প্রিমিয়ার লিগে গত মৌসুমের শিরোপা লড়াই মূলত ম্যানচেস্টার সিটি ও লিভারপুলের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। হাড্ডাহাড্ডি সেই লড়াই চলেছিল শেষ গেম-উইক পর্যন্ত, শেষ পর্যন্ত অলরেডদের মাত্র ১ পয়েন্টে পেছনে ফেলে লিগ শিরোপা অক্ষুণ্ণ রাখে সিটিজেনরা। সেই ধারা এবারের মৌসুমেও অব্যাহত আছে, তবে নরউইচ ও উলভসের কাছে হারায় গত দুই মৌসুমের তুলনায় সিটিজেনদের এবারের শুরুটা তেমন ভালো হয়নি। অন্যদিকে, গতবারের মতো এবারও দারুণ এক শুরু করেছে লিভারপুল, ফলে ১১ রাউন্ড শেষে ম্যানসিটির চেয়ে ছয় পয়েন্টে এগিয়ে ছিল তারা।
তাই শিরোপার রেসে ফেরার জন্য অ্যানফিল্ডে লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যানসিটির জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না। এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে দলের নিয়মিত গোলরক্ষক এডারসনের ইনজুরি তাদের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে। খেলার আগমুহূর্তে তার ফিট হওয়ার গুজব ছড়ালেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি, ক্লদিও ব্রাভোই মূল একাদশে জায়গা করে নেন।
এছাড়া সিটিজেনদের সেরা সেন্টারব্যাক এমরিক লাপোর্তে এখনো ফিট না হওয়ায় এবং ওটামেন্ডির চূড়ান্ত খারাপ ফর্মের কারণে এ ম্যাচেও ফার্নান্দিনহোকে সেন্টারব্যাক হিসেবে নামতে হয়। ট্যাকটিক্যাল কারণে মেন্ডির বদলে নামানো হয় অ্যাঞ্জেলিনোকে। অবশ্য মাঝমাঠে রদ্রির প্রত্যাবর্তন তাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির খবর ছিল। দুই পাশে ডি ব্রুইন ও গুন্ডোগান এবং আক্রমণভাগে স্টার্লিং ও বার্নার্ডো সিলভার সাথে আগুয়েরোকে রেখে নিজেদের চিরায়ত ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতে নামে ম্যানসিটি।
লিভারপুলও ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতে নেমেছিল, তাদের দলে অবশ্য ইনজুরি সমস্যা ছিল মোটে একটি। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা জোয়েল মাতিপ ফিট না থাকায় এ ম্যাচেও দেজান লভরেনকে একাদশে রেখে দল সাজান ইয়ুর্গেন ক্লপ। কিক-অফের পর প্রথম পাঁচ মিনিট ম্যানসিটির একক দাপট ছিল, ছয় মিনিটের মাথায় বার্নার্ডো সিলভার ক্রস লিভারপুলের রাইটব্যাক অ্যালেক্সান্ডার-আর্নল্ডের হাতে লাগলে সিটির খেলোয়াড়েরা পেনাল্টির জন্য জোরালো আবেদন করে। কিন্তু রেফারি তাতে সায় দেননি, উল্টো দ্রুত পাল্টা আক্রমণে চলে যায় ‘অলরেড’রা। সেখানে সাদিও মানের ক্রস ঠিকভাবে ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন জন স্টোনস, প্রায় ২৫ গজ দূরে একদম আনমার্কড অবস্থায় থাকা ফ্যাবিনহো দারুণ এক দূরপাল্লার গোল করে স্বাগতিকদের ১-০ গোলে এগিয়ে দেন।
তবে এই গোলের পরপরই ভিএআরের দাবিতে রেফারি মাইকেল অলিভারের কাছে ছুটে যান ম্যানসিটির খেলোয়াড়েরা। রিপ্লেতে অবশ্য আর্নল্ডের হাতে লাগার প্রমাণই পাওয়া গেছে, কিন্তু আর্নল্ডের হাত স্বাভাবিক অবস্থানে ছিল বলে রায় দেওয়া হয়। ফলে নিজের আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন রেফারি অলিভার। যদিও রিপ্লে দেখে আর্নল্ডের হাতের অবস্থানকে মোটেও স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি।
ম্যাচের শুরুতে এভাবে গোল খেয়ে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায় ম্যানসিটি, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১৩ মিনিটে দারুণ এক আক্রমণ সাজায় লিভারপুল। ডান প্রান্ত থেকে দারুণ এক পাসে অন্য প্রান্তে থাকা রবার্টসনের দিকে বল বাড়িয়ে দেন আর্নল্ড। সুবিধাজনক জায়গায় বল পেয়ে সালাহর দিকে ক্রস বাড়িয়ে দেন এই স্কটিশ লেফটব্যাক, হেডে গোল করে স্বাগতিকদের ২-০ গোলে এগিয়ে দেন সালাহ। এই গোলের পরেও অবশ্য ভিএআরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন রেফারি, একদম অল্প ব্যবধানে সালাহ অনসাইডে থাকায় এই দফায়ও বেঁচে যায় লিভারপুল।
অল্প সময়ে দুই গোলে এগিয়ে যাওয়ায় কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করে লিভারপুল, অন্যদিকে খেলায় ফেরার লক্ষ্যে টানা আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে ম্যানসিটি। ২৮ মিনিটে দারুণ এক সুযোগ তৈরি করেছিলেন কেভিন ডি ব্রুইন, সেখান থেকে অ্যাঞ্জেলিনোর নেওয়া শট গোলবারের ডান প্রান্তে লেগে মাঠের বাইরে চলে যায়।
৩৭ মিনিটে আর্নল্ডের কাছ থেকে বল পেয়ে গোলে শট নিয়েছিলেন রবার্তো ফিরমিনো, কিন্তু সেই শট দারুণ ক্ষিপ্রতায় ফিরিয়ে দেন ব্রাভো। ৪২ মিনিটে আর্নল্ডের ভুলে দারুণ এক সুযোগ পেয়েছিলেন আগুয়েরো, কিন্তু তার শট ব্যর্থ হওয়ায় অ্যানফিল্ডে কখনো গোল না পাওয়ার গেরো ভাঙতে ব্যর্থ হন এই অভিজ্ঞ আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার। শেষ পর্যন্ত লিভারপুলের ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার মাধ্যমেই শেষ হয় প্রথমার্ধের খেলা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও লিভারপুলকে চেপে ধরার চেষ্টা চালায় ম্যানসিটি, কিন্তু ৫২ মিনিটে তাদের সেই চেষ্টায় বড়সড় ধাক্কা আসে। অ্যাঞ্জেলিনোকে ফাঁকি দিয়ে মানের দিকে ক্রস বাড়িয়ে দেন লিভারপুলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন। ওয়াকারের ভুলে আনমার্কড অবস্থায় থাকা সাদিও মানে সেই ক্রসে আরামসে হেড করে ৩-০ গোলে অলরেডদের এগিয়ে দেন।
তিন গোলে পিছিয়ে পড়েও হাল ছাড়েনি পেপ গার্দিওলার দল, তবে এ ম্যাচে পেনাল্টি বক্সের কাছাকাছি গিয়ে বড্ড বেশি ছন্নছাড়া ছিল তারা। ডি ব্রুইন কিংবা বার্নার্ডো সিলভা পেনাল্টি বক্সে যেসব পাস দিয়েছেন, তার সিংহভাগই চলে গেছে লিভারপুল গোলরক্ষক অ্যালিসনের হাতে। ৬৬ মিনিটে আবারও পেনাল্টির জোরালো আবেদন জানায় ম্যানসিটি, মাইকেল অলিভার এবারও তা নাকচ করে দেন।
এবার অবশ্য টাচলাইন থেকে বেশ রাগান্বিত হয়ে রেফারিকে ইঙ্গিত করে কিছু বলছিলেন পেপ গার্দিওলা। তবে ভিডিও রিপ্লে দেখে মনে হয়েছে, হয়তো ম্যাচের শুরুর দিকের ওই পেনাল্টি না পাওয়ার জ্বালা মেটাতেই রেফারির এই সঠিক সিদ্ধান্তেও এভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন তিনি। ম্যাচের মোড় ঘোরাতে অ্যানফিল্ডে কখনো গোলের দেখা না পাওয়া আগুয়েরোকে উঠিয়ে গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে নামান ম্যানসিটি কোচ।
৭৮ মিনিটে ম্যাচে ফেরার সুযোগ পায় ম্যানসিটি, অ্যাঞ্জেলিনোর পাস থেকে দারুণ এক গোল করে ব্যবধান কমিয়ে ৩-১ এ নিয়ে আসেন বার্নার্ডো সিলভা। এরপর নিজেদের সমস্তটুকু দিয়ে গোলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে সিটিজেনরা, সেই আক্রমণ ঠেকাতে লিভারপুলও নিজেদের সব খেলোয়াড়কে রক্ষণভাগে নামিয়ে নিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত আর কোনো গোল হয়নি, ৩-১ গোলের এই জয়ে ১২ রাউন্ড শেষে ৩৪ পয়েন্ট নিয়ে নিজেদের শীর্ষস্থানটা আরো মজবুত করল লিভারপুল। অন্যদিকে, এই হারের ফলে এক ধাক্কায় চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে ম্যানসিটি; দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে লেস্টার সিটি ও চেলসি।
ম্যাচ শেষ হওয়ার পরও রেফারির প্রতি নিজের ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা গেছে পেপ গার্দিওলাকে। আর্নল্ডের ওই হ্যান্ডবলে পেনাল্টি না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি বেশ দৃষ্টিকটু ছিল এটা সত্যি, কিন্তু তাতে তো সিটিজেনদের সব ভুল আড়ালে চলে যেতে পারে না! লিগে এখন পর্যন্ত ম্যানসিটি গোল খেয়েছে ১৩টি, যা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চেয়েও বেশি। আর ম্যাচ হেরেছে তিনটি, যা উলভসের চেয়েও বেশি। এক লাপোর্তের ইনজুরিতে ম্যানসিটির এই দল এভাবে ভেঙে পড়লে গার্দিওলার ট্যাকটিক্স নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে, দারুণ এক জয়ের পরও পা মাটিতেই রাখছেন লিভারপুলের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। ম্যাচশেষে তিনি বলেন,
‘পয়েন্ট টেবিলের বর্তমান অবস্থা দেখে এখনই উচ্ছ্বসিত হওয়ার উপায় নেই, মৌসুমের পরের ম্যাচগুলোতেও আমাদের সমান গুরুত্ব নিয়েই খেলতে হবে। বাকি মৌসুম যারা ভালো খেলবে, তারাই শেষ পর্যন্ত শিরোপা জিতবে।’
পয়েন্ট টেবিলে সাময়িক এগিয়ে থাকা মানেই যে লিগজয় নয়, সেটার প্রমাণ গত মৌসুমে বেশ ভালোভাবেই পেয়েছে ক্লপের দল। তাছাড়া প্রিমিয়ার লিগ এমনিতেই অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, এখানে পয়েন্ট টেবিলের হালচাল বদলে যেতেও খুব বেশি সময় লাগে না। তবে যত যাই হোক, অ্যানফিল্ডের এই ফলাফল শিরোপা নির্ধারণে বড়সড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে – তা কিন্তু বলাই যায়।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
২) ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার আইন কানুন