হ্যাঁ, ব্যবধানটা প্রায় ছয় বছরের। তবে মাঝের সময়টায় দলে এমন কোনো পাইকারি বদল তো আসেনি যে প্রত্যাবর্তনে চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে শুরু করতে হতো ‘হাই, আমি চান্দিকা। তোমাদের নতুন কোচ’ বলে। সেই তো সাকিব-তামিম-লিটন-মাহমুদউল্লাহদের দেখে গিয়েছিলেন জাতীয় দলের চৌহদ্দিতে, আধা যুগ পরেও তারাই আছেন। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এ কারণেই বলতে পেরেছিলেন, ‘ও (হাথুরুসিংহে) আমাদের সম্পর্কে সব জানে।’
তবুও, মাঝখানে একটা লম্বা বিরতি যেহেতু, স্বচক্ষে দেখার বাড়তি একটা উপকারিতা থাকবেই। তা প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম সিরিজ দেখে কী ধারণা পেলেন হাথুরুসিংহে, রোর বাংলা খুঁজতে চেয়েছে সেগুলোই।
ওই ছবিটা বদলায়নি এখনো
সাকিব-তামিমের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে, এ নিয়ে কানাঘুষা চলছিল অনেক দিন ধরেই। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে হাটে হাঁড়ি ভাঙার কাজটা করলেন বিসিবি সভাপতি। ক্রিকবাজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিলেন, তামিম ইকবাল আর সাকিব আল হাসানের সম্পর্কটা প্রায় মৃত।
ব্যস, আর যায় কোথায়! সিরিজ নিয়ে ভাবাভাবি পরের বিষয়, সাকিব-তামিমের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বই হয়ে উঠল ‘টক অব দ্য টাউন’। দুজনের সম্পর্কে অবনতির কুপ্রভাব নিয়ে আলোচনা চলল বিস্তর, প্রথম আলোতে তো এমনটাও লেখা হলো,
এক ক্রিকেটার বলেছিলেন, সব সময় তাদের ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এই ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে দেখলে না আবার ওই ভাই মাইন্ড করে ফেলেন! এইজনের সঙ্গে খেতে গেলে যদি ওইজন রাগ করেন! কারও কারও নাকি এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে, দুই ‘বড় ভাইয়ে’র একজনের অনুপস্থিতিতে হওয়া আলোচনায় আরেকজন কী বলেছেন, সেসব পরে তাকে অনুপস্থিত থাকা ‘বড় ভাই’কে বিস্তারিত বলতে হয়েছে।
– তারেক মাহমুদ
মাঠের খেলায় দু’জনের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝার জো নেই, দু’জনের মধ্যে কিছু হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট-পাড়ার জল-হাওয়াটা চেনা বলেই বোধহয় সিরিজ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে হাথুরুসিংহেও খুব একটা আমলে নিতে চাননি এই ঝামেলার কথা।
প্রথম মেয়াদেই তো দেখেছেন, পান থেকে চুন খসলেই দৌড়ে টিম হোটেলে ছুটে আসেন বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা। মাঠের ক্রিকেট যতটা আলোচনায়, হতেই পারে মাঠের বাইরের ঘটনা সাড়া তুলল এর চেয়ে দশগুণ বেশি। যেসব আলোচনায় ক্রিকেটাররা একটুও বিচলিত না হলে ধরে নিতে হবে, মোটামুটি মুনি-ঋষির পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গেছেন তারা।
প্রত্যাবর্তনে হাথুরুসিংহেকে তাই কাজ করতে হবে ক্রিকেটারদের সাধু-সন্ন্যাসী বানাতেই।
ভয়ডরহীন ক্রিকেটের সন্ধানে
তামিম ইকবাল তখন ফর্মের তলানিতে। এতটাই যে, বাজারে চলছে ‘দুই মিনিটে ম্যাগি নুডলস না হলেও তামিম আউট হবে ঠিকই’ জাতীয় ট্রল। ২০১১ থেকে হাথুরুসিংহে দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত তার ওয়ানডে পরিসংখ্যানটাই দেখুন, ৭৬.৩৪ স্ট্রাইকরেটে ১,০৬২ রান, গড় ৩১.২৩। সেই তামিমই হাথুরুসিংহের সময়টায় হয়ে গেলেন ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি। ওই তিন বছরে তামিম রান করেছিলেন প্রায় ৪৬ গড়ে, ক্যারিয়ারের ১৪ ওয়ানডে সেঞ্চুরির পাঁচটিই এসেছিল তখন। কীভাবে? এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তামিমের কথাতেই।
খেলোয়াড়েরা তার সময়ে অনেক বেশি প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছিল। এর আগে হতো কী, ৬০ রানে ৪ উইকেট পড়ে গেছে, তখন ব্যাটারদের মাথায় ঘুরত, ‘যদিও এই বোলারকে আমি মারতে পারি, কিন্তু এখন মারব না। কারণ আউট হলে আমার আর রক্ষা নেই।’ (হাথুরুসিংহের সময়ে) এই ভাবনাটা বদলেছিল। কেননা আমি জানতাম, আউট হলেও কোচের সমর্থন পাব। তিনি জানতেন, ওটাই আমার খেলা।
– তামিম ইকবাল
শট খেলার ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতার ব্যাপারটা বুঝতে তামিমকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় না করালেও চলত। পুরো বাংলাদেশই তো তখন ‘স্ট্রোকপ্লে’র ক্রিকেটে বিশ্বাসী। হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদে ব্যাটিং কোচের ভূমিকা সামলেছিলেন তিনি নিজেই, বাংলাদেশ তার অধীনে ম্যাচ খেলেছিল ৫২টা। ওই ৫২ ম্যাচে বাংলাদেশ রান করেছিল ৫.৩৩ রান রেটে।
কিন্তু, ম্যাকেঞ্জি-প্রিন্স-লুইস ঘুরে সিডন্স হয়ে ফের যখন দায়িত্ব নিলেন হাথুরুসিংহে, তখন কোথায় যে হারিয়েছে সেই ভয়ডরহীন ক্রিকেট! জেমি সিডন্সের অধীনে ইংল্যান্ড সিরিজের আগ পর্যন্ত যে ১৫ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ দল, সেখানে ওভারপ্রতি রান তোলার হার নেমে এসেছে ৫.০৭-এ।
ইংল্যান্ড সিরিজেও কি ফিরে পাওয়া গেল সেই সাহসী ক্রিকেট? মোটেই না। ধুঁকতে ধুঁকতে তৃতীয় ম্যাচে তোলা গেল ২৪৬ রান, সেটাই সর্বোচ্চ। প্রতিনিয়ত যেখানে পড়তে হচ্ছে ব্যাটিং বিপর্যয়ে, তখন সামনে বাড়ানোর চাইতে ইনিংস মেরামতের চিন্তাই প্রাধান্য পাবে, খুব স্বাভাবিক।
এক সাকিব আল হাসান ছাড়া ব্যাট হাতে ভরসা দিতে পারেননি কেউই। টপ অর্ডার থেকে মিডল অর্ডার, ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো। সাকিব আল হাসানকে সরিয়ে তিন নম্বরে সুযোগ দেওয়া হলো নাজমুল হোসেন শান্তকে, বিপিএলে ধারাবাহিকভাবে রান করার পুরস্কার হিসেবেই বোধহয়। তা রান তিনি এই সিরিজেও পেয়েছেন, দুই ইনিংসে করেছেন ফিফটি। তবে তার ৭৫ স্ট্রাইকরেটের ইনিংসগুলো যেহেতু থেমে যাচ্ছে পঞ্চাশ পেরিয়েই, দলকে কতটা চাপমুক্ত করতে পারছেন তিনি, প্রশ্নটা উঠছেই।
ব্যাটিং নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যাটা দীর্ঘমেয়াদী, রোর বাংলায় তা লেখা হয়েছে আগেই। ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ বলে ব্যাটিং-সহায়ক পিচই পাওয়া যাওয়ার কথা। তাই, প্রত্যাবর্তনের পর হাথুরুসিংহেকে সবচেয়ে বেশি করে ভাবতে হচ্ছে ব্যাটিং নিয়েই।
জুটি ভাঙবেন কে?
পুরো সিরিজটা খেলা হলো মন্থর উইকেটে, রান করতে কষ্ট হয়েছে দু’দলেরই। তবে কষ্টটা যে বাংলাদেশেরই বেশি হলো, তা বোঝা যাবে মিরপুরে হওয়া প্রথম দুই ওয়ানডেতে তাকালেই। কারণটাও অনুমেয়, বাংলাদেশ উইকেট হারিয়েছে নিয়মিত বিরতিতে। সেট হওয়ার জন্য কঠিন উইকেটেও ইংল্যান্ডের কেউ না কেউ সেট হয়ে গিয়েছেন ঠিকই।
ঘরে-বাইরে মিলিয়ে বাংলাদেশ গেল কয়েক বছরে যে ক’টা ম্যাচই হারল, প্রায় প্রতিবারই ‘কমন’ পড়েছে সমস্যাটা। সেই জিম্বাবুয়ে সিরিজে সিকান্দার রাজার তালগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া থেকে ভারতের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে ঈশান কিষাণের ডাবল সেঞ্চুরি – সেট ব্যাটারকে প্যাভিলিয়নে ফেরানোর চিট কোডটা বাংলাদেশের জন্য এখনো রহস্যই।
গতির ঝড় তুলে তাসকিন আহমেদ কিংবা এবাদত হোসেন চেষ্টা করছেন এক্স-ফ্যাক্টর হওয়ার, কিন্তু অপর পাশ থেকে মিলছে না যোগ্য সঙ্গত। রান আটকে রাখা বোলিং করলেও মোস্তাফিজুর রহমানের উইকেট না পাওয়া দুর্ভাবনার কারণ হয়েছে সবারই। গত ভারত সিরিজ থেকে মোস্তাফিজ উইকেট পেয়েছেন মাত্র তিনটি। কাটারের অতিব্যবহারে তার বোলিংটা বড় বেশি অনুমেয় হয়ে যাচ্ছে কি না, কোচ সারওয়ার ইমরান রেখেছেন ওই প্রশ্নও।
স্লোয়ার বা শর্ট বলই করবে — এমন অনুমেয় হয়ে গেছে সে। আগে ইয়র্কারও ভালো করতে পারত, সেটিও দেখি না এখন। যদি লেংথ বল করতে না পারে, ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করতে না পারে, শুরুতে এসেই স্লোয়ার করতে থাকে — তাহলে তো ব্যাটসম্যানের কাজটা সহজ হয়ে যায়।
– সারওয়ার ইমরান
মাঝের ওভারে জমে যাওয়া জুটি ভাঙার ক্ষেত্রে এখন সব দলেরই সহায় লেগ-স্পিনার। বাংলাদেশ তো পাচ্ছেই না তেমন কাউকে, উল্টো…
লেগ স্পিনটা আক্ষেপ ব্যাটিংয়েও
ঘরোয়া ক্রিকেটে লেগ স্পিন খেলার চর্চা না থাকায় ভুগতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। যেমনটা বাংলাদেশ ভুগল ইংল্যান্ড সিরিজেও। সিরিজ-সর্বোচ্চ ৮ উইকেট পেলেন আদিল রাশিদ। প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ বলেই বোধ হয় সর্বকনিষ্ঠ ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক হয়ে গেল রেহান আহমেদের।
রেহানের অভিষেকের দৃশ্যটা হাথুরুসিংহে দেখেছেন কি না, জানার উপায় নেই। তবে, যদি দেখে থাকেন, মনটা দুঃখের দহনে না পুড়ে পারেই না তার। প্রথমবার দায়িত্ব নিয়েই হাথুরুসিংহে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছিলেন একজন লেগ স্পিনারের দাবিতে। এমনকি বিশ্বকাপের দলে জুবায়ের লিখনকে নেওয়ার জন্য তৎকালীন প্রধান নির্বাচকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে পর্যন্ত জড়িয়েছিলেন।
একবার তখনকার বিশ্ব ক্রিকেটের প্রেক্ষিৎটা চিন্তা করুন। পৃথিবীর কোন লেগ স্পিনারটার দলে জায়গা পাকা তখন? কিন্তু আজ ছয়-সাত বছর পরে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে রাজত্ব করছেন লেগ স্পিনাররাই। মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে? হাথুরুসিংহে সময়ের আগেই ধরতে পেরেছিলেন, ছোট ফরম্যাটে ভালো করতে হলে লেগ স্পিনার লাগবে। অন্য সব দলই যা বুঝেছে বছর কয়েক পরে। গোলটা বেঁধেছে যেখানে, অন্যরা বুঝতে পেরে ভালো একজন লেগ স্পিনারও পেয়ে গেছে এরই মধ্যে।
আর হাথুরুসিংহেকে তার দ্বিতীয় পর্ব শুরু করতে হচ্ছে আরও একবার আক্ষেপ সঙ্গী করেই।