অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২০১০ সালে মরিনহোকে দলে ভিড়িয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। পোর্তোকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়, চেলসিকে নিয়ে ইপিএলে সাফল্য, কিংবা ইন্টার মিলানকে নিয়ে ট্রেবল জেতার কারণেই নয়, মাদ্রিদের মরিনহোকে বাছাই করার আরেকটা বড় কারণ ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে মরিনহোর দলের বিপক্ষে লিওনেল মেসি গোল পাচ্ছিলেন না। আবার মাদ্রিদের বিপক্ষে মেসির পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। অনেকদিন যাবৎ প্রত্যাশিত সফলতা না পাবার কারণে এবং মেসিকে আটকানোর জন্যেই মূলত মরিনহোকে রিয়াল মাদ্রিদে নিয়ে আসা হয়।
সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দেরকে নিয়েই সাজিয়েছিলেন স্কোয়াড। কিন্তু তিন সিজনে রিয়াল মাদ্রিদে মরিনহোর অর্জন কেবল একটি লিগ, একটি কোপা দেল রে এবং একটি স্প্যানিশ সুপার কাপ। পরিসংখ্যানের বিচারে হয়তো রিয়াল মাদ্রিদে মরিনহো ব্যর্থই ছিলেন বলা চলে। কিন্তু পরিসংখ্যান সবসময় সত্যি কথাটা বলে না, সত্যটা বের করার জন্য কিছুটা বিশ্লেষণ করতে হয়। সেটার চেষ্টাই একটু করে দেখা যাক।
যাত্রা হলো শুরু
লা লিগায় প্রথম মৌসুমটা মরিনহোর দল ভালো খেললেও প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা তাদের চেয়েও আরেকটু বেশি ভালো খেলে ফেলে। লিগে সবচেয়ে বেশি গোল (১০২) করলেও মৌসুমশেষে বার্সেলোনার চেয়ে ৪ পয়েন্ট পেছনে থাকে। সবচেয়ে কষ্টদায়ক ছিল বার্সার মাঠে ৫-০ গোলে পরাজয়।
তবে ২০১১ সালে বার্সেলোনাকেই ১-০ গোলে হারিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ কোপা দেল রে’র শিরোপা জিতে নেয়। মাদ্রিদে এটাই মরিনহোর প্রথম শিরোপা। মানের বিচারে কোপা দেল রে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও সেই সময় মাদ্রিদের জন্য ট্রফি জয়টা খুবই তাৎপর্যময় ছিল। ২০০৭-০৮ মৌসুমের লিগ শিরোপা জয়ের পর সেটাই ছিল মাদ্রিদের প্রথম কোনো শিরোপা। তাছাড়া কোপা দেল রে ট্রফিটাও মাদ্রিদ জিতেছিলো ১৮ বছর পর।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও রিয়াল মাদ্রিদ ভাল খেলতে থাকে। তবে সেই ভালো খেলাটা থেমে যায় সেমিতে প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার বিপক্ষেই। অবশ্য এখানে কিছু বিতর্কিত ঘটনা ঘটে। ৬১তম মিনিটে মাদ্রিদ ডিফেন্ডার পেপে লাল কার্ড দেখেন, এবং এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে মরিনহোকেও স্ট্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হতচকিত মাদ্রিদ শেষ ১৫ মিনিটে মেসির জোড়া গোলে ম্যাচটা হেরে যায়। পরের লেগে বার্সেলোনার মাঠে ১-১ গোলে ম্যাচটা ড্র হলে টুর্নামেন্ট থেকে রিয়াল মাদ্রিদ বাদ পড়ে যায়। ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় পর্বেই বাদ পড়তে থাকা রিয়াল মাদ্রিদ মরিনহোর অধীনেই ৬ বছর পর সেমিফাইনালে উঠতে পারে।
২০১২ সালে বার্সেলোনার মাঠে যখন মাদ্রিদ লিগ ম্যাচ খেলতে যায়, তখন লিগে ম্যাচ বাকি ছিল মাত্র ৫টি। মাদ্রিদ মাত্র ৪ পয়েন্ট এগিয়ে থাকায় বার্সার জন্য সুযোগ ছিল ম্যাচটা জিতে লিগ লড়াইয়ে ফিরে আসা। সম্ভাবনাটাও বার্সার পক্ষে ছিল, ২০০৮ সালের পর লিগে বার্সাকে আর হারাতে পারে নি মাদ্রিদ। ন্যু ক্যাম্পের হিসেব করলে সময়টা আরো বেড়ে যায়, ২০০৭ সালে সর্বশেষ বার্সার মাঠে বার্সাকে হারিয়েছিল মাদ্রিদ। কিন্তু সব হিসেব পাল্টে বার্সাকে ২-১ গোলে হারায় রিয়াল মাদ্রিদ, যার ফলে লিগে মাত্র ৪ ম্যাচ বাকি থাকা অবস্থায় ৭ পয়েন্ট এগিয়ে যায় মাদ্রিদ।
শেষ পর্যন্ত ৪ বছর পর মাদ্রিদ লিগ শিরোপা জিতে। একই সাথে আরো কয়েকটা রেকর্ড গড়ে তারা।
- লা লিগার এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয় (৩২টি)
- লা লিগার এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি অ্যাওয়ে ম্যাচ জয় (১৬টি)
- ইউরোপের সেরা লিগগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জন (১০০)
- দলীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড করা (১২১টি)
- গোল ব্যবধান সবচেয়ে বেশি (৮৯টি) রেখে মৌসুম শেষ করা
চ্যাম্পিয়নস লিগেও টানা দ্বিতীয়বারের মতো মাদ্রিদ সেমিফাইনালে ওঠে, প্রতিপক্ষ জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ। বায়ার্নের মাঠে ২-১ গোলে হেরে গেলেও মূল্যবান একটা অ্যাওয়ে গোল নিয়ে আসে মাদ্রিদ। ঘরের মাঠে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ২ গোলে প্রথমে এগিয়ে গেলেও রোবেনের গোলে সমতায় ফেরে বায়ার্ন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা টাইব্রেকারে যায় এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, কাকা আর সার্জিও রামোসের মতো খেলোয়াড়রা স্পট কিক মিস করলে আবারও সেমিতেই বাদ পড়তে হয় মাদ্রিদকে।
নতুন মৌসুমের শুরুতেই মাদ্রিদ প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার মুখোমুখি হয় স্প্যানিশ সুপার কাপে। বার্সার মাঠে ৩-২ গোলে হেরে গেলেও ঘরের মাঠে মাদ্রিদ জিতে ২-১ গোলে। গোলসংখ্যা সমান হলেও অ্যাওয়ে গোলের নিয়মে মাদ্রিদ স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতে নেয়। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সেটাই প্রথমবার, যেখানে শিরোপার নিষ্পত্তি হয় অ্যাওয়ে গোলের মাধ্যমে। ৩ বছর পর স্প্যানিশ সুপার কাপের শিরোপা জয় করে মাদ্রিদ। এই কাপ জয়ের ফলে মরিনহো ইউরোপের চারটা ভিন্ন দেশের কাপ জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন।
নক্ষত্র পতন
তবে এই মৌসুমে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের সাথে মরিনহোর সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ইকার ক্যাসিয়াসের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়কে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে ফ্যানদের কাছে সমালোচনার পাত্র হন। দলের সেরা খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সাথেও তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে কোপা দেল রে’র একটা ম্যাচে ক্রিসের সমালোচনা করায় ক্রিস সেটাকে ভালোভাবে নিতে পারেননি এবং প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে ক্রিস্টিয়ানো সম্পর্কে মরিনহো পরবর্তীতে একটা সাক্ষাৎকারে বলেন,
‘ক্রিস হয়তো ভাবে, সে সবকিছুই জানে এবং কোচের কাছ থেকে তার কিছু শেখার নেই। সেই মুহূর্তে তার সমালোচনা করাটা কিছুটা ট্যাকটিক্যাল ছিল, যা কিনা সে সহজভাবে নিতে পারেনি।’
এছাড়া ম্যাচ চলাকালীন সময়ে বার্সার সহকারী কোচ টিটো ভিলানোভার চোখে খোঁচা দেওয়া, রেফারিদের সম্পর্কে অনবরত পক্ষপাতের অভিযোগ, ক্লাবে কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকদের সাথে বিবাদ, বার্সাকে উয়েফা কর্তৃক সমর্থন করার অভিযোগগুলো মরিনহোকে বিতর্কিত করে তুলে। সেই মৌসুমে লিগে দ্বিতীয় হলেও বার্সেলোনার সাথে তাদের পয়েন্টের ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় ১৫তে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আবারও সেমিফাইনালে উঠলেও বরসিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে হেরে যায় তারা। ঘরের মাঠে ডর্টমুন্ডের স্ট্রাইকার লেভানডস্কির ৪ গোলেই মোটামুটি মাদ্রিদের বাদ পড়াটা নিশ্চিত হয়ে যায়। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একটি অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে ঘরের মাঠে ৩ গোল করতে পারলেও একটা মিরাকল ঘটতে পারতো। কিন্তু ঘরের মাঠে শেষ ১০ মিনিটে ২টি গোল করলে ফাইনালে শেষ অবধি ডর্টমুন্ডই উঠে।
মরিনহোর শেষ ভরসা ছিল কোপা দেল রে। ঘরের মাঠে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ক্রিসের গোলে এগিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে ম্যাচটা হারে রিয়াল মাদ্রিদ। এই মৌসুমকে মরিনহো তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে মৌসুম হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এর তিনদিন পরেই পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে বিদায় নেন মরিনহো।
এবং অনুসিদ্ধান্ত
লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে, পরিসংখ্যানের বিচারে মরিনহোর রিয়াল মাদ্রিদের সফরটাকে ব্যর্থই বলা চলে। তবে মরিনহোর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য সম্ভবত ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটা দল বার্সেলোনাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া। বার্সেলোনার সেই দলটা সত্যিকার অর্থেই দুর্দান্ত ছিল। সেই দানবীয় দলের বিপক্ষে একটি স্প্যানিশ সুপার কাপ এবং একটি কোপা দেল রে জিতে আসাটাও খুব সহজ কোনো কাজ ছিল না। তাছাড়া কোপা দেল রে’র আরেকটা আসরেও (২০১২-১৩) বার্সাকে সেমিফাইনালে হারায় মরিনহোর রিয়াল মাদ্রিদ। এছাড়া একটি লিগ শিরোপা জেতাও ছিল উল্লেখযোগ্য এক সাফল্য।
বায়ার্নের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক মৌসুমের সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে হারা, আর ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে আরেক মৌসুমের সেমিফাইনালে লেভানডস্কির অতিমানবীয় ( ম্যাচে ৪ গোল) একটা দিনের কাছে হেরে যাওয়াটা এটাই প্রমাণ করে যে, ভাগ্যদেবীও মরিনহোর প্রতি কিছুটা নির্দয়ই ছিলেন। মরিনহো কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পেলে হয়তো একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাও অসম্ভব ছিল না।
মরিনহো যখন রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব নেন, তখন মাদ্রিদ অনেকটাই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। দলে তারকা খেলোয়াড় অনেকেই থাকলেও তাদেরকে নিয়ে একটা দলে পরিণত করার জন্য হয়তো আরো কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল।
রিয়াল মাদ্রিদে মরিনহোর আরেকটা কৃতিত্ব ছিল স্কোরার রোনালদোকে আবিষ্কার করা। উইঙ্গার হিসেবে ক্রিস আগে থেকেই অনেক গোল করতেন, তবে মরিনহোর আমলেই মূলত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো গোল মেশিনে পরিণত হন।
রিয়াল মাদ্রিদে থাকা অবস্থাতেই IFHHS কর্তৃক ঘোষিত ২০১২ সালের সেরা ক্লাব কোচের পুরস্কারটা পান মরিনহো।
হ্যাঁ, রিয়াল মাদ্রিদের মতো তারকাসমৃদ্ধ দল নিয়ে এই ফলাফলকে হয়তো ‘সফল’ বলা যাবে না। তবে উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মরিনহোকে ‘একেবারে ব্যর্থ’ বলাটাও উচিত হবে কিনা, সেটা বরং পাঠকের হাতেই তোলা রইলো।