প্রায় সমসাময়িক সতীর্থ সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমের ন্যায় তার ক্যারিয়ারের পথচলা অতটা মসৃণ ছিল না। সংগ্রাম করেছেন দলে জায়গা পাকা করার জন্য, সংগ্রাম করেছেন টিকে থাকার জন্য। শুরুটা হয়েছিল অফ স্পিনার হিসেবে, সাথে লোয়ার-অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে ভূমিকা পালন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পাঁচ স্বপ্নসারথি’র একজন হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
বলছিলাম মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কথা।
শুরুটা ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক দিয়ে। ব্যাট হাতে ৩৬ রান বল হাতে ২ উইকেট। বলতেই হয়, নতুন মঞ্চে ভালো সূচনা। তারও দুই বছর পর ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাটে অভিষেক। অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের ‘তৃতীয় বোলার’ হিসেবে শিকার করেন পাঁচ উইকেট। এভাবেই দলে টুকটাক অবদানে চলছিল মাহমুদউল্লাহর।
এর মধ্যে এলো ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রায় হারতে বসা ম্যাচে শফিউল ইসলামের সঙ্গে নবম উইকেটে ৫৭ রানের অসাধারণ এক জুটিতে দলকে জয়ের বন্দরে পোঁছান রিয়াদ। জয়ের রানটি আসে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাট থেকেই। তখনও তিনি ভালোবাসা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া প্রিয় ‘সাইলেন্ট কিলার’ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ হয়ে ওঠেননি।
বেশ কয়েকবার সুযোগ এসেছিল আড়াল ছেড়ে আলোতে নিঃশ্বাস নেওয়ার। সুযোগ এসেছিল সেই নিঃশ্বাস দিয়ে লাল-সবুজে বিস্তৃত বঙ্গে একটি শিরোপায় চুমু আঁকার। যেখানে ভোরের শিশিরে মুগ্ধতা ছড়ায়, নিস্তব্ধতায় ছড়ায় রহস্য। বলছিলাম ২০১২ এশিয়া কাপের কথা। ক্রিজে থেকেও শিরোপা জয়ের পথে তুলির শেষ আঁচড়টা দিতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। নন-স্ট্রাইক প্রান্ত নামের দূরান্ত থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছেন পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া ২ রানে পরাজয়ের ভুলতে না পারা রাতের সেই মুহূর্ত।
২০১৫ বিশ্বকাপ মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারের ‘ব্রেকথ্রু ইয়ার’ বলা চলে। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার, পার্শ্বনায়ক-খলনায়ক থেকে নায়ক হয়ে ওঠার গল্পের।
জিতলেই কোয়ার্টার ফাইনাল, এমন সমীকরণে অ্যাডিলেড ওভালে টস জিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ। কঠিন সমীকরণ আরো কঠিন হয়ে উঠল ৮ রানের মধ্যেই দুই ওপেনারের বিদায়ে। চার নম্বরে ব্যাট করতে ক্রিজে আসলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। নতুন ভূমিকায় ডানা মেলে ১৩১ বলে যখন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে পোঁছালেন রিয়াদ, অ্যাডিলেড ওভালের গ্যালারি তখন মুহূর্মুহূ করতালিতে মুখরিত।
গ্যালারি যখন অভিবাদন জানাতে ব্যস্ত, ততক্ষণে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ‘প্রথম সেঞ্চুরিয়ান’ হওয়ার গৌরব ‘ফ্লাইং কিসে’ অ্যাডিলেড ছাড়িয়ে প্রিয়তমার আকাশে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। অন্তরে আজন্ম খোদাই হয়ে যাওয়া রুবেল হোসেনের দুই ইর্য়কারে লাল সবুজের বিজয়ের নিশান।
পরের ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে আতহার আলী খানের ভাষায় বিখ্যাত ‘ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি’। সব মিলিয়ে ৬ ম্যাচে ৭৩ গড়ে ৩৬৫ রান করেন মাহমুদউল্লাহ, যেটি বিশ্বকাপে কোনো বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান। পরে অবশ্য রেকর্ডটি সাকিবের হাতে হাতবদল হয়েছে। বিশ্বকাপের দারুণ পারফরম্যান্সের দিয়ে জায়গা করে নেন ক্রিকেট বিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকবাজের ‘টিম অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ একাদশে।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বেঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা ম্যাচ দলকে জয়ের ঠিকানায় পোঁছাতে ব্যর্থ রিয়াদ। ক্ষণিকের ছেলেমানুষী ভুলে এবার ১ রানে পরাজয়ের গ্লানি। নিমিষেই জাতির কাছে ‘খলনায়ক’ রিয়াদ।
২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, সেমিফাইনালে খেলতে হলে আগে নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক সেরে নেওয়া চাই। পরে আসবে ভাগ্যের হিসেব-নিকেশ। এমন ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের ২৬৬ রানের টার্গেটে ৩৩ রানে টপ-অর্ডার চার ব্যাটসম্যান ড্রেসিংরুমে ফিরে গেছেন। সেখান থেকে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ত্রাতার ভূমিকায় আড়ালকেই ভালোবেসে আলিঙ্গন করা মাহমুদউল্লাহর।
ট্রেন্ট বোল্টের লেগ স্ট্যাম্পে ব্যাক অফ লেংথ ডেলিভারি। স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে বলটি যখন সীমানা দড়ি পার হলো, ততক্ষণে বাংলাদেশের জয় সুনিশ্চিত। পৃথিবীর এই প্রান্ত যখন আসন্ন জয়ের আনন্দে ব্যস্ত, ওই প্রান্তে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনের বাইশ গজে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সেজদায় সৃষ্টিকর্তা স্মরণে। সেদিনও মাহমুদউল্লাহ পার্শ্বনায়ক হয়ে রইলেন। সেই পার্শ্বনায়কের কণ্ঠে আক্ষেপ ছিল না, বরং নায়কের আড়ালের চরিত্রকেই যে তিনি বড্ড নিজের করে নিয়েছিলেন!
কখনো বা ‘পার্শ্বনায়ক’, কখনো বা ‘খলনায়ক’। এভাবেই চলছিল। কিন্তু সবারই একদিন মঞ্চটা একান্তই নিজের করে নিতে ইচ্ছে জাগে, মাহমুদউল্লাহও তার ব্যতিক্রম নন। তাই শেষটা করবো নায়কের আসনের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে দিয়ে। ঐতিহাসিক, চরম নাটকীয়তায় ভরপুর, গোটা জাতিকে আনন্দে ভাসানো নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে মাহমুদউল্লাহর বীরত্বগাঁথা দিয়ে। ফাইনালে উঠার জন্য শেষ ওভারে দরকার ১২ রান। স্ট্রাইকে মুস্তাফিজুর রহমান, নন-স্ট্রাইকে আশার সারথি মাহমুদউল্লাহ।
উদানার প্রথম বল থেকে কোনো রান নিতে পারলেন না ফিজ। দ্বিতীয় বলে রানআউট হয়ে ফিরলেন ফিজ। পরপর দুটো বাউন্সে ‘নো বল’ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কিত আম্পায়ারিং। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মাঠ থেকে উঠে আসার ইশারা করলেন দুই সতীর্থ রিয়াদ এবং রুবেলকে। মাঠের সাথে উত্তাল কলম্বোর প্রেমাদাসার গ্যালারি। ক্ষণিকের জন্য সেই আগুন যুদ্ধের ময়দানের গোলাবারুদে রূপ নিল!
ফিরতি খেলা যখন শুরু হলো, চার বলে তখনও দরকার ওই ১২ রান। স্ট্রাইকে মাহমুদউল্লাহ, উদানার তৃতীয় বল ওয়াইড আউটসাইড অফ ডেলিভারি, কভারের উপর দিয়ে চার। কমেন্ট্রি বক্স থেকে যে বলকে ‘টেস্ট ক্রিকেটেও ওয়াইড বল’ বললেন ব্রেট লি। এবার ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ প্রেমাদাসার গ্যালারি। পুরো শ্রীলঙ্কাও নয় কি?
উদানার চতুর্থ বল, লো ফুলটস। ডিপ মিড-উইকেটের দিকে ফ্লিক করলেন মাহমুদউল্লাহ। ডাইভ দিয়ে ইঞ্চিখানেক ব্যবধানে রানআউট থেকে বাঁচলেন রিয়াদ। ওই বল থেকে রান আসলো দু’টি। ক্ষণিকের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বাংলাদেশ। হ্যাঁ, বাংলাদেশ! হতাশ প্রেমাদাসার শ্রীলঙ্কান সমর্থকরাও তো আদতে পুরো শ্রীলঙ্কাই।
শেষ দুই বলে দরকার ছয় রান। পঞ্চম বল করতে আলতো রান-আপে বোলার উদানা… মনে ঘুরপাক দিচ্ছে হাজারো প্রশ্ন। ফিরে কি আসবে আরেকটি বেঙ্গালুরু, নাকি প্রেমাদাসায় এবার রচিত হবে নতুন কাব্য? মাহমুদউল্লাহ কি নায়ক হবেন, নাকি আবার ঢাকা-বেঙ্গালুরু হয়ে প্রেমাদাসায় বাংলাদেশের ‘খলনায়ক’ হবেন? একটা ‘ফ্লিক’, বল গিয়ে পড়লো বাউন্ডারি দড়ির ওপারে, আর তাতেই মাহমুদউল্লাহ শত শত প্রশ্ন উড়িয়ে দিলেন প্রেমাদাসার আকাশে।
সেই ‘ফ্লিক’ ততক্ষণে খোদাই হয়ে গেছে টাইগারদের ক্রিকেট ইতিহাসে। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে যে ফ্লিক ইতিহাস হয়ে গেল, তাতে স্তব্ধ কলম্বো ছাড়িয়ে পুরো শ্রীলঙ্কা! আড়াল ছেড়ে এবার ‘মধ্যমণি’ সেই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। আড়ালেরে ভালোবেসে যিনি করিয়াছিলেন আপন, সেই তিনিই এইবার সব ছাড়িয়ে হয়ে উঠলেন নায়ক। হয়তো সেটাই ছিল ভবিতব্য!