এক যুগ আগের কথা। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎ এক অনাহূত ঝড়ে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গন, তৈরি হয়েছিল মহাসংকট। ভারতের নিষিদ্ধ ক্রিকেট লিগ আইসিএলে নাম লেখান একঝাঁক ক্রিকেটার।
জাতীয় দলের বর্তমান নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমনের নেতৃত্বে তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে থাকা মঞ্জুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিক, তাপস বৈশ্যরা যোগ দিয়েছিলেন ‘ঢাকা ওয়ারিয়র্স’ নামক দলে। কিন্তু বাংলাদেশকে বড় ধাক্কাটা দিয়েছিল ওই সময়ের তরুণ, সম্ভাবনাময়, প্রতিভাবান আফতাব আহমেদ, শাহরিয়ার নাফীস, অলক কাপালি, ধীমান ঘোষ, মাহবুবুল করিম মিঠু, মোশাররফ হোসেন রুবেলদের আইসিএল যাত্রা।
এত সব নামের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল আরও একটি নাম। তিনি ফরহাদ রেজা।
তখন ২১ বছরের টগবগে যুবক। ‘অলরাউন্ডার’ কোটায় যিনি তখন বাংলাদেশের হয়ে ৩২টি ওয়ানডে খেলে ফেলেছিলেন। সেই ফরহাদ রেজাও পাড়ি জমিয়েছিলেন আইসিএলের নিষিদ্ধ তরীতে। ঢাকা ওয়ারিয়র্সের আর সব সতীর্থদের মতো এই অলরাউন্ডারও নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ১০ বছরের জন্য, যা পরে মাফ করে দেয় বিসিবি। দেশের মাটিতে আফতাব-নাফীসদের মতো তার ক্যারিয়ারও লাইফলাইন পায়।
অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচেই হাফ-সেঞ্চুরি করেছিলেন ফরহাদ রেজা, ওয়ানডেতে পাঁচ উইকেটও আছে তার। তবে ২০০৬ সালে জাতীয় দলে তিনি ডাক পেয়েছিলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করায়। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি মিডিয়াম পেসটা করতে পারতেন বলে নির্বাচকদের আস্থার জায়গাটা পেয়েছিলেন দ্রুতই।
আইসিএল-অধ্যায়ের পর ফিরে জাতীয় দলে দু’টি ওয়ানডে খেলেছেন। ভালো করেননি, তাই ৩৪ ম্যাচেই থেমে আছে তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার। ১৩টি টি-টোয়েন্টিও খেলেছেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন, সেটা এই ক্ষুদে ফরম্যাটেই।
অবশ্য গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত নাম সেই ফরহাদ রেজা। বর্তমানে ৩২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সবার মাঝে, ব্যাটে-বলে দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখাচ্ছেন তিনি।
বয়সের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বেড়েছে, বোলিংটা আগের চেয়ে কার্যকর হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা এসেছে তার ব্যাটিংয়ে, ২২ গজে এখন প্রায়ই অগ্নিশর্মা হয়ে যাচ্ছে ফরহাদ রেজার ব্যাট। সীমিত ওভারের দুই ফরম্যাটে খুনে ব্যাটিংয়ে রীতিমতো কচুকাটা করছেন প্রতিপক্ষ বোলারদের।
গত ১ এপ্রিল মিরপুর স্টেডিয়ামে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে শেখ জামালের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে ১৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন ফরহাদ রেজা, যা লিস্ট-এ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম হাফসেঞ্চুরির রেকর্ড। ২০০৭ সালে নাজমুল হোসেন মিলনের গড়া ১৯ বলে হাফসেঞ্চুরির রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছেন তিনি। জাতীয় ক্রিকেট লিগের ওয়ানডে ম্যাচে ঢাকার হয়ে খুলনা বিভাগের বিপক্ষে ধানমন্ডি স্টেডিয়ামে এই ব্যাটিং ঝড় তুলেছিলেন নাজমুল মিলন।
চলতি বছরের শুরু থেকে ব্যাটে-বলে ঈর্ষণীয় ফর্মে আছেন ফরহাদ রেজা। বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে ১৪ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। ঠিক তার পরপরই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টিতে হয়েছেন টুর্নামেন্টসেরা। চার ম্যাচে ১১ উইকেটের পাশাপাশি ১০৭ রান, যেখানে স্ট্রাইক রেট ২২৭.৬৫! চলমান প্রিমিয়ার লিগে নয় রাউন্ড পর্যন্ত ২৫ উইকেট নিয়ে সেরা বোলার তিনি।
গত কয়েক মাসে ফর্মের মধ্যগগণে থাকা ফরহাদ রেজা একান্ত আলাপে বলেছেন ক্যারিয়ারের অতীত, বর্তমান, সময়ের সঙ্গে ক্রিকেটার হিসেবে পরিবর্তন, পরিণত হওয়ার বিষয়ে।
বিপিএল, প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টি, চলমান প্রিমিয়ার লিগে দারুণ ফর্মে আছেন আপনি। নিশ্চয়ই আগের চেয়ে ক্রিকেটটা এখনই বেশি উপভোগ করছেন…
হ্যাঁ, ইনশাল্লাহ। আল্লাহর রহমতে চেষ্টা করছি নিজের কাজগুলো ঠিকমতো করার, ওইভাবেই হচ্ছে।
এটাকে কি ক্যারিয়ারের সেরা সময় বলবেন?
হ্যাঁ, আসলে অবশ্যই খুব ভালো সময় যাচ্ছে আল্লাহর রহমতে। সব খেলোয়াড়েরই এমন সময় যায়। আমারও এর আগে আসছিল। যখন আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম, তখন এমন কিছু সময় আসছিল। ভালো সময় গেছে। হুট করে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, ‘এ’ দল, জাতীয় দলে খেলেছি। তেমনই ভালো সময় কাটছে। হ্যাঁ, এটাই ক্যারিয়ারের সেরা সময়।
মাঠে এখন আপনাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। এই পরিবর্তনের রহস্য কী?
আমার বোলিংয়ে অনেকে কাজ করেছে। যেমন শ্রী (কম্পিউটার অ্যানালিস্ট) আছে, ও অনেক সাহায্য করেছে। আর ব্যাটিংয়ে বাবুল স্যার (মিজানুর রহমান বাবুল, প্রাইম দোলেশ্বর কোচ) তো নিয়মিত কাজ করছে। উনি আমার সম্পর্কে ভালো জানে। আর আপনি জানেন, সুজন ভাই রাজশাহীতে যায় বাংলা ট্র্যাকের একাডেমিতে। ওই সময় উনিও আমার ব্যাটিং নিয়ে কিছু কাজ করছে। সব মিলিয়ে আল্লাহর রহমতে ওনাদের সাহায্যে জিনিসগুলো সহজ হয়ে আসছে এখন। ওনারা যেভাবে আমাকে বলছে, আমার কাজগুলো সহজ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ দলের অ্যানালিস্ট শ্রী’কে রংপুর রাইডার্সে পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে ঠিক কী ধরনের কাজ করেছেন আপনি, যার সুফল পাচ্ছেন?
ও আমাকে যে জিনিসটা ধরিয়ে দিয়েছে, আমি যে জিনিসটা খুব ভালো পারি, ওইটা যেন আমি ঠিকভাবে করি, ভালোভাবে করতে পারি।
এখন ২২ গজে নিয়মিতই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করছেন। হার্ডহিটিং ব্যাটিংয়ের জন্য আলাদা কোনো কাজ করেছেন?
এটা নিয়ে নিয়মিত কাজ করছি। বাবুল স্যার নিয়মিত কাজ করছেন এই জায়গায়। আমাদের বেলালের (টিম স্টাফ) সাথে কাজ করছি, ও সবসময় থ্রো করছে। কিছু নির্দিষ্ট কাজ, সেগুলো করছি। এগুলোর কারণেই আত্মবিশ্বাসটা পাচ্ছি ব্যাটিংয়ে গিয়ে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরমার হিসেবে আপনার আধিপত্যটা প্রমাণিত। কিন্তু এর পরের ধাপ, মানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা কোয়ালিটি বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে এমন পারফর্ম করার ক্ষেত্রে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী?
আত্মবিশ্বাস সবসময় ছিল, এখনও আছে। এটা নির্ভর করছে ওখানে যাওয়ার পর, ওখানে গেলে এটা বুঝা যাবে।
বয়স এখন ৩২। জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্নটা নিশ্চয়ই এখনও দেখেন…
অবশ্যই স্বপ্ন দেখি। আমাকে বিশ্বকাপের প্রাথমিক ৩০ জনের দলে রাখছে। জানি না, পরে কী হবে। অবশ্যই একটা খেলোয়াড় যতক্ষণ না অবসর নিচ্ছে, ততক্ষণ তার স্বপ্ন থাকবে জাতীয় দলে খেলার।
২০১৪ সালের পর থেকে জাতীয় দলের বাইরে আপনি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তিন ফরম্যাটে খেলা হয়, মৌসুম আসে, মৌসুম যায়। প্রতিনিয়ত পারফর্ম করার জন্য নিজেকে প্রেরণা যোগান কীভাবে?
এটা আমার পেশা, আমার রুটি-রুজি। এটা আমার কাজ। ঠিকভাবে না করলে পিছিয়ে যেতে হবে। এজন্যই সবসময় চেষ্টা করি ঠিকভাবে করার। অনেক সময় হয়তো ব্যর্থ হই। কিন্তু নিয়মিত চেষ্টা করি নিজের কাজটা ঠিকমতো করার।
আবার একটু পেছনের দিকে যাই। জাতীয় দলে এসেই টানা ৩২টা ওয়ানডে খেলেছিলেন। খেলতে থাকলে হয়তো আপনার ক্যারিয়ারটা অন্যরকম হতে পারতো। এখন কি মনে হয়, ২০০৮ সালে আইসিএল যাওয়াটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?
পাস্ট ইজ পাস্ট।
আক্ষেপ হয় না?
অবশ্যই আক্ষেপ হয়। জাতীয় দল তো জাতীয় দলই।
ক্যারিয়ারের শুরুর সময় থেকে এখন নিজের মাঝে কী ধরনের পরিবর্তন দেখেন?
আগে ম্যাচিউরিটি কম ছিল, এখন ম্যাচিউরিটি বেশি আছে। আসলে আপনি যত খেলবেন, তত আপনি শিখতে থাকবেন। অবশ্যই শেখার শেষ নাই। যত ম্যাচ খেলবেন, তত আপনার মাঝে আত্মবিশ্বাস আসবে।
এখন জাতীয় দলে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে সাইফউদ্দিন খেলছে। ঘরোয়া ক্রিকেটেও আরও কয়েকজন আছে। এদের মাঝে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে কার মাঝে ভালো সম্ভাবনা দেখেন?
যারা আছে, সবাই ভালো। ভালো না হলে জাতীয় দলে খেলতে পারবে না। আর এই পর্যায়ে টিকে থাকা কঠিন। সাইফউদ্দিন মাশাআল্লাহ খুব ভালো খেলছে। ও অনেকদিন খেলতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
অন্তত শর্টার ভার্সন হলেও জাতীয় দলে ডাক আশা করেন কি না…
আশা তো সবসময় করি। আর এটা তো আমার হাতে নাই। আমার হাতে আছে, আমি ভালো খেলতে পারি, ওটা চেষ্টা করছি। আশার তো শেষ নাই। আশা না করলে তো আপনার জীবনে আর কিছু নাই। একটা বিষয় হলো, আপনি সবসময় স্বপ্ন দেখবেন, এবং তার পেছনে ছুটবেন। সবারই চাহিদা আছে। চাহিদা শেষ হলে আর কিছু থাকে না।
আপনার এখন যেই ফর্ম, ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করছেন। নির্বাচকদের সাথে কী কথা হয়? তারা কোনো মন্তব্য করেন, বা কিছু বলেন কি?
নির্বাচকরা যাদের সাথেই দেখা হয়েছে, বলেছে, ভালো খেলা হচ্ছে। এভাবেই খেলতে থাকো।