মার্চের প্রবল শীতে বরফে জমে যায় ইংল্যান্ডের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, অলিগলি। সূর্যও বুঝি জমে যায় তখন, বেলা দ্বিপ্রহরেও হাসে না সূর্য। হাসি নেই ইংলিশ ক্রিকেটেও। সেখানেও বোধহয় বরফ পড়ছে, জমে গেছে পুরো। অপমানে-লজ্জায় ইংলিশ ক্রিকেট বিহ্বল, শোকস্তব্ধ। একপাশে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আনন্দ অর্জনের মানব পিরামিড, আর অন্যদিকে নত নয়নে ইংলিশ ক্রিকেটের বেদনা বিধুর বিমূর্ত ক্ষণ উপাখ্যান। সুদূর অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেইডে মঞ্চস্থ হয়েছে ইংলিশ ক্রিকেটের চূড়ান্ত উদোম চিত্র। যেন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদা ও আভিজাত্যের আসর থেকে। নাসের হুসাইনের নিষ্কম্প কণ্ঠ চিরে বেরিয়েছে,
“বাংলাদেশ টাইগার্স হ্যাভ নকড দ্য ইংলিশ লায়ন্স আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ।”
মাসকয়েক পরই গ্রীষ্ম নামবে, ইংল্যান্ডের আকাশজুড়ে হেসে উঠবে ঝলমলে সূর্য। নেচে উঠবে প্রকৃতি। চারপাশের গুমোট বেদনা কেটে যাবে। মানুষের মনে বয়ে যাবে আনন্দ হিল্লোল। ইংলিশ ক্রিকেটের কী হবে? তারাও কি অমন নেচে উঠার সুযোগ পাবে? নিদারুণ লজ্জায় জমে যাওয়া অমপমানকর এই ‘বরফ’ ঠেলে ক্রিকেটেও কি ফিরবে উপভোগ্য গ্রীষ্ম?
১.
অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস নতুন পদ ও দায়িত্ব পেয়েছেন। ইংলিশ ক্রিকেটের ‘পরিচালক’ পদটাও নতুন। ক্রিকেটার হিসেবে ২০০৭ ও ২০১১ — দু’টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা ঝুলিতে পোরার সৌভাগ্য হয়নি তার। ২০১১ বিশ্বকাপে ছিলেন অধিনায়ক, বাংলাদেশ ও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে দারুণ উত্তেজনা ছড়ানো ম্যাচে হারতে হয়েছে। ভারতের সঙ্গে অবিশ্বাস্য নখ কামড়ানো ম্যাচের ফলাফল — টাই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর জয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও সংশয়-দোলাচল পেরিয়ে তবেই পেয়েছেন স্বস্তির জয়; পুরো বিশ্বকাপটাই ইংল্যান্ডের জন্য গেছে টানটান উত্তেজনাকর। ক্রিকেট দর্শকের জন্য তা আনন্দদায়ক হলেও, ইংলিশ ক্রিকেটের জন্য বেশ অস্বস্তিকর।
সেই কবে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড, তারপর আরো ছয়টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেমিফাইনালেও ওঠা হয়নি আর। ঘরের মাঠে পরের বিশ্বকাপেও তেমন কোনো ফলাফল হোক, তা চায় না ইংলিশ ক্রিকেট; চান না নবনিযুক্ত পরিচালক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসও।
দায়িত্ব নিয়েই স্ট্রাউস ঘোষণা করেন পিটার মুরসের বিদায়, ব্যাখ্যা করেন কেভিন পিটারসেন কেন পরিকল্পনায় নেই আর। ইংলিশ ক্রিকেটের ইতিহাসে কোচদের লম্বা তালিকায় ইংলিশদেরই জয়জয়কার। দুই দফায় দুইজন জিম্বাবুইয়ান দায়িত্ব পালন করেছেন — ডানকান ফ্লেচার ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। তর্কসাপেক্ষে ইংলিশ ক্রিকেটের সুবর্ণ সময় গেছে এই দু’জনের সময়েই। স্ট্রাউস ঘোষণা করেন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কোচের নাম — ট্রেভর বেলিস; যিনি ইংলিশ নন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ান। এবং অধিনায়ক হিসেবে ইয়ন মরগানই তার কাছে আস্থার নাম।
দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস, আয়ারল্যান্ডের ইয়ন মরগান এবং অস্ট্রেলিয়ার ট্রেভর বেলিস; ইংলিশ ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি চরিত্রের কেউই ইংলিশ নন। ইংল্যান্ড বুঝি নাক-উঁচু জাত্যাভিমান ভুলে গেছে, অহঙ্কার বিসর্জন দিয়েছে; সাফল্যের মুকুট এবার কি তবে ধরা দেবে তার মাথায়?
২.
ইয়ন মরগানের কাছে শেষ ঠিকানা ঐ আকাশটাই। ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন, দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবেন, একদিন পৃথিবী জানবে তার নাম। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার, আইরিশ ক্রিকেটের ধ্রুপদী একটি প্রজন্মের একজন হয়ে রাঙিয়েছেন আন্তর্জাতিক আঙিনা, খেলেছেন স্বদেশের ইতিহাসে প্রথম বিশ্বকাপ। তবে এইটুকুতেই সন্তুষ্ট হন না তিনি, শ্বেত পোষাকের টেস্ট খেলবেন বলে শুরু করলেন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে। কিশোর বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখেছেন একদিন খেলবেন ইংল্যান্ডের হয়ে, তবে সেই যোগ্যতাটা তো অর্জন করতে হবে; ইংলিশ ক্রিকেট তাকে বরণ করে সাদরে। যেন তিনি ইংলিশ ক্রিকেটে আইরিশ উপহার।
স্ট্রাউস-কুক পর্ব পেরিয়ে ইংল্যান্ড তার উপর চাপিয়ে দেয় নেতৃত্বও। আয়ারল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করেছিলেন। ২০০৬-যুব বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানও ছিল তার। তার থেকে মাত্র ১১ রান এগিয়ে থেকে ৩৪৯ রান নিয়ে সেই আসরের সর্বোচ্চ রান ছিল চেতেশ্বর পুজারার। যুব ক্রিকেটের অধিনায়কত্বের পর এবার সর্বোচ্চ পর্যায়ের অধিনায়কত্ব; তারই কাউন্টি ক্লাব মিডলসেক্স-এর কিংবদন্তি অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস যখন তাকে ফোন করেন, তখন তিনি আইপিএল খেলছেন ভারতে। ভেবেছেন ফোনে বলা হবে — তোমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হলো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে স্ট্রাউস বলে বসেন, দলটার নেতৃত্বে বহাল থাকছো তুমিই।
“মিডলসেক্স ও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সুবাদে বহু বছর ধরে চিনি আমি তাকে। তার সক্ষমতা ও নেতৃত্ব সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল আমি। ইংলিশ ক্রিকেটের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি আর হয় না। বিশ্বকাপ ব্যর্থতায় তার কোনো দায় আমার চোখে পড়েনি। সে যেমন দল চেয়েছিল, দলটা তেমন ছিল না। তার মধ্যে ‘স্পেশাল’ একটা ব্যাপার আছে। আমার দায়িত্ব ছিল তার চাহিদামতো যোগান দেয়া।”
জহর চেনার তৃপ্তি যেন স্ট্রাউসের।
৩.
মরগান ঝেড়ে ফেলেন সংশয়। নেতার মতো আচরণ হতে হবে তার। কয়েকজন ক্রিকেটারের সামর্থ্য নিয়ে সুউচ্চ ধারণা পোষণ করেন, সুতরাং তাদের দলে রাখা চাই, যেকোনো মূল্যে।
“আমাদের মধ্যে বিশ্বাসটা বদ্ধমূল হতে হবে যে জগতের যাবতীয় সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারি আমরা। আমরা যা চাই, যেভাবে চাই, তা সেভাবেই অর্জন করবো।”
দলের প্রত্যেকের ভেতর আত্মবিশ্বাস সঞ্চারণ করেন অধিনায়ক।
“ইংল্যান্ডের পতাকায় তিনটি সিংহ — থ্রি লায়ন্স। তোমরা কি জানো এটা কেন?”
ইয়ন মরগান নিজের মতো করে তিন সিংহের ব্যাখ্যা দেন। আমাদের লড়াই করতে হবে এই থ্রি লায়ন্সের মাহাত্ম্য-মর্যাদা হৃদয়ে ধারণ করেই।
“তিন সিংহ তিনটে বিশ্বাসের প্রতীক। তোমাকে এই তিনটে ব্যাপার ধারণ করতে হবে। সাহস, ঐক্য, শ্রদ্ধা। তুমি যখন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলছো, তোমার হৃদয়ের পুরোটা জুড়েই যেন কলিজা হয়। হিম্মৎ ছাড়া যাবে না। যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো উচ্চতা পাড়ি দেয়ার সাহস রাখতে হবে। যেকোনো অর্জনের জন্য দৃঢ় হতে হবে। সাহসের সাথে মেশাতে হবে ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় যেকোনো দুরতিক্রম্য পথ সহজ হয়ে যায়। যেকোনো দুর্লঙ্ঘ্যনীয় চূড়ায় আরোহণে নির্ভীক হয়ে এগোনো যায়। ভয় জাঁকিয়ে বসে তখনই, যখন অনৈক্য মাথাচাড়া দেয়। ঐক্যহীন হওয়া যাবে না। আর রইলো — শ্রদ্ধা। পরস্পরের প্রতি, পরস্পরের আবেগ ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেই হবে। ভিন্নমত থাকতেই পারে, ধ্যান-ধারণা-চিন্তা ভিন্ন হবেই, প্রত্যেকটি মানুষই আলাদা। কিন্তু ইংল্যান্ডের পতাকাতলে ওসব মাথায় রাখা যাবে না। পরস্পরের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে আন্তরিক সম্মান।”
সাহস, ঐক্য ও শ্রদ্ধা তিনটে মিশিয়ে একজন ‘আইরিশ’ উদ্বুদ্ধ করেন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে, ইংলিশ ক্রিকেটের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হৃদয়ে ধারণ করতে উৎসাহিত করেন তিনি। আফ্রিকান, এশিয়ান, সাদা, কালো, মুসলিম, খ্রিস্টান – যা-ই হও, থ্রি লায়ন্সের পতাকাতলে সবাই এক। সবাই একটিই লক্ষ্য অর্জনে শামিল। আর তা হচ্ছে — ইংলিশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্তরণ। বিশ্বক্রিকেটের সর্বোত্তম ক্রিকেট দলে রূপান্তর।
ইয়ন মরগান প্রত্যেকটি ক্রিকেটারের প্রাণে প্রাণে সঞ্চারণ করেন, তুমি দেশটাকে প্রতিনিধিত্ব করছো। সুতরাং এই দলে এমন একটা ছাপ রাখো, এমন মনোভাব সংযুক্ত করো, যা পরবর্তীকালে অন্যদের জন্য হবে অনুসরণীয়। তোমাকে নিয়ে আলোচনা হবে, তোমার দল নিয়ে শব্দের পর শব্দ সাজানো হবে, তোমার দলটা ইতিহাসে স্মরণীয় হবে। আর তুমি হবে সেই ইতিহাসের গৌরবজ্জ্বল অংশীদার।
সাহস—ঐক্য—শ্রদ্ধা; সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বৈপ্লবিক রূপান্তরের অন্যতম ব্লুপ্রিন্ট।
৪.
পরিকল্পনা অনেক করা যায়, প্রত্যেক ক্রিকেটারই পরিকল্পনা করেন, এবং জানেন ক্রিকেটের মৌলিক বিষয়াদিও। কিন্তু সমস্যা হয় প্রয়োগে, বাস্তবায়নে। দর্শনতত্ত্ব নিয়ে হাজির হওয়া কঠিন কিছু না, সাজঘরে বসে সাজানোগোছানো রোমহর্ষক বক্তব্যও রাখা যায়। সুন্দর কথামালায় খানিক জীবনবোধ ও চাতুর্য মিশিয়ে ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ হওয়া যায় হয়তো, কিন্তু জীবনের চারণভূমিতে তার সত্যিকার প্রমাণ দেয়াটাই চ্যালেঞ্জের। ইয়ন মরগান চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস ভিন্নভাবে ভাবতে চান। ইংলিশ ক্রিকেটের পুরো ‘থিংক ট্যাংক’ চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন রাখতে চায়। মাঠের ক্রিকেট আগাগোড়া বদলে ফেলতে চায়। অ্যাঁদ্দিন শেকড় আঁকড়ে চেষ্টা তো অনেক হয়েছে; এবার না হয় বিপ্লব হোক। এমন বিপ্লব, যা কেবল ইংলিশ ক্রিকেট নয়, পুরো বিশ্বক্রিকেটকেই নাড়িয়ে দেবে!
নিউ জিল্যান্ডের রাগবি দল ‘অল ব্ল্যাকস’ দলটাকে খুব পছন্দ মরগানের। তারা যেভাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাগবি দলে পরিণত হয়েছে, তা মরগানকে অনুপ্রাণিত করে। মরগান পছন্দ করেন ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’ ক্রিকেট দলটাকেও, তাদের পদ্ধতিটাকে — ২০১৫ বিশ্বকাপে যেভাবে প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হয়েছে। মরগান তার দলটাকে বিশ্বের সেরা দেখতে চান, আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে চান, ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, তাকে বার্তা দিতে চান — বাছাধন, সামনে এলে উড়িয়ে দেব কিন্তু!
অ্যালেক্স হেলস, জ্যাসন রয়, বেন স্টোকস, ইয়ন মরগান ও জস বাটলার প্রথম ছয়জনের পাঁচজন হবেন এরা। আর বাকিজন জো রুট — তিনি অ্যাংকর রোল প্লে করবেন। ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এমন একটা দল দাঁড় করাতে চায়, যারা প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেবে, ত্রাস ছড়াবে বিরোধী শিবিরে। প্রত্যেকটা ক্রিকেটারই হবে ‘ইন্ডিভিজ্যুয়াল’ ম্যাচ উইনার। স্পিনাররা হবে উইকেট টেকার। বোলাররা প্রত্যেকেই ব্যাটিংয়েও ‘সাপোর্ট’ দেবেন প্রয়োজনমাফিক। পুরো দলটা চিন্তা-চেতনা-ধ্যান-ধারণায় কিছুতেই সেকেলে হবে না, হবে আধুনিক, হবে আগ্রাসী। প্রতিপক্ষকে ছিঁড়েখুড়ে খাবে একদম। উইলি-প্ল্যাঙ্কেট-ওকসের মতো বোলিং অলরাউন্ডাররা প্রাধান্য পান, অ্যান্ডারসন-ব্রডের মতো ঝানু শিকারীদেরও এই আঙিনা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
৫.
চাপ নেয়ার কিছু নেই। সহজ ক্রিকেটটাই খেলতে হবে। কাউন্টি ক্রিকেটে আমরা যেমন খেলি, তেমনটাই। আহামরি কোনো ব্যাপার না। নির্ভার হওয়ার মন্ত্র আউড়ান মরগান। হ্যাঁ, দলটা এমন দাঁড়াচ্ছে, যেকোনো সময় ধ্বসে যেতে পারে। চালিয়ে খেলতে গেলে সবারই ঠিকানা হতে পারে প্যাভিলিয়ন। হলে হবে, নেতিবাচক কিছু মাথায় ‘ঠাঁই’ দেয়া যাবে না। অল্পতেই গুটিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। সাত নাম্বারে মঈন খেলবেন, তারও আছে চালিয়ে খেলার স্বাধীনতা। মঈনের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে দলে আসেন স্যাম বিলিংস, আরেকজন মারকুটে। ইংলিশ ম্যানেজমেন্টের স্পষ্ট বার্তা — এবার তবে ভিন্ন কিছু হোক।
মরগান আগেই বলেছিলেন দলটাকে সাহসী হতে হবে, সাহসী প্রাণে কোনো ডরভয় খেলা করে না। কেউ ফিসফিসিয়ে বলতে চান, ‘আরে দলটা তো সত্তরেও গুটিয়ে যেতে পারে!’ তাদের থামিয়ে দেয়া হয় — শুধু নেতিবাচক কথা কেন বাপু? দলটা তো কল্পনাতীত এক সুউচ্চ চূড়াতেও চড়তেই পারে!
নটিংহ্যামে তেমনই ইতিহাস গড়ে ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মরগানের দল বিনির্মান করেন ৪৮২ রানের সর্বোচ্চ চূড়া, এযাবৎকালে কেউ সৃষ্টি তো দূরে থাক, অতটা উপরে ওঠা যে যায়, তাও ভাবেনি!
বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়ে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ৪০৮ রানের বিরাটকায় পর্বত; যেন ইংলিশ ক্রিকেটের বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রাথমিক স্টেটমেন্ট। পুরো সিরিজজুড়েই আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের দারুণ পসরা। যে ম্যাককালামের নিউ জিল্যান্ড মরগানের খুব পছন্দ, সেই দলের বিপক্ষেই মরগান রাখেন মহা পরিবর্তনের জবরদস্ত প্রমাণ। শুকনো কথায় চিড়ে ভেজে না, মরগান জানেন তার দর্শন ও কথামালার প্রায়োগিক উপস্থাপনা প্রয়োজন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া প্রয়োজন। শান্ত, ধীরস্থির কিন্তু দৃঢ় মরগান দলটাতে নিজের প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি দলটাকে করে তোলেন দুর্বার ও সাহসী। মাত্র এক বছরের মধ্যেই দলটার আমূল বদলে যাওয়ার দেখা মেলে টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে — ভারতে অনুষ্ঠিত হয় যা।
৬.
সারা বছর যতই আনন্দদায়ী ক্রিকেট হোক, প্রতিপক্ষকে যতই দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া হোক, বিশ্বক্রিকেটের কাছে নিজেদের ‘ক্রিকেট ব্র্যান্ড’ প্রদর্শনের সর্বোত্তম মঞ্চ হচ্ছে বিশ্ব আসর। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের গ্রুপে শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নের পাশাপাশি আছে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকা, আছে বিপদজনক আফগানিস্তানও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে পরাজয় দিয়ে শুরু। দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাপার আরো কঠিন করে ছাড়লেন। ২৩০ রান চেজ করে জিততে হবে। বিশ্বমঞ্চে এতটা তাড়া করেনি কেউ আগে, পুরো টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে দক্ষিন আফ্রিকার দেয়া ২৩২ রানের টার্গেটই কেবল সফলতার সঙ্গে উতরে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রিস গেইল, মারলন স্যামুয়েলস, আন্দ্রে রাসেল, ড্যারেন স্যামি, কাইরন পোলার্ড দলে থাকলে যে উচ্চতা পাড়ি দেয়ার সাহস করা যায়, তা সাধারণ ক্ষেত্রে নিশ্চিত অলীক কল্পনা।
কিন্তু মরগানের দলটা যেকোনো উচ্চতা পাড়ি দেয়ার হিম্মৎ রপ্ত করে নিয়েছে ততদিনে। হয় ছক্কা, নয় অক্কা। শুরু থেকেই তাই বেধড়ক পিটুনি। দুই বল বাকি থাকতে ইতিহাসও গড়া শেষ। বিশ্ব ক্রিকেটকে, বিশ্ব মঞ্চেই যেন ইংলিশ ক্রিকেট জানিয়ে দেয় — নতুন পথে চলতে হবে, ভাঙিয়ে দিলাম ভয়।
সেমিফাইনালে নিউ জিল্যান্ড-বাধা টপকে ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি ইংল্যান্ড; সেই নিউ জিল্যান্ড — যাদের বিরুদ্ধেই শুরু হয় এই নববিপ্লবের নতুন ধারা; যে দলের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সে আন্দোলিত হয়েছিলেন ইংলিশ দলপতি, যে দেশের রাগবি দলটাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তিনি, নিজের দলটাকে গড়ে তুলতে চান অমন বিশ্বসেরা ও ভীতিজাগানিয়া। এবং বছরকয়েক পর যে দলটার বিপক্ষে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ এক ক্ল্যাসিকের জন্ম দেবে ইংল্যান্ড!
সেই ক্ল্যাসিকের বছরতিনেক আগে কলকাতার নন্দন কাননে (ইডেন গার্ডেন) সমাপনী মঞ্চে আরো একটি ক্ল্যাসিক উপাখ্যান। “কার্লোস ব্রাফেট, রিমেম্বার দ্য নেইম!” সবাই ভুললেও ভুলবেন না স্টোকস। ইংলিশ ক্রিকেট দলটাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন ইয়োন মরগান, পুরো ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট দিয়েছে তাকে। প্রত্যেক ক্রিকেটার পেয়েছেন নিজের মতো খেলার অপার স্বাধীনতা। ম্যানেজমেন্টের বিশ্বাস-ভরসা ও দলটার নিবেদন ও সাধনার ‘সোনালী প্রাপ্তি’ যখন প্রায় নিশ্চিত, তখনই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের অবাক রূপকথা। পরপর চার বলে চারটি ছয়ে ধূলিস্মাৎ ইংলিশ ক্রিকেটের স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা। পুরো ম্যাচেই ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়টি শেষ ওভারে এসে কেন যেন আর পারলেন না; মাথা নুয়ে বসে পড়লেন স্টোকস। তাকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে আসেন রুট, মরগান ও অন্যরা।
তারা ঐক্যবদ্ধ, দলের কঠিন দুঃসময়ে বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। তারা সাহসী, পরাজয়ে ডরে না বীর। তারা নিজেদের অর্জনে সম্মানিত। ইংলিশ ক্রিকেটের পতাকায় থ্রি লায়ন্স, তিন সিংহ তিনটা প্রতীক — সাহস-ঐক্য-শ্রদ্ধা; তারা আত্মস্থ করে নিয়েছেন তা।
৭.
ইয়োন মরগান ভাবলেন অধিনায়কত্বটা বুঝি গেল এবার। বাংলাদেশ সফরে ‘না’ করে দিয়েছেন তিনি। ঢাকায় হলি আর্টিজান হামলায় কেঁপে উঠেছে পুরো বাংলাদেশ, স্তব্ধ জনজীবন। মাসখানেকের মধ্যেই ইংল্যান্ডের পূর্ণাঙ্গ সফর। মঈন, রুট, স্টোকস, বাটলারদের অসম্মতি নেই, কিন্তু মরগান নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। সমালোচনায় মুখর ইংলিশ ক্রিকেটবোদ্ধা, সাবেক ক্রিকেটার, বিশ্বক্রিকেটের রথী-মহারথী ও বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুরাগী দর্শককুলও। আইসিসি ও ইসিবি যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হতো, তাহলে তো দল পাঠানোর কথাই ওঠে না! বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্সিয়াল নিরাপত্তা দেয়া হবে পুরো দলটাকে। তারপরও শঙ্কা কীসের?
কিন্তু মরগানের সতীর্থরা নেতার সিদ্ধান্তের সাফাই দেন। মরগানের অনুপস্থিতে যেই জস বাটলার সাদা বলের ক্রিকেটের আর্মব্যান্ড পরবেন, তিনি সবচেয়ে মুখর। মঈন আলী, বেন স্টোকস সবাই মরগানের পক্ষে। প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার আছে। আমাদের সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া উচিৎ। মরগান যেই ঐক্যের কথা বলেছিলেন, বোঝা যায়, দলটায় সেই ঐক্যের শেকড় এখন অনেক গভীরে।
বেন স্টোকস ভুল করে ব্রিস্টলে হাতাহাতি কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পরে অনুতপ্ত হয়েছেন, অনুশোচনায় নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন বারবার। সংশোধন হয়ে ফিরেছেন। নিজেকে সামলে নিয়েছেন। পরিশ্রম, নিবেদন, নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তীতা দিয়ে নিজেকে বদলে নিয়েছেন আগাগোড়া। সতীর্থরা তাকে বরণ করে নিয়েছে উষ্ণ সম্ভাষণে। ‘আমাদের নতুন করে প্রমাণের কিছু নেই। আমরা পরস্পরকে বিশ্বাস করি।’ মরগান আরো একবার প্রমাণ রাখেন ইংল্যান্ড ক্রিকেটের ঐক্য ও সংহতি প্রসঙ্গে।
মঈন আলী ধর্মপ্রাণ মুসলিম। আইপিএলে চেন্নাইয়ের হয়ে খেলবেন, কিন্তু জার্সিতে কোনো মদ্য-প্রতিষ্ঠানের লোগো নিয়ে খেলতে চান না তিনি, সিএসকে কর্তৃপক্ষ সে সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে অকপটে অনুমোদন করেছে তা। কিন্তু বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত লেখিকা তসলিমা নাসরিন, যিনি দীর্ঘকাল ধরে ভারতে অবস্থান করছেন — তিনি প্রশ্ন তুললেন মঈনের ব্যাপারে। ‘মঈন যদি ক্রিকেট না খেলত, তাহলে নির্ঘাত কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দিত!’ আর তাতেই মঈন আলীর ইংলিশ সতীর্থবৃন্দ সোচ্চার। সাকিব মাহমুদ, জোফরা আর্চার, স্যাম বিলিংস কেউই ছাড়লেন না তসলিমাকে, মঈনের পাশে দাঁড়ালেন সবাই। লেখিকা তো আর ইংলিশ ক্রিকেটের ঐক্য ও বোঝাপড়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন!
৮.
গ্রাহাম থর্প ইংল্যান্ডের ব্যাটিং কোচ। শ্বেত বলের ক্রিকেটে তিনি দায়িত্ব নিয়ে দেখলেন এই ক্রিকেটারদের অনেকে বল পেটাতে পারলেই খুশি। তিনি এই স্টাইলকে বদলানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না, ওদের নিরুৎসাহিতও করলেন না। পেটাও, ছাল তুলে নাও বলের, তবে একই সঙ্গে ব্যাটিংয়ের ন্যুনতম টেকনিক ও বেসিকটা মাথায় রেখো। ভালো বলকে সম্মান করো।
ট্রেনিংয়ে ইংল্যান্ড ব্যবহার করতে শুরু করে পাতলা ব্যাট। গায়ের সমস্ত জোর এক করে সেই পাতলা ব্যাট দিয়ে খেলতে হয়। ম্যাচে যখন তার চেয়ে ভারি ব্যাট থাকে, রিফ্লেক্স ও টাইমিং স্বাভাবিকভাবেই ভালো হয়। অনুশীলনে নানা রঙের ও ওজনের বল থাকে, ব্যাটিংয়ে বা হিটিংয়ে ভারি বল ব্যবহৃত হয়। তাহলে মূল ম্যাচে হিটিং সহজ হয়, কারণ তখন বল তুলনামূলক কম ওজনের হয়। স্লিপ ক্যাচিংয়েও উন্নতির দরকার পড়ে। ক্যাচ প্র্যাকটিসে রাখা হয় ভিন্ন ভিন্ন রঙের বল। তাহলে সুইং ও সিমে হতচকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কম। কোচিং স্টাফ জানেন, এই ক্রিকেটাররা প্রকৃতিগতভাবে আক্রমণাত্মক। সুতরাং, ওদের সেই প্রবৃত্তি উল্টে দেয়ার প্রয়োজন নেই, বরং ওদের টেকনিক ও দক্ষতা আরো নিশ্ছিদ্র করাই উত্তম। ওরা আরো ত্রুটিমুক্ত হোক, এবং আক্রমণ করুক।
অতি-আক্রমণাত্মক ক্রিকেট অনেক সময় বুমেরাং হয়ে ধরা দিয়েছে। অনেক সময় ফল উল্টে গেছে। অল্পতেই গুটিয়ে যেতে হয়েছে, একসঙ্গে সবাই ব্যর্থ হয়েছে। ক্রিকেটে এমন হতেই পারে। আপনার হাতে যদি অনেক ম্যাচ উইনার থাকে, সবাই একসঙ্গে গুবলেট পাকাবে আচমকা একদিন, হয়তো তা কুড়ি-পঁচিশ ম্যাচে একবার। কিন্তু সেই একদিন যদি বড় ম্যাচে হয়, বড় টুর্নামেন্টে হয়, তাহলেই সব শেষ। এতদিনকার সব পরিশ্রম পণ্ড। যেমন হয়েছিল ২০১৭ সালে স্বদেশের মঞ্চে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ব্যর্থ পুরো ইংল্যান্ড। কিন্তু সাহস ও সুমহান ঐক্যের ভিতে দাঁড়ানো ইংল্যান্ড সেই সময়ের পাওয়া শিক্ষা জমা করে রাখে আরো বড় মঞ্চের জন্য। এমন একদিন আসবে যেদিন ইতিহাসের পাতা দৃপ্ত গর্বে টুকে রাখবে ইংলিশ ক্রিকেট ও এই সময়ের ক্রিকেটারদের।
৯.
‘ইয়োন মরগানের মতো অধিনায়ক হয় না, সে অতুলনীয়। আমি যত অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলেছি, তার মধ্যে সে-ই সেরা।’
অকপট স্বীকারোক্তি মঈন আলীর। মরগানের ‘আইরিশ ভাগ্য’ পক্ষে পেলে জো রুটের মতো নিরেট কোনো ইংলিশের আপত্তি নেই, আঁতে ঘা লাগে না। আদিল রশীদের আল্লাহকে অনায়াসে মেনে নেন মরগান — ‘আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সঙ্গে ছিলেন’ বলেন কোনো অস্বস্তি ছাড়াই।
দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া জেসন রয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জোফরা আর্চার, নিউ জিল্যান্ডের জন্মগ্রহণকারী বেন স্টোকস, এশিয়ান বংশোদ্ভুত আদিল রশীদ বা মঈন আলী। আয়ারল্যান্ডের ইয়োন মরগান তো আছেনই। কঠিন ধর্মপ্রাণ মুসলিম মঈন-আদিল, খ্রিস্টধর্মের অনুসারী অন্যরা; কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিস জর্ডান বা জোফরা আর্চার, শ্বেতাঙ্গ অন্যরা। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র-দেশ-সংস্কৃতি, কোনো কিছু নিয়ে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই। ভিন্ন মত-পথ-সংস্কারে কোনো অভিযোগ নেই, আছে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা, পরস্পরের প্রতি সম্মান; আহ্লাদ-আদরে বেড়ে উঠা জো রুট, আর জীবনের নানান চড়াই-উৎরাই পেরোনো জনি বেয়ারেস্টো মিলে যান এক বিন্দুতে। কোনো অনুযোগ নেই, ভেদাভেদ নেই। যেন ‘সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ প্রবাদটারই জয়জয়কার। তারা যেন সবাই রাজা, রাজত্বটা যে তাদেরই!
কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান দেশের সর্বস্তরের নাগরিক নিয়ে যে ঐক্য গড়ে তুলতে চান, তার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা যেন! চাইলে ইংলিশ-প্রধানমন্ত্রী আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন তার ক্রিকেট দলকেই। পুরো বিশ্বজুড়েই যে ঘৃণা-রেষারেষি-বিভেদ আর ধর্মীয় উগ্রতা, পারস্পরিক সমঝোতা ও শ্রদ্ধার অভাব, সেসবের বিপরীতে সুন্দরতম ‘রোল মডেল’ হিসেবেও দাঁড়াতে পারেন ইয়োন মরগানের এই ইংল্যান্ড।
ইয়োন মরগান পতাকার থ্রি লায়ন্স নিয়ে তিনটে বিশ্বাস ধারণের কথা বলেছিলেন। সাহস ও ঐক্যের সঙ্গে শ্রদ্ধা। ইংলিশ ক্রিকেট দল যে শ্বেত বলের ক্রিকেটে আজকের দিনে প্রায় অপ্রতিরোধ্য — মূলে কিন্তু এই বিশ্বাসটাই।
১০.
ওডিআই ক্রিকেট মোটাদাগে বদলে যায় ‘৯২ বিশ্বকাপে। মার্টিন ক্রো — যাকে ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কের অধিকারী বলে রায় দেন প্রায় সব ক্রিকেটবোদ্ধা। তিনি মার্ক গ্রেটব্যাচকে দিয়ে পিঞ্চ হিটিংয়ের দারুণ প্রয়োগ দেখান। ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার নিয়ম পুরোমাত্রায় উসুলের চেষ্টা। পরে সেই ধারণাটাই লুফে নিয়ে অর্জুনা রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। সনাৎ জয়সুরিয়া ও রমেশ কালুভিথারানা ‘৯৬ বিশ্বকাপে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। প্রায় ম্যাচেই শুরুতেই প্রতিপক্ষকে পর্যদুস্ত করে দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তারা। জয়সুরিয়া ক্যারিয়ার জুড়েই করে গেছেন তা। এই ধারণাটাই পরে প্রায় প্রত্যেকটা দলই অনুসরণ করেছে।
টি-টোয়েন্টির আবির্ভাব ও রমরমা আসর আয়োজনের পর ক্রিকেটে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে চোখে লাগার মতো, বা যুগান্তকারী পরিবর্তন বলতে যা বোঝায় তেমনটা কই?
২০১৫ বিশ্বকাপে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম অন্যরকম চেষ্টা চালালেন। একরত্তি ছাড় নেই প্রতিপক্ষের। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ — আক্রমণই শেষ কথা। এই ধারণাটা লুফে নেন স্ট্রাউস, বলেন বন্ধুপ্রতিমের এই চিন্তাটাই কাজে লাগাতে চান ইংল্যান্ড দলে। সম্মতি দেন ইয়োন মরগানও, তিনিও চান এভাবেই দলটাকে গড়তে। মরগানের ইংল্যান্ড প্রতিপক্ষকে শুধু হারিয়ে ক্ষান্ত হয় না, চূড়ান্ত অপদস্ততাও উপহার দেয়। চাইলেই অবশ্য এমন অতি-আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলা যায় না। ম্যাককালামের পর যা নিউ জিল্যান্ড পারেনি, এমনকি বিশ্বকাপ ছাড়া সেভাবে ম্যাককালামের সময়ই হয়নি আসলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এত এত মারকুটে থাকার পরও পারে না ওরা। শ্রীলঙ্কাও চেষ্টা করেছে তরুণ-আগ্রাসী ক্রিকেটার দলে ভিড়িয়ে। ঠিক জমেনি। পাকিস্তানের ইদানীংকার প্রচেষ্টা অনেকটা সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। অস্ট্রেলিয়া পালাবদলের মধ্যেও আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টার কমতি রাখছে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, চাইলেও সম্ভব নয়। এই হাইস্কেলে আক্রমণ পুরো ম্যাচজুড়ে চালাতে গেলে তেমন প্রতিভাবান ক্রিকেটার দলে থাকা চাই, একইসঙ্গে চাই দলে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহনে পারঙ্গম সাহসী অধিনায়কের, চাই দুর্দিনে সমর্থন যোগানো ম্যানেজমেন্ট। ইংলিশ ক্রিকেটে দুর্দান্ত কিছু খেলোয়াড়ের সন্নিবেশ হয়েছে, যারা হাইরিস্কের এই অতি-আগ্রাসী ক্রিকেট খুব সহজেই প্রয়োগ করতে পারেন। নিজের কাজটা ভালো বোঝেন প্রত্যেকে। বিপরীত দিকে বয়ে যাওয়া বাতাস পক্ষে আনতে জানেন তারা, দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করতে পারেন তারা; তাই ইংল্যান্ড দিনে দিনে হয়ে উঠে আরো দুর্বার, আরো ক্ষিপ্র, আরো দুর্দমনীয়।
১১.
হাঙ্গেরির জন্য এখনো অনেকেই আফসোস করেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত অন্য গ্রহের ফুটবল খেলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিততে পারেনি দলটা। ইংলিশ ক্রিকেট তেমন আফসোসের খাঁচায় বন্দী হতে হতেও হয়নি। ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সাদা বলের ক্রিকেটে সবচেয়ে দাপুটে ক্রিকেট দলটা পায় শ্রেষ্ঠত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। যে আসর থেকে একদা বিদায় দেয়া হয়েছিল ‘নকআউট’ পাঞ্চ দিয়ে, যে মঞ্চ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল তীব্র বিষাদ আর অপমানের জ্বলুনি নিয়ে, সেই মঞ্চেই ইংলিশ ক্রিকেট সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত। যে রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল একদা, বিদ্রুপ-দুয়ো ভেসে আসছিল অবারিত, সেই রাজাই জনতার হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা নিয়ে গ্রহণ করেন বিজয়-মুকুট।
ইংল্যান্ডের মনোরম গ্রীষ্মে, ঝকঝকে নীলাকাশের নীচে ইংলিশ ক্রিকেটে নামে বসন্তের ভরা যৌবন। বৈপ্লবিক রূপান্তরে চূড়ান্ত পরিণতিতে ইংলিশ ক্রিকেট পায় পরম আরাধ্যের সেই সোনালী ট্রফি, বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তকমা সঙ্গে ইংলিশ ক্রিকেটে মৌ মৌ সুর তুলে উপভোগ্য উষ্মাগম।