সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান সম্পর্কে নতুন করে বলার কি কিছু আছে? ৫২ টেস্টে ৯৯.৯৪ গড়, ২৯ সেঞ্চুরি, ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি, ৫ টেস্টের এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ৯৭৪ রান- এই ভদ্রলোক সম্পর্কে আর কিছুই তেমন অজানা নেই। তারপরেও এই লেখায় এমন কিছু তথ্য খুঁজে আনার চেষ্টা করা হয়েছে যা হয়তো অধিকাংশ পাঠকেরই জানা নেই। সব মিলিয়ে ১১টি তথ্য আছে এই লেখায়, ফলে একে স্যার ডনের অজানা একাদশ বললেও খুব ভুল কিছু বলা হবে না।
১
১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল। সেই সফরে ৫টি টেস্টসহ আরও বেশ কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে ৬টি ডাবল সেঞ্চুরি, ১০টি সেঞ্চুরি এবং ১৫টি হাফ সেঞ্চুরি করেন ব্র্যাডম্যান। ঐ সফর শেষে ৯৮.৬৬ গড়ে তার রান সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩,০০০!
২
ক্রিকেটার না হয়ে মিউজিশিয়ান হলেও খারাপ করতেন না ব্র্যাডম্যান। ১৯৩০ সালের অ্যাশেজ জিতে অস্ট্রেলিয়া ফেরার পরে ‘এভরিডে ইজ আ রেইনবো ডে ফর মি’ নামে একটি গান লেখেন জ্যাক লুমসডেইন নামে একজন গীতিকার, আর সেই গানের সুরকারের নাম ছিল ডন ব্র্যাডম্যান। এছাড়া পিয়ানোবাদক হিসেবেও ‘অ্যান ওল্ড ফ্যাশনড লকেট’ এবং ‘আওয়ার বাংলো অব ড্রিমস’ নামে তার দুটো গান আছে।
৩
সমগ্র অস্ট্রেলিয়াতে অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের যেসব অফিস আছে, তাদের সকলের পোস্ট বক্স নাম্বার ৯৯৯৪। এই নাম্বারটি চালু করেছিলেন ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের সেই সময়ের জেনারেল ম্যানেজার স্যার চার্লস মোজেস। ব্র্যাডম্যানের সাথে গভীর বন্ধুত্ব ছিল এই ভদ্রলোকের। বন্ধুর অতিমানবীয় ব্যাটিং গড় ৯৯.৯৪’ এর সম্মানে চমৎকার এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেন তিনি।
৪
ব্যাটসম্যানদের জন্য এক আতঙ্কের নাম নার্ভাস নাইন্টি। গোটা ম্যাচ দুর্দান্ত খেলা ব্যাটসম্যানও কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যান নব্বইয়ের ঘরে এলে। তবে ব্র্যাডম্যানের এসব কিছুর বালাই ছিল না, নড়বড়ে নব্বইয়ের আতঙ্ক কখনোই কাবু করতে পারেনি তাকে। একবার অবশ্য ২৯৯ রানে থেমে যেতে হয়েছিল, সেটাও নিজের দোষে নয়। অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলে থেমে যায় অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। তাই ২৯৯ রানেই অপরাজিত থাকতে হয় তাকে।
৫
ডিজনির একটা বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র আছে, যার নাম ডোনাল্ড ডাক। পাঠক শুনলে হয়তো অবাক হবেন, ওয়াল্ট ডিজনি এই ডোনাল্ড ডাক চরিত্রটা সৃষ্টি করেছিলেন ব্র্যাডম্যান থেকে।
১৯৩২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে অস্ট্রেলিয়া, সেই সফরের পরে আমেরিকা যায় তারা। মে থেকে আগস্ট এই চার মাসে প্রীতি ম্যাচ, প্রদর্শনী ম্যাচ মিলিয়ে ৫১টি ম্যাচ খেলে। এর মধ্যে ৫০ ম্যাচে স্যার ডন রান করেন ৩,৭৬৫। আর একটি ম্যাচে করেন শূন্য, মানে ডাক। ব্যাটসম্যান হিসেবে ডনের খ্যাতি তখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে, তাই পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয় বিষয়টি নিয়ে। সেগুলো চোখে পড়ে ওয়াল্ট ডিজনির, এবং এরপরেই তিনি সৃষ্টি করেন তার অমর কার্টুন চরিত্র ডোনাল্ড ডাক।
৬
অস্ট্রিয়ায় ক্রিকেটের তেমন একটা প্রচলন নেই। ইউরোপের এই দেশটি ক্রিকেটের জন্য একেবারেই পরিচিত নয়। তবে এই অস্ট্রিয়ার সাথেও জড়িয়ে আছে ব্র্যাডম্যানের নাম।
এই দেশে একটি এয়ারলাইন্স চালু ছিল, নাম লাউডা এয়ারলাইন্স। এই এয়ারলাইন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাবেক ফরমুলা ওয়ান রেসার নিকি লাউডা।
২০০২ সালে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে এই এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং বিমানের নামকরণ করা হয় ‘স্যার ডন ব্র্যাডম্যান’। বিমানটি ভিয়েনা থেকে সিডনি হয়ে মেলবোর্ন পর্যন্ত যাতায়াত শুরু করে।
গুণী মানুষদেরকে সম্মান জানানোর এই উদ্যোগ লাউডা এয়ারলাইন্সের এটাই প্রথম নয়। এর আগে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, গায়ক এলভিস প্রিসলি এবং সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র নামেও বিমান চালু করে তারা।
৭
১৯৪৮ সালের কথা। ভারতের কাঠিয়াওয়ার নামের জায়গার এক আঞ্চলিক দলের সাথে ক্রিকেট খেলছিল মহারাষ্ট্র দল। সেই খেলায় নিম্বলকর নামে এক ব্যাটসম্যান যখন ৪৪৩ রানে অপরাজিত, তখন দুই দল এবং আম্পায়ার মিলে ম্যাচটি আর না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করছিল স্যার ডনের রেকর্ড অতিক্রম করাটা উচিত হবে না।
এই ধরনের কাজ আরেকবার করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক মার্ক টেলর। এক টেস্টে ৩৩৪ রানে তিনি যখন অপরাজিত, তখন তিনি আর ব্যাট না করার সিদ্ধান্ত নেন। তারও মনে হয়েছিল, ‘স্যার’কে অতিক্রম করাটা উচিত হবে না।
উল্লেখ্য, প্রথম শ্রেণী এবং টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডনের সর্বোচ্চ সংগ্রহ যথাক্রমে ৪৫২ এবং ৩৩৪।
৮
ব্র্যাডম্যানের সময়ে ওয়ানডে নামে কিছু ছিল না। টি-টোয়েন্টি তো দূরের কথা। তাই ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি খেললে তিনি কেমন করতেন তা এখন আর জানার কোনো উপায় নেই। তবে অনুমান তো করাই যায়, তাই না?
১৯৩১ সালের ২রা নভেম্বর। নিউ সাউথ ওয়েলসের টিমমেট ওয়েন্ডেল বিলের সাথে ব্ল্যাকহিথ নামে এক জায়গায় যান ব্র্যাডম্যান, উদ্দেশ্য নতুন বানানো পিচে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলা। তখন ওভার হতো ৮ বলে। সেই ম্যাচে মাত্র ১৮ মিনিট এবং ৩ ওভারে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি! মোট রান করেছিলেন ২৫৬! এই রান করতে তিনি বাউন্ডারি মারেন ২৯টি, ওভার বাউন্ডারি মারেন ১৪টি।
প্রথম ওভার করলেন বিল ব্ল্যাক। তার ওভারে ব্র্যাডম্যান নিলেন ৩৩ রান। ৮ বলে ব্র্যাডম্যান রান নিলেন এরকম:
৬, ৬, ৪, ২, ৪, ৪, ৬, ১!
দ্বিতীয় ওভার করলেন হরি বেকার নামে আরেকজন বোলার। এর ওভারে ব্র্যাডম্যান নিলেন ৪০ রান।
৬, ৪, ৪, ৬, ৬, ৪, ৬, ৪!
তৃতীয় ওভার করতে আবার আসলেন ব্ল্যাক। তার ওভারে রান এলো ২৯, এর মধ্যে ব্র্যাডম্যান নিলেন ২৭।
১, ৬, ৬, ১, ১, ৪, ৪, ৬!
বোঝাই যাচ্ছে, আজকের দিনে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটেও নেহাত খারাপ করতেন না ডন।
৯
১৯৩৪ সালের কথা। ইংল্যান্ডে এসে অ্যাশেজ খেলেছেন, করেছেন ৩০৪ আর ২৪৪ রানের মতো দুটো দুর্দান্ত স্কোর। বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় পেটের প্রচণ্ড ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি।
সাথে সাথে হাসপাতালে নেয়া হলো তাকে। নেয়ার পরে ডাক্তাররা জানালেন, এই ব্যথার কারণ অ্যাপেন্ডিসাইটিস। অপারেশন করা হলো, প্রচুর রক্তপাত হলো ডনের। হাসপাতালে তখন উদগ্রীব শুভাকাঙ্ক্ষী আর রক্তাদাতাদের ভিড়ে দাঁড়ানো দায়। এর মধ্যে বোলার বিল ও’রিলির কাছে ফোন এলো, ফোন করেছেন স্বয়ং ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ। ও’রিলিকে তিনি বললেন, ডনের খবর যেন নিয়মিতভাবে তাকে জানানো হয়।
এদিকে ডন আর বাঁচবেন না ভেবে তার জন্য শোকগাঁথা ছাপানোর তোড়জোড় শুরু করলো পত্রপত্রিকাগুলো। স্বামীর অসুস্থতার খবর শুনে ইংল্যান্ডে পা রাখলেন জেসি ব্র্যাডম্যান, বাতাসে তখন ব্র্যাডম্যান মারা যাওয়ার খবর ভাসছে। শেষ পর্যন্ত খবরটা সত্যি হয়নি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্রিকেটানুরাগীরা।
১০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেননি ডন। তারপরেও যুদ্ধের ময়দানে উচ্চারিত হয়েছিল তার নাম!
১৯৪৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে যুদ্ধ। ইটালির মন্টে ক্যাসিনো আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে মিত্রবাহিনী, শুধু একটি সংকেতের অপেক্ষা। সেটি হলো, ‘ব্র্যাডম্যান ব্যাটিং টুমরো।’ মানে, এই বার্তা এলেই আক্রমণ করবে মিত্রবাহিনী!
সমস্যা করলো আবহাওয়া। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে সংকেত এলো ‘ব্র্যাডম্যান নট ব্যাটিং।’
প্রায় তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেল। এই সময় মোর্স কোডের মাধ্যমে ভেসে এলো সেই বার্তা। অবশেষে ব্যাট করতে নামছেন ব্র্যাডম্যান!
যুদ্ধে কী হলো, তা ভিন্ন গল্প। তবে এ গল্প থেকে বোঝা যায়, ব্র্যাডম্যান ছিলেন এমনই একজন, যিনি না থেকেও ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
১১
টানা ২৭ বছর কারাবন্দী ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। কারাভোগের ২২তম বছরে, ১৯৮৬ সালে তার সাথে দেখা করতে যান তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ফ্রেজার। নানা কথা হয় তাদের মধ্যে, ফ্রেজারকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন ম্যান্ডেলা। তার মধ্যে একটা ছিল, “মি. ফ্রেজার, ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান কি এখনও জীবিত আছেন?“
এই ঘটনার ৭ বছর পরে আবার দেখা হয় তাদের। তখন আর বন্দী অবস্থায় ছিলেন না ম্যান্ডেলা। ফ্রেজার তাকে ব্র্যাডম্যানের সই করা একটা ব্যাট উপহার দেন।
সেখানে লেখা ছিল,
“নেলসন ম্যান্ডেলার দুর্দান্ত অসমাপ্ত ইনিংসের স্বীকৃতিস্বরূপ।
– ডন ব্র্যাডম্যান”