ক্রিকেট যতটা শারীরিক, ঠিক ততটাই মনস্তাত্ত্বিক খেলা। মানসিক চাপ সামলাতে না পারলে এই খেলায় সাফল্য লাভ করা প্রায় অসম্ভব। ক্রিকেটের বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার নিয়েই সম্প্রতি ক্রিকেট মান্থলি’র সাংবাদিক স্কট অলিভারের সাথে কথা বলেছেন আধুনিক ক্রিকেটের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারা। পাঠকদের জন্য সেই কথোপকথন বাংলায় তুলে ধরা হলো এখানে।
পুরষ্কার, চাপ কিংবা পরিস্থিতি উপেক্ষা করে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করাকে যদি মানসিক দৃঢ়তা বলে, তাহলে আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার প্রমাণ করে যে আপনি মানসিকভাবে বেশ দৃঢ় একজন মানুষ। চাপ সামলানোর এই ক্ষমতাটা কি আপনার স্বভাবজাত গুণ?
চাপ সামলানোর ব্যাপারটা অভিজ্ঞতা ও নিজের সচেতন থাকার ওপর নির্ভর করে। আপনি যখন ক্যারিয়ার শুরু করবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার প্রথম লক্ষ্য হবে দলে নিজের জায়গা পাকা করে ক্যারিয়ারটাকে দীর্ঘায়িত করা। যখন আপনি দলে ঢুকে রান করা শুরু করবেন তখন প্রতিপক্ষের সব কৌশল ব্যর্থ করে ধারাবাহিকভাবে রান করাটা আপনার লক্ষ্য হবে। এজন্য নিজের ব্যাপারে জানাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি আপনার নিজের শক্তিমত্তা কিংবা দুর্বলতাটা সবচেয়ে ভালো জানেন, তাহলে কীভাবে অনুশীলন করলে নিজের সেরাটা দেওয়া যাবে সেটাও ভালো জানবেন।
ভালো করার চাপ কিন্তু সবসময়ই থাকবে, আপনি যত ভালো খেলতে থাকবেন এই চাপ আরো বাড়তে থাকবে। ধারাবাহিক পারফর্ম করার ফলে আপনি যখন একটি মানদণ্ড স্থাপন করে ফেলবেন তখন সেই মানদণ্ড ধরে রাখা কিংবা সেটাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চাপ স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়বে। তার মানে এই না যে আপনাকে প্রতিদিনই পারফর্ম করতে হবে, সবাই চায় প্রতিদিন ভালো খেলতে কিন্তু সেটা তো কখনোই সম্ভব হয় না। তবে যখনই ভালো কোনো শুরু পাবেন সেটাকে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
আপনি নিজে রান তাড়া করে দলকে জেতানোর ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ ছিলেন, এই রান তাড়ার সাথে মানসিক দৃঢ়তার সম্পর্ক ঠিক কতখানি? বিভিন্ন হিসাব-নিকাশের চাপ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আপনি নিজের সেরাটা দিতেন?
প্রতিটা বল কিংবা ওভারের মাঝে যে সময়টা পাওয়া যায়, তা ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কোন বোলারকে আপনি টার্গেট করবেন, মাঠের কোন দিকটায় মারলে আপনি বেশি রান পাবেন কিংবা রানের গতি ঠিক কতখানি বাড়ানো লাগবে, এসব সিদ্ধান্ত সে সময়ের মাঝেই নিতে হবে। একটা নির্দিষ্ট গতিতে রান করার চাপ অবচেতন মনে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে, সেটা নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, যখন আপনি ব্যাট করবেন তখন এসব নিয়ে ভাবার অবকাশ থাকবে না। সে সময়ে সবকিছু ভুলে শুধুমাত্র সেই নির্দিষ্ট বলের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে।
মানসিক শক্তি বাড়াতে চাইলে মানসিক দক্ষতা আগে বাড়াতে হবে। অতীতের ইনিংস নিয়ে চিন্তা না করা, পরিস্থিতি ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা, প্রতিপক্ষের কৌশলের ব্যাপারে ভালো ধারণা রাখা- এসব ব্যাপারগুলোয় জোর দিলে মানসিক শক্তি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে। নিজের সামর্থ্যকে শতভাগ বিশ্বাস করাটাও ভীষণ জরুরী। আপনি একটা বলে শট করুন কিংবা বলটা ছেড়ে দিন, দুই পরিস্থিতিতেই কিন্তু ঝুঁকি থাকবে। তাই কোন সিদ্ধান্তটা নিলে আপনি লাভবান হবেন এটা ঠিক করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
‘মনস্তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে খেলাটা আরো সহজ হয়ে যায়’ – এই কথাটার সাথে কি আপনি একমত?
বয়স বাড়ার একটা ভিন্নমুখী প্রভাবও কিন্তু আছে। আপনি যত সফল হবেন, সেই সাফল্য ধরে রাখার চাপটাও তত বৃদ্ধি পাবে। আপনি ক্যারিয়ারের যে পর্যায়েই থাকুন না কেন, রান করাটা কখনোই সহজ হবে না। আপনি একটা দলের বিপক্ষে আগে দশটা সেঞ্চুরি করেছেন বলে যদি ভেবে থাকেন যে তাদের বিপক্ষে রান করাটা সহজ হয়ে গেছে, তাহলেই আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। সময়ের সাথে আপনার প্রতিপক্ষেরও উন্নতি হচ্ছে, এটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।
অভিজ্ঞ হওয়ার একমাত্র সুবিধা হচ্ছে, দল থেকে বাদ পড়ার ঝুঁকি বেশ কমে যায়। ফলে সে সময় আপনি নতুন কিছু করার ঝুঁকিটা নিতে পারবেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে দলে আপনার নিজের জায়গাটাই নিশ্চিত নয়। ফলে নতুন কিছু করাটাও তখন বেশ কঠিন।
আমার মনে হয়, সময় এবং পরিস্থিতির সাথে একজন ব্যাটসম্যানের উচিত তার ব্যাটিং টেকনিকে পরিবর্তন আনা। সময়ের সাথে আপনার রিফ্লেক্স কিংবা শারীরিক ক্ষমতাও পরিবর্তিত হবে, এবং সেটা অবশ্যই আপনার ব্যাটিং করার ক্ষমতাকে পরিবর্তন করবে। ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা, এই দুই জায়গার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এখন দুই দেশেই যদি আপনি একই স্টাইলে ব্যাট চালান, তাহলে তো সাফল্য পাওয়া কঠিন হবেই।
এমন কোনো খেলোয়াড় কি ছিল যার কাছ থেকে এই মানসিক দক্ষতার ব্যাপারে আপনি কিছু শিখেছিলেন?
নাহ, আমার মনে হয় এটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর মনে হয়, অন্যকে অনুসরণ করে নিজের ব্যক্তিত্ব গঠন করার ফল ভয়াবহ। প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা, তাই আগে নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে হবে, এরপর সেই অনুযায়ী নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে হবে।
অধিনায়কত্ব কি একজন খেলোয়াড়ের মানসিক চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়? আপনি নিজেও তো তিন নম্বরে ব্যাটিং ও উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব সামলানোর সাথে সাথে অধিনায়কত্বটাও সামলেছেন।
আমার তা মনে হয় না। শুধুমাত্র ফিল্ডিং করার সময়েই তো অধিনায়কত্বের ব্যাপারটা আসে। আর আমার মনে হয় উইকেটরক্ষকদের জন্য অধিনায়কত্ব করাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। তবে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে নিজের ভূমিকা বোঝাটা ভীষণ জরুরী। যখন আপনি মাঠে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তখন অধিনায়ক হিসেবে নিজের কাজটা করাই সবচেয়ে দরকারি। আর যখন আপনি ব্যাটিং করছেন, তখন সব ভুলে শুধুমাত্র ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটিংয়ের সময় অধিনায়কত্বের ব্যাপারে ভাবলে অহেতুক চাপ সৃষ্টি হবে।
বল কিংবা ওভারের মাঝে হিসাব-নিকাশের ব্যাপারে আপনি বললেন। কিন্তু বিভিন্ন বিরতির পর নিজের মনোযোগ সম্পূর্ণভাবে অন্য দিকে নেওয়াটা ঠিক কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
এটা সত্যিই বেশ কঠিন কাজ ছিল। তবুও খেলার প্রথম বল থেকেই খেলার প্রতি নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এক্ষেত্রে মাঠের বাইরে থাকাকালীন অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাও জরুরী, সবসময় যদি আপনি শুধু ক্রিকেট নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তাহলে সেটা ভীষণ একঘেয়ে হয়ে যাবে। তাই যখন মাঠের বাইরে থাকবেন, তখন সেই জগত নিয়েই ব্যস্ত থাকুন। কিন্তু যখন মাঠের ভেতরে থাকবেন, তখন শুধুমাত্র ক্রিকেটেই নিজের মনোযোগটা রাখুন।
স্পোর্টস সাইকোলজির ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
ক্যারিয়ারের শেষদিকে জেরোমি স্ন্যাপের সাথে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিলাম। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার স্যান্ডি গর্ডন আমাদের সাথে দীর্ঘদিন এটি নিয়ে কাজ করেছিলেন। আমরা কোন তুচ্ছ ব্যাপারগুলো নিয়ে অতি চিন্তা করে হতাশাগ্রস্থ হয়ে যেতাম, এগুলো চিহ্নিত করাটাই তাদের মূল কাজ ছিল। আমরা যাতে অতি উচ্চাশা না করি, কিংবা কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা না করি, এই ব্যাপারগুলোতেই তারা জোর দিতেন।
২০০৭ থেকে ২০১২, এই পাঁচ বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কা মোট চারটি বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরেছিল। তবুও ড্রেসিংরুমে ফাইনাল প্রসঙ্গে নিজেদের ভয় নিয়ে আপনারা কখনো আলোচনা করতেন না, এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এখানে ভয় পাওয়ার তো আসলে কিছু ছিল না। এটা তো ফাইনাল ম্যাচ, হেরে গেলে কী হবে- এরকম চিন্তা না করে ফাইনাল ম্যাচকে অন্য ম্যাচগুলোর মতো দেখলেই বরং চাপ কম অনুভব করা যায়। ২০১৪ সালে আমরা যখন পঞ্চমবারের মতো ফাইনাল খেলছিলাম তখনো আমরা পুরোনো হারের স্মৃতিগুলো নিয়ে না ভেবে শুধুমাত্র সেই ফাইনাল নিয়েই ভাবছিলাম। সৌভাগ্যবশত সেই ফাইনালটা আমরা জিতেছিলাম।
ড্রেসিংরুমের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ টানা চার ফাইনাল হারার মানসিক আঘাত ভুলতে ঠিক কতটা সাহায্য করেছে?
শুধুমাত্র খেলার জন্য অনুপ্রেরণা পেতাম এমনটা তো আর না, দেশের জন্য কিছু করা এবং খেলাটাকে উপভোগ করার জন্যই অনুপ্রেরণা পেতাম। বড় কোনো ফাইনাল হারার পর নিজেদের বুঝাতাম যে, চার বছর পর আরেকবার এমন সুযোগ পেতে হলে আবার নিজেদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করতে হবে। সুযোগের জন্য আরো চার বছর অপেক্ষা করতে হবে, সেটা নিয়ে হতাশ হওয়ার উপায় নেই। এই চার বছরে নিজেকে আরো পরিণত করতে হবে, যাতে আরো একটি ফাইনাল ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া যায়। এটাই মানসিক শক্তি।