এরিক (রদ্রিগোর বাবা)
দুর্দান্ত এক সময় যাচ্ছে। রদ্রিগো একের পর এক ম্যাচ খেলছে, আর ইউরোপের বড় বড় সব ক্লাবের প্রস্তাব আসছে আমাদের কাছে। আমার মনে আছে, রদ্রিগোর রুমের দেয়ালে রিয়াল মাদ্রিদের একটা পোস্টার ছিল। আর প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে ঐ পোস্টারের দিকে একবার তাকাত। পরে আমি তো তাকে একটা রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি কিনে দিলাম। বলা তো যায় না, যদি তারা আসলেই ওকে কিনে ফেলে। জানতাম, মাদ্রিদ আমার ছেলেকে চোখে চোখে রাখছে। কিন্তু একদম তাদের কাছ থেকে কিছুই তখনও শুনিনি।
তাই, আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম, করতেই থাকলাম। একসময় ইউরোপের অন্য এক ক্লাবের সাথে চুক্তিটা প্রায় হয়েই গিয়েছিল। শুধু রদ্রিগোর স্বাক্ষরটা করাটা বাকি।
রদ্রিগো
আমি প্রায় মেনেই নিয়েছিলাম, এ জীবনে আর রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলার সৌভাগ্য হবে না। কিন্তু মনের গহীন কোণে ১ শতাংশ আশাও তখন বেঁচে ছিল। ভিলা বেলমিরোতে ভিতোরিয়ার সাথে ম্যাচের সময় বাবা আমাকে ডেকে অন্য এক ক্লাবের প্রস্তাব পাকাপাকি করে ফেলার কথাটা জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, “কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ?”
বাবা নিরাশ করলেন। বললেন, “মাদ্রিদ থেকে কোনো প্রস্তাব নেই।”
তখন বাবাকে বললাম, “আচ্ছা আরেকটু অপেক্ষা করি।”
বাবা ভেবেছিলেন আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল কি না। যে প্রস্তাবটা এসেছে, সেটার থেকে ভালো আর কিছু হয় না। বাবা বললেন, “যেটা পাচ্ছ, সেটাই খুশিমনে গ্রহন করা উচিত।”
আমি বললাম, “আরেকটু দেখি, আরেকটু অপেক্ষা করি। এই সপ্তাহের ম্যাচে আমি তিন গোল করেই ছাড়বো।”
আমার বাবা-মা বলেছিল, তারাও এমনটাই আশা করে। কিন্তু তাদের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, আমার কথা তারা বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।
ম্যাচটা শুরু হলো।
২২, ২৬ এবং ৩১ মিনিট – মাত্র নয় মিনিটের ভেতর হ্যাটট্রিক করে ফেললাম।
হাফটাইমের সময়, আমি নিশ্চিত ছিলাম রিয়াল মাদ্রিদ আমার বাবার মোবাইল নম্বর হন্যি হয়ে খুঁজছে।
বাসায় ঢুকেই বাবাকে বললাম, “কি বলেছিলাম, হ্যাঁ? রিয়াল মাদ্রিদ ফোন করেছে না?”
বাবা আমাকে নিরাশ করলেন, “না। কিছুই তো এলো না।”
পুরো পৃথিবীটা আমার মাথায় ভেঙে পরলো। পরের দিন আমার কোনো ট্রেনিং ছিল না। আমি ভিডিও গেমস খেলছিলাম। এরপর দেখলাম, একেবারে স্যুট-বুট পরে বাবা বাইরে যাচ্ছেন। মাকে জিজ্ঞেস করতে মা বললেন, “আরেহ! তেমন কিছু না। কোনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে যেন যাচ্ছে।”
অনেক রাত করে বাবা বাড়ি ফিরলেন। আমি তখনও বসার ঘরে বসে ভিডিও গেম খেলছি। বাবা ঢুকে আমাকে কিছু না বলে সোজা আমার ঘরে ঢুকে গেলেন। এরপর যখন বেরিয়ে এলেন, তার হাতে একটা রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি, পেছনে লেখা – রদ্রিগো।
বাবা বললেন, “বাবা, তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেছে।”
আমি তার দিকে তাকালাম। এরপর, তার হাতে থাকা জার্সির দিকে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এরপর, বাবা আমাকে সবকিছু খুলে বললেন। ম্যাচটা শেষ করার পরেই তিনি রিয়াল মাদিদ থেকে ফোন পেয়েছিলেন। এরপর তিনি সাও পাওলো গিয়ে একেবারে চুক্তি পাকা করে এসেছেন। সবকিছু শেষ না হবার আগে তিনি আমাকে কিছুই বলেননি।
বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। অবিশ্বাস্য! শুধুমাত্র ঈশ্বরই এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড করতে পারেন।
এরিক
সবই নিয়তির খেল। চুক্তিটা যখন হয়, তখন ওর বয়স মাত্র ১৭ বছর। পরের বছর ও রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিল। ভাবুন তো, আপনার বয়স মাত্র ১৮ বছর, আর আপনি ইতিহাসের সেরা একটা ক্লাবের হয়ে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন যারা পাঁচ বছরে চারটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে! আর কে করেছে এমন অসাধ্য সাধন? গিয়ে দেখলেন আপনার কোচের আসনে বসে আছেন জিনেদিন জিদান। ওহ গড, জিদান! বুঝতে পারছেন আপনি?
রদ্রিগো
মাঠের বাইরে সবার সাথে মিশে যেতে একদম সমস্যা হয়নি। স্প্যানিশ শেখাটা শুরু করে দিয়েছিলাম। আর আমার ব্রাজিলিয়ান ভাইয়েরা তো ছিলই। ভিনিসিয়ুস, ক্যাসেমিরো আর মিলিতাও। মার্সেলো ছিলেন আমার পিতার সমতুল্য। কিন্তু আমাদের সবার ‘পাদ্রে’ (পিতা) কে – সেটা তো সবাই জানে!
দলের সব থেকে বর্ষীয়ান খেলোয়াড় হবার জন্য আমরা সবাই লুকাকে নিয়ে মজা করতাম। আমার চোখে তিনিই আমার সঙ্গে খেলা সেরা খেলোয়াড়। ক্যাসেমিরো একবার মজা করে বলছিল যে আমার বাবার বয়স এখন ৩৬ বছর হবে। তখন লুকা বলেছিল, “তাই নাকি? তাহলে তোমার তো আমাকে আরও বেশি সম্মান করা উচিত। কারণ আমি তোমার বাবা হতেও পারতাম।”
এরপর থেকে আমি হয়ে গেলাম লুকার ছেলে। সে আমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখে।
২০১৯ সালের অক্টোবরের কথা। তিতে ঐদিন ব্রাজিলের দল ঘোষণা করবেন। আমার আবার এই কথা একদম মনে নেই। আমি ওপরতলায় ঘুমোচ্ছি, আর নিচতলায় আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রেস কনফারেন্স দেখছে। বাবা-মা কেউ বাসায় নেই। হঠাৎ শুনি বেঢপ রকমের চিৎকার।
আমি ভাবলাম, এ আবার কী! ধুত্তোরি, হয়তো কিছুই না। আমার ঘুমাতে চলে গেলাম। এরপর দেখি আমার মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি বাবা। কী ব্যাপার, এখন বাবা ফোন দিচ্ছে কেন?
ফোন তুললাম, এখনও ঘুমের ভেতরই আছি।
ওপাশ থেকে বাবা বললেন, “ব্যাটা কংগ্রাচুলেশনস!”
“আজকে তো আমার জন্মদিন না। করলাম কী আমি?”
“আরেহ! তুমি ডাক পেয়েছো তো।”
“কোথায়? আগামীকাল তো কোনো ম্যাচ নেই।”
বাবা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। “ব্রাজিল!”
“কিহ?”
অবশেষে আমার স্মরণে এল। নিচে নেমে দেখি, টিভিতে তিতের প্রেস কনফারেন্স দেখাচ্ছে। সবাইকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা-মা বাসায় আসার পর আমরা আমার ব্রাজিল দলে ডাক পাওয়া উপলক্ষকে উদযাপন করলাম।
বিশ্বাস করবেন? আমার প্রথমবারের মতো ব্রাজিল দলে ডাক পাওয়া, আর আমি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছি।
প্রথমবার যখন ব্রাজিলের ক্যাম্পে গেলাম। আমার জীবনের নায়কদের সাথে দেখা করতেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিল। এমনকি ক্যাসেমিরো, যাকে আমি প্রতিদিন রিয়াল মাদ্রিদে দেখি – তাকেও ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে ভিন্ন এক মানুষ লাগে। শুরুটা খুবই ভয় ধরানো। প্রথমে নাম বলতে হবে, তারপর নিজের জন্মতারিখ, এরপর সবার সামনে কোনো গান গেয়ে শোনাতে হবে। আমার পালা যখন এলো, তখন আমার গলা কাঁপছিল।
“গুড ইভনিং, আমার নাম রদ্রিগো।”
সবাইকে দেখে মনে হচ্ছিল, সবাই মনে মনে বলছে, “রদ্রিগো? এ আবার কে!”
এরিক
প্রতিদিন আমি ওকে বলি, “আমার কাছে তুমিই এই পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড়।” আমি যদি আমার ছেলেকে বিশ্বাস না করি, তাহলে কে করবে? বাকিটা তার উপর, কিন্তু আমি তাকে বিশ্বাস করি। “তুমি ব্রাজিলিয়ান। কোনোদিন হাল ছাড়া যাবে না।”
ওর অর্জন দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। তবে ওর সব অর্জন হার মেনে যাবে, যদি ঐ হলুদ জার্সিটা গায়ে চড়িয়ে সে বিশ্বকাপটা জিততে পারে।
রদ্রিগো
২০টা বছর ধরে আমাদের বিশ্বকাপ খরা চলছে। ২০০৬ সালের হারের পর আমার কান্নাই থামছিল না। ২০১০ বিশ্বকাপের সময় আমি ছিলাম ওসাসকোতে। তখন দেখেছিলাম, সেখানকার মানুষেরা হলুদ আর সবুজ রঙে রাস্তাকে ভরিয়ে তুলেছে। কেউ কোনো কাজ করছে না। আর স্কুল? সেটার কথা ভুলেই যান। এমন না যে আমি স্কুলে যাইনি। আসলে স্কুলই তো ছিল না। কারণ স্কুলের শিক্ষকেরা সবাই ফুটবল ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপের সময় আমি আর বাবা খেলা দেখেছিলাম মিনাস গেরাইসে। কিন্তু ঐ বিশ্বকাপ নিয়ে আর কথাবার্তা আমি বলতে চাই না।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের সাথে হারের ঐ অনুভুতি আমি আর পেতে চাই না। ম্যাচ শেষ হবার পরেই আমি বাবাকে একটা মেসেজ পাঠাই।
“এখন আমাদের ভালোভাবে অনুশীলন করতে হবে। কারণ পরেরবার এই মঞ্চে আমি থাকবো।”
আমি জানি এই ব্রাজিলে কারও জায়গা পাকা নয়। এমনকি আমার অভিষেক এখনও হয়নি। কিন্তু আপনি আমাকে কীভাবে দোষ দেবেন? আমি বাকি সব ব্রাজিলিয়ানদের মতো, যার ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল, আর ছিল ব্রাজিলের একটা নকল জার্সি।
স্বপ্নের শক্তি আছে। আমিই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
আমি এখন বিশ্বকাপে। এবং আমি নিজে নিজেকে দেখতে পারছি। আমি নিজেকে উৎসর্গ করছি ব্রাজিলের জন্য।
আমি চাই অনন্তকাল ধরে এই স্বপ্ন চলতে থাকুক।
আমি কোনোভাবেই এই স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে চাই না।