ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মঞ্চ বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপে নিজের দেশের হয়ে অংশগ্রহণ করার স্বপ্ন বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের। অবশ্য প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সৌভাগ্য সবার হয় না। স্তেফানো, জর্জ বেস্ট, ইয়ান রাশ, এরিক ক্যতুনাদের মতো কিংবদন্তিরা খেলতে পারেননি বিশ্বকাপে। আবার অনেকে শুধুমাত্র বিশ্বকাপের অনবদ্য পারফর্মেন্স দিয়েই জায়গা করে নিয়েছেন ফুটবল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পাতায়। তেমনই কিংবদন্তিদের অনেকে আবার বিশ্বকাপের মঞ্চে ছিলেন নিজের ছায়া হয়েই।
যা-ই হোক, সার্বিক বিবেচনায় তারাই সৌভাগ্যবান যারা বিশ্বকাপে গোল করতে পেরেছেন এবং তাদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজন খেলোয়াড় বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করে তৈরি করেছেন অনন্য ইতিহাস। ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপেই প্যারাগুয়ের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ট প্যাটন্যু করেছিলেন ফুটবল বিশ্বকাপের হ্যাটট্রিকের সূচনা। ব্রাজিল বিশ্বকাপ পর্যন্ত মোট ২০ বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক হয়েছে মাত্র ৫০টি। এই ৫০টি হ্যাটট্রিকের মধ্যেও রয়েছে মাত্র ৪ জনের একটি অভিজাত শ্রেণী, যাদের কথা আলাদাভাবে স্মরণ করতেই হবে। কেননা শুধুমাত্র তারাই গড়েছেন দুটি হ্যাটট্রিকের অনবদ্য কৃত্তি।
সান্দোর কচিস
একটিমাত্র বিশ্বকাপেই দুটি হ্যাটট্রিক করা প্রথম খেলোয়াড় হাঙ্গেরির কিংবদন্তি ফুটবলার সান্দোর কচিস। কচিস ছিলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল ‘ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের’ দুর্দান্ত একজন স্ট্রাইকার ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হিসেবে সুনাম থাকলেও হেডে গোল করার জন্য কচিসকে বর্ণনা করতে হবে আলাদাভাবে। ক্লাব ও দেশের হয়ে কচিস শুধুমাত্র হেডেই করেছেন প্রায় চারশোরও বেশি গোল। হেডে বর্ণনাতীত দক্ষতার জন্য তাকে ডাকা হয় ‘দ্য ম্যান উইথ গোল্ডেন হেড’। হেডে অসামান্য দক্ষতা, দুই পায়েই শট নেওয়ার সক্ষমতা তাকে দিয়েছিলো সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর স্ট্রাইকারের খ্যাতি।
১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে প্রায় সব দলকে একরকম উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিলো পুসকাস-কচিসদের হাঙ্গেরি। দেশটির স্মরণীয় বিশ্বকাপ যাত্রায় কচিসের অবদান ছিলো মাত্র ৫ ম্যাচে মোট ১১টি গোল। কোরিয়া রিপাবলিকের বিপক্ষে ৯-০ গোলের বিশাল জয়ে ৩ গোল এবং পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৮-৩ গোলের দুর্দান্ত জয়ে ৪ গোল করেছিলেন কচিস। ‘ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স’ তথা কচিসের দুর্ভাগ্য, যে পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে পরাজিত করেছিলো হাঙ্গেরি, সেই দলের বিপক্ষেই ফাইনালে ৩-২ গোলে পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপে শিরোপা বঞ্চিত হতে হয় তাদের এবং সেই সাথে জন্ম নেয় ‘মিরাকল অব বার্ন’।
‘ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের’ কোচ গুস্তাভ সেবেস কচিস সম্বন্ধে বলেছিলেন, “হেডে তার চেয়ে ভালো কেউ নেই। কিন্তু সে একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকারও, যে বল ধরে রাখতে পারতো এবং দুই পায়েই গোল করতে সক্ষম ছিলো। ১৯৫৪ সালে তার পারফর্মেন্স শিরোপার যোগ্য ছিলো।” হাঙ্গেরির হয়ে মাত্র ৬৮ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৭৫টি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭টি হ্যাটট্রিকের মালিকও তিনি এবং একটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি জাস্ট ফন্টেইনের পরেই রয়েছেন এই কিংবদন্তি।
জাস্ট ফন্টেইন
এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ফরাসি কিংবদন্তি জাস্ট ফন্টেইনের, যেখানে কচিসের মতোই তারও ছিলো একটি বিশ্বকাপেই দুটি হ্যাটট্রিক। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপের পরের আয়োজনেই ফন্টেইন এই মাইলফলক তৈরি করেন, যা আজও ভাঙতে পারেনি কেউ। কচিসের মতো ফন্টেইনও সেই দুর্ভাগাদের একজন, দুটি হ্যাট্রিকের ও রেকর্ড গোলের পরও জিততে পারেননি বিশ্বকাপ শিরোপা। একমাত্র বিশ্বকাপে এই কিংবদন্তির ১৩টি গোলের ৭টি এসেছে ডান পা থেকে, ৫টি গোল বাম পায়ে এবং ১টি গোল হেড থেকে। অবশ্য বিশ্বকাপ জয় করতে না পারার ব্যর্থতার কাছে এরকম বড় অর্জনও হয়তো নিছকই সান্ত্বনা। নিজের রেকর্ড গোল সম্বন্ধে ফন্টেইন বলেছিলেন, “আমি গোল করতে পেরেছিলাম, কারণ শুরু থেকেই কোপার সাথে আমার দারুণ বোঝাপড়া ছিলো, কারণ একসাথে আমরা খুবই সুখী ছিলাম এবং দলটি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতো।”
নিজের একমাত্র ও শেষ বিশ্বকাপে তার সবগুলো ম্যাচেই গোল করেছিলেন এবং বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন প্যারাগুয়েকে ৭-৩ গোলে পরাজিত করআ দারুণ এক হ্যাটট্রিকের মাধ্যমে। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ফ্রান্স পরাজিত হলে ফন্টেইনের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ তখন পশ্চিম জার্মানি। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচের আগপর্যন্ত ফন্টেইনের গোল সংখ্যা ছিলো ৯টি, কচিসের রেকর্ড ভাঙতে তখন তার দরকার মাত্র ৩টি গোল। ম্যাচটিতে ফ্রান্স ৬-৩ গোলের জয় পায়, যেখানে তিনি একাই করেন ৪ গোল এবং অর্জন করেন এমন একটি রেকর্ড যা আজও অক্ষুণ্ণ।
গার্ড ম্যুলার
দুই হ্যাটট্রিক করা একমাত্র খেলোয়াড় জার্মান কিংবদন্তি স্ট্রাইকার গার্ড ম্যুলার, যিনি বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছেন। জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ৬২ ম্যাচে গোল করেছেন ৬৮টি। খুব কম স্ট্রাইকারেরই এরকম অসাধারণ ম্যাচ প্রতি গোল গড় রয়েছে। স্ট্রাইকার হিসেবে নিখুঁত একজন ছিলেন ম্যুলার। স্কিল, গতি বা শারীরিক শক্তির চেয়ে তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিলো সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকা এবং বল জালে জড়ানো। বলা যায়, এই কাজে তার চেয়ে ভালো খুব কমই ছিলো।
১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে দুটি হ্যাটট্রিক করলেও কচিস ও ফন্টেনের মতোই এই আসরে শিরোপা জেতা হয়নি এই কিংবদন্তির। আসরে মাত্র ৬টি ম্যাচে ১০ গোল করেছিলেন ম্যুলার, যার মধ্যে ছিলো দুটি হ্যাটট্রিক। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ৫-২ গোলের জয়ে ম্যুলারের হ্যাটট্রিকের কল্যাণে বড় ব্যবধানে এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি, পেরুর বিপক্ষে ৩-১ গোলের অনবদ্য জয়ের ৩টি গোলই ছিলো ‘দ্য বোম্বারের’ এবং মাত্র ২০ মিনিটে এই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন অপ্রতিরোধ্য এই স্ট্রাইকার। মেক্সিকোতে ব্যর্থ হলেও, জার্মানি ‘৭৪ বিশ্বকাপে স্বাগতিক দেশ হিসেবে জিতে নেয় বিশ্বকাপ। ফাইনালে ক্রুয়েফের নেদারল্যান্ডকে ২-১ গোলে পরাজিত করে জার্মানি, যেখানে জয়সূচক গোলটি করেছিলেন গার্ড ম্যুলার। ১৯৭০ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার ম্যুলার বলেছিলেন, “১৯৭৪ সালের চেয়ে ঐ আসর (‘৭০ বিশ্বকাপ) আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমাদের অনবদ্য একটি দল ছিলো তখন।”
গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা
আর্জেন্টিনার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকারদের মধ্যে অন্যতম সেরা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। আর্জেন্টিনার হয়ে ৭৮ ম্যাচে ৫৬ গোল করা এই স্ট্রাইকার মেসির পরেই দেশটির সর্বোচ্চ গোলদাতা। দুর্দান্ত এই স্ট্রাইকার নিজের সময়ে ছিলেন সেরাদের মধ্যে অন্যতম, গোলমুখে দুর্দান্ত এই কিংবদন্তিকে ডাকা হয় ‘বাতিগোল’ নামে। বাতিস্তুতা ফিফা বিশ্বকাপের একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি দুটি ভিন্ন আসরে হ্যাটট্রিক করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপে করা দুটি হ্যাটট্রিক হয়েছিলো একই দিনে, অর্থাৎ ২১শে জুন। আর্জেন্টাইন এই কিংবদন্তি হ্যাটট্রিক করেছিলেন গ্রিস ও জ্যামাইকার বিপক্ষে। বিশ্বকাপে দুটি দেশই প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করেছিলো।
তিনটি বিশ্বকাপে ১২ ম্যাচে ১০ গোল করা বাতিস্তুতা সম্পর্কে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, “আমার কাছে, আমার দেখা সেরা স্ট্রাইকার সে।” নিজের গোলস্কোরিং রেকর্ড সম্বন্ধে বাতিস্তুতা বলেছিলেন, “তুলনা করলে আমার কাছে গোলস্কোরিং রেকর্ড কিছু না। ঐ গোলগুলো করতে পেরেছিলাম, কারণ খেলায় আমি কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম।” রেকর্ডের তুলনায় না গিয়ে, বাতিস্তুতা চেয়েছেন লোকে তাকে একজন ভালো মানুষ এবং মহান পেশাদার হিসেবে মনে রাখুক, যিনি কিনা যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই নিজের সব কিছু দিয়ে চেষ্টা করেছেন।