট হন।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার নব্বইয়ের দশকের যে লড়াই, তাতে অনেকে শেন ওয়ার্নের প্রিয় শিকার মনে করেন ড্যারিল কালিনানকে। এটা ঠিক যে, কালিনান ওয়ার্নের কারণে একেবারে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তার বিপক্ষে রান করতে না পেরে এতটাই হতাশ হয়েছিলেন যে মনোবিদের কাছে অবধি যেতে হয়েছিলো তাকে। শেন ওয়ার্ন খেলেছেন, এমন সব টেস্টে কালিনানের গড় মাত্র ১২.৭৫। কিন্তু মজাটা হলো, তিনি ওয়ার্নের প্রিয় শিকার ছিলেন না। ওয়ার্ন মাত্র ৪ বার আউট করতে পেরেছেন কালিনানকে। এই জায়গায় ওয়ার্নের প্রিয় শিকার ছিলেন অ্যাশওয়েল প্রিন্স।
প্রিন্স আসলে ওয়ার্নের বিপক্ষে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছিলেন। টানা ৮টি টেস্ট ইনিংসে তিনি ওয়ার্নের বলে আউট হয়েছেন। কোনো নির্দিষ্ট বোলারের বলে টানা আউট হওয়ার এটাই বিশ্বরেকর্ড। এছাড়া সব মিলিয়ে ওয়ার্নের বলে প্রিন্স আউট হয়েছেন ১১ বার।
২. মাইক আথারটন বনাম গ্লেন ম্যাকগ্রা
কোনো নির্দিষ্ট বোলারের বলে আউট হওয়াটা অলিম্পিক ইভেন্ট হলে এই ইভেন্টে সোনার পদক পেতেন আথারটন। তিনি ১৭ টেস্টে ১৯ বার গ্লেন ম্যাকগ্রার বলে আউট হয়েছেন! এছাড়া এই ইভেন্টে নিজের সাথে নিজেই যৌথভাবে রূপা জিততেন আথারটন। কারণ তিনি ১৭ বার করে আউট হয়েছেন কোর্টনি ওয়ালশ এবং কার্টলি অ্যাম্ব্রোসের বলে!
মাইক আথারটনকে আউট করার জন্য ম্যাকগ্রার সূত্রটা তার চিরকালীন বোলিংয়ের মতোই সহজ সরল ছিলো-চতুর্থ স্ট্যাম্পের আটোসাটো চ্যানেলে একেবারে গুলির মতো সরল লাইনে বল করে যাওয়া। বলটাকে এদিকে বা ওদিকে সামান্য একটু মুভ করানো, যাতে এলবিডব্লু, বোল্ড বা ব্যাটের পাশ ছোঁয়া ক্যাচ চলে যায়। এই দৃশ্য এতটা নিয়মে পরিণত হয়েছিলো যে, ম্যাকগ্রা একসময় বলেই ফেলেছিলেন, আথারটনের উইকেট নিতেই মাঠে নামবেন তিনি। ২০০১ সালের হেডিংলি টেস্টে আরও করুণ হলো ব্যাপারটা। ওই ম্যাকগ্রার বলে টানা দুবার তিনি ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন উইকেটের পেছনে গিলক্রিস্টের হাতে।
৩. দিলীপ ভেঙসরকার বনাম ইমরান খান
ভারতীয় ব্যাটিংয়ের সোনালী প্রজন্মের উত্থানের আগে দেশটির অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন দিলীপ ভেঙসরকার। ১৬ টেস্টে সেই মধ্য আশির দশকে ৮টি সেঞ্চুরি করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে আইসিসির র্যাংকিংয়ে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বছর শেষ করেছিলেন। তখন সারা বিশ্বেরই অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন এই ভেঙসরকার। কিন্তু তারই খুব বড় একটা দুর্বলতা ছিলো পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এই দলটির বিপক্ষে ব্যর্থতা যতটা ছিলো, তার চেয়ে বেশি ছিলো দলটির পেসার ইমরান খানের বিপক্ষে।
ক্যারিয়ারের পরের দিকে অবশ্য পাকিস্তানের বিপক্ষে ভালো রান পেয়েছেন ভেঙসরকার। ফলে এই দলটির বিপক্ষে তার গড়ও ভালো হয়েছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ভেঙসরকারের টেস্ট গড় ৪৪.২৭, যা তার ক্যারিয়ার গড়ের চেয়ে সামান্য বেশিই বটে। কিন্তু ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে অবস্থাটা মোটেও এমন ছিলো না। এই সময়ে তিনি টানা ৭ বার ইমরান খানের বলে আউট হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯৮০ সালের মাদ্রাজ টেস্টে প্রথম ইমরানের বলে আউট হন ভেঙসরকার, যেটা ছিলো ওই সিরিজে তার শেষ ইনিংস। তিন বছর পর তার টানা ৬টি ইনিংস ছিলো এরকম-৩, ০, ৭৯, ৬, ১ ও ৪। এই ৬ ইনিংসেই ভেঙসরকার আউট হন ইমরান খানের বলে। শেষ অবধি তিনি ইমরানের হাত থেকে বেঁচে ৫৮ রানের অপরাজিত একটা ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তান ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে সিরিজে।
৪. গ্রায়েম গিক বনাম কার্টলি অ্যাম্ব্রোস
জিম্বাবুয়েতে, তখনকার রোডেশিয়ায় জন্ম নেওয়া গ্রায়েম হিক ইংল্যান্ডে ৭ বছর খেলে নিজেকে ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলার জন্য যোগ্য করে তোলেন। ৫৭টি প্রথম শ্রেণীর সেঞ্চুরি কাঁধে নিয়ে তার টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো। অভিষেকের আগে থেকেই মনে করা হচ্ছিলো, ইংল্যান্ডের ভবিষ্যত কান্ডারি হতে যাচ্ছেন এই হিক। যদিও নানা কারণে ক্যারিয়ারটা সেরকম প্রশস্ত হয়নি। তবে বারে বারে ঝলকটা দেখিয়েছিলেন।
লিডসে টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ানক পেস আক্রমণের বিপক্ষে। মার্শাল, ওয়ালশ, প্যাটারসন ও অ্যাম্ব্রোস ছিলেন সেই আক্রমণে। এর মধ্যে অ্যাম্ব্রোস হয়ে উঠলেন হিকের ঘাতক। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারে ১১ বার হিক আউট হয়েছেন এই অ্যাম্ব্রোসের বলে।
হিককে শেষবারের মতো ফাস্ট বোলিংয়ে কঠোর পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো ল্যাঙ্কারশায়ারের ওয়াসিম আকরামের বিপক্ষে। ওয়াসিম তাকে যে পদ্ধতিতে আউট করেছিলেন, পুরোটা ক্যারিয়ার জুড়ে হিককে একই উপায়ে ভুগিয়েছেন অ্যাম্ব্রোস। হেডিংলিতে প্রথম ইনিংসে হিক আউট হয়েছিলেন ওয়ালশের বলে। এরপর টানা ৬ ইনিংসে তিনি ওই অ্যান্টিগার তারকার বিপক্ষে ৬,০, ৪৩, ০, ১৯ ও ১ রানে আউট হন। এরপর দল থেকেই বাদ পড়েন। অ্যাম্ব্রোসের বলে ১১ বার আউট হওয়ার পাশাপাশি ৮ বার আউট হয়েছেন ওয়ালশের বলে।
৫. শচীন টেন্ডুলকার বনাম জেমস অ্যান্ডারসন
শচীন টেন্ডুলকার ৩২৯ বার টেস্টে ব্যাটিং করতে নেমেছেন। এর মধ্যে চারজন বোলার টেন্ডুলকারকে ৫ বার বা তার বেশি সময় তাকে আউট করতে পেরেছেন। ম্যাকগ্রা ও জেসন গিলেস্পি ৬ বার করে আউট করেছেন। মুত্তিয়া মুরালিধরন ৮ বার আউট করেছেন টেন্ডুলকারকে। আর এই তালিকায় সবার ওপরে আছেন জেমস অ্যান্ডারসন। তিনি ৯ বার শচীনের উইকেট নিয়েছেন। দুবার বোল্ড, তিনবার এলবিডব্লু, দুবার উইকেটের পেছনে ক্যাচ এবং দুবার স্লিপে ক্যাচ। অ্যান্ডারসন খেলেছেন, এমন ১৪টি টেস্টে শচীনের গড় মাত্র ৩২.১৬।
কেউ ভাবতে পারেন, টেন্ডুলকার যখন অবসর নিয়েছেন, এটা অ্যান্ডারসনের জন্য একটা আফসোস হয়ে রইলো। কারণ বয়সের সাথে সাথে জিমি অ্যান্ডারসনের ধার আরও বেড়েছে। সম্প্রতি শেষ হওয়া সিরিজে টেন্ডুলকারকে পেলে অ্যান্ডারসন নিশ্চয়ই রেকর্ডটা আরও সমৃদ্ধ করে রাখতেন। আবার উল্টোভাবেও ভাবা যেতে পারে। ক্যারিয়ারের প্রথম ১৬ বা ১৭ বছর শচীন যে অ্যান্ডারসনকে মোকাবেলা না করেই পার পেয়েছেন, এটাও একটা বড় ভাগ্য!