সাকিব আল হাসান ছিলেন এক কথায় অনন্য। এই বাঁহাতির দুরন্ত ধারাবাহিক পারফরম্যান্স প্রশংসিত হয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়ায়। তারপরও গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে (২০১৯) বাংলাদেশ দলের বলার মতো কোনো অর্জন ছিল না। বল হাতে মাশরাফি বিন মুর্তজা ছিলেন বিবর্ণ। বোলিংয়ের কঙ্কালসার নৈপুণ্যের প্রভাব পড়েছিল অধিনায়কত্বেও। ৮ ম্যাচে মাত্র ১ উইকেট নিয়ে মাশরাফি সমালোচিত হয়েছেন দেশজুড়ে। বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের পর ক্রিকেট থেকে এক প্রকার নির্বাসনেই চলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দূরত্ব টেনে ফেলেছিলেন তিনি।
তখন তার অবসর নিয়ে উচ্চকিত ছিল ক্রিকেটাঙ্গনসহ গোটা দেশ। কিন্তু তার অদ্ভুত নীরবতা এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ওয়ানডে ম্যাচহীন সময়টা যেন অবসর-সংক্রান্ত আলোচনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বিপিএল দিয়ে ক্রিকেটে ফিরলেও আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়নি মাশরাফির মাঝে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে মুখ খোলেননি কোথাও।
অবশেষে ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বিপিএলের ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে নিজের মনের ‘গরল’ উগরে দিয়েছেন মাশরাফি। প্রসঙ্গক্রমে আসা প্রশ্নে অবসর, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। ক্ষোভ ঝেড়েছেন, অনেক প্রশ্নে আবার অভিমানও ঝরেছে তার কণ্ঠে। তবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ক্যারিয়ারটা আরও প্রলম্বিত করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত মাশরাফি। দেশের হয়ে খেলার ইচ্ছাটা মরে যায়নি তার। নির্বাচকরা ডাকলে রঙিন জার্সিতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চান তিনি।
পাশাপাশি, ভালো-খারাপ সময়ে ক্রিকেটারদের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বছরের শেষ দিকে চূড়ান্ত ফর্মহীনতায় ভোগা মুস্তাফিজুর রহমানের সমালোচনা করেছেন জাতীয় দল সংশ্লিষ্ট অনেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও। সংবাদ সম্মেলনে সেই সব কর্মকর্তাদেরও এক হাত নিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাশরাফির উত্তরগুলো তুলে ধরা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
বিপিএলে বাংলাদেশের পেসাররা ভালো করছে; মুস্তাফিজ, মেহেদী হাসান রানারা। তরুণ পেসারদের পারফরম্যান্স কেমন দেখছেন?
এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। সামনে তো এই ফরম্যাটের বিশ্বকাপ আছে। অনেক ম্যাচ খেলতে হবে এই ফরম্যাটে। পাকিস্তান সিরিজ হবে কি না, এখনো তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। তো এতগুলো ছেলে ভালো করছে, আশা করি ওরা আত্মবিশ্বাসী থাকবে। এখানের উইকেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক উইকেটের পার্থক্য থাকবে। আরেকটু অন্যরকম থাকবে আন্তর্জাতিক ম্যাচের উইকেট। এখান থেকে যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেবে, সেটা অনেক বেশি সাহায্য করবে জাতীয় দলে আসার পর।
এই মুহূর্তে যারা শেষ টি-টোয়েন্টি খেলে এসেছে, আল-আমিন ভালো করছে, শফিউল খুব ভালো করছে, মুস্তাফিজ ভালো করছে। মুস্তাফিজ হয়তো ভারতে ভালো খেলতে পারেনি। এখন সবাই যেহেতু ছন্দে আছে, আশা করি ওরা এটা চালিয়ে যাবে। ক্রিকেটারদের সেভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা জরুরী। এটা শুধু এমন না যে, সমালোচনা করে, আমি বলছি না যে, আপনারা লিখছেন। আমি বলছি, একটা বিষয় হচ্ছে যে, তাদের যারা মনিটর করছে তারাও যদি আপনাদের সামনে সমালোচনা করে, তো খুব স্বাভাবিকভাবে তারা আরও ভেঙে পড়বে। যখন ভালো করছে, ভালো বলবে; যখন খারাপ করছে, তখন খারাপ বলবে… আমি মনে করি না যে, এটা তাদের সাথে যারা কাজ করে, ওদের কাজ। তাদের কাজ হচ্ছে সবসময় ক্রিকেটারদের ব্যাকআপ করা, তারা যেন ওদের পাশে থাকে। আর এই সময়টাকে যেভাবে ব্যবহার করা যায়, বা যদি কেউ ভালো করে, এটাকে কীভাবে এক-দুই ধাপ এগিয়ে নেয়া যায়, সেটার চেষ্টা করা। এটা ওদের কাছে যারা আছে, তাদের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।
আপনি যদিও টেস্ট বা টি-টোয়েন্টি খেলেন না। কিন্তু যদি ওই দুই ফরম্যাটে খেলতেন আপনি, তাহলে আপনি কি এখন পাকিস্তানে যেতেন?
সত্যি বলতে, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি যেতাম। আমি এটা নিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলতাম। আমি জানি না, আমার পরিবার কী বলত। আমাকে নিয়ে এটা প্রথম আলোচনা হচ্ছে। আপনি যদি শুধু যাওয়ার কথা বলতেন, তাহলে আমি যেতাম হয়তো বা। আমার পরিবার কী বলে, এটার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। আর আবারও বলছি, আবার এর মানে এই না যে যারা যেতে চায় তারা ভুল, বা আমি জানি না কী হয়। কারণ, খেলার চেয়ে জীবন অবশ্যই সব কিছুর আগে। ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এখানে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। যে যেভাবে সিদ্ধান্ত দিবে, সম্মান রেখেই বলছি, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জায়গায় ঠিক আছে।
আপনার অবসর নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আপনি অবসর নেননি, সময় নিয়েছেন। এখন অবসর নিয়ে কী চিন্তা করছেন?
অবসরের কথা যেটা বললেন, আমার জায়গা থেকে… আপনি বলতে পারেন, আমাকে রিটায়ার সবাই করিয়ে দিয়েছে। আমি নিজেও হয়তো বা ঐ জায়গায় অবস্থান করছি। আমি শুধু যেটা খেলছি, সেটাকেই উপভোগ করছি। মাঠ থেকে রিটায়ার করবো কি করবো না, সেটা এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। যদি ওরকম কিছু মনে হয়, ক্রিকেট বোর্ড যদি মনে করে, তাহলে চিন্তাভাবনা করব।
আমি যখন খেলা শুরু করেছিলাম, আমি আবার সেই জায়গাতে ফিরে গিয়েছি। আমি এখন বিপিএল খেলছি। সামনে ঢাকা লিগ উপভোগ করব, খেলব। সবসময় জাতীয় দলে খেলতে হবে, জাতীয় দলে খেললেই আপনি প্লেয়ার, সেরকম তো না। এখন হয়তো ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। নট নেসেসারি, নিজেকে আমার এত প্রায়োরিটি দেবার দরকার আছে। আমি নিজেকে কখনো এত প্রায়োরিটি দিই-ও না যে, আমাকে মাঠ থেকে বিদায় দিবেন সবাই, ফুলের তোড়া নিয়ে আসবে; নট নেসেসারি। আমি যেরকম আছি, ভালো আছি, খুশি আছি। আমি উপভোগ করছি খেলা, খেলছি। জাতীয় দল অনেক দূরের ব্যাপার।
যদি সুযোগ থাকে তবে কি জাতীয় দলে খেলবেন?
এখন সিলেকশনের তো একটা ব্যাপার। সত্যি বলতে, বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচে ১ উইকেট পাবার পর, আমার মতে, আমি দলে সুযোগ পাব না। এটা তো আসলে সিলেকশনের ব্যাপার। নির্বাচকরা যদি মনে করে, আমাকে সুযোগ দিবে, আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। এই মুহূর্তে ৮ ম্যাচে ১ উইকেট পেয়ে আমি কীভাবে আপনাদের সামনে বলি যে, আমি জাতীয় দলে সুযোগ পাব? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো আরো আগে বাদ পড়ত।
কিন্তু আপনি তো শ্রীলঙ্কা সিরিজে ছিলেন। ইনজুরির কারণে যেতে পারেননি…
শ্রীলঙ্কা সিরিজে ছিলাম, সেখানে হয়তো আমার ব্যাক করার একটা সুযোগ ছিল। শ্রীলঙ্কা সিরিজে সাকিবও ছিল না। সবকিছু মিলে একটা সুযোগ আমার এসেছিল। এরপর তো দেখেন, আর কোনো খেলার ভিতরে আমি নেই। জানি না, নির্বাচকদের কী চিন্তাভাবনা আছে, আমার সাথে আলোচনা হয়নি। এরপর তো আরো প্লেয়ারদের সাথে কথা হয়েছে, আমার সাথে কোনো কথা হয়নি। তো এক পক্ষ থেকে আমি কীভাবে বলব?
খেলোয়াড় হিসাবে যতটুকু চিন্তা করার কথা, আমি অতটুকুই করছি। খেলছি, উপভোগ করছি। যদি ওয়ানডে আসে, তারা মনে করে আমাকে সুযোগ দেবে, তাহলে খেলব। কারণ, দিনশেষে ক্রিকেটটাই আমার কাছে সব। আমি সবসময় বলে এসেছি, যেখানে যাই, যা-ই করি; ক্রিকেটটাই আমার কাছে সব। তো ক্রিকেটটা আমি মন দিয়ে খেলি। আর যতদিন খেলব, জাতীয় দল বা অন্য কোথাও মন দিয়েই খেলব। বাদবাকি, অধিনায়কত্ব নিয়ে কী হবে, সেটা বোর্ডের সিদ্ধান্ত। আমাকে যদি বলে, তখন আমি বলব।
নির্বাচকরা যদি বলে, তুমি খেলতে চাও কি না?
আমি এখন কী করছি? যখন জিম্বাবুয়ে সিরিজে আমাকে বলা হয়েছিল, আমি বলছি, খেলব। আমার দিক থেকে আমি বলতে পারি, আমি খেলতে চাই। সেটা জাতীয় দল হতে হবে, এমন কিছু নয়। আমার জায়গায় যারা খেলছে, তারাও ভালো করছে। এটা জরুরী না, জাতীয় দলে খেলতেই হবে। এখন বোর্ড যদি মনে করে, আমাকে খেলাইতে চায়, আমি বলব, অবশ্যই খেলবো, অবশ্যই! আর বাকিটা যেটা বললেন, আমি খেলছি তো খেলার জন্যই, এমন তো না যে আমি ফাজলামো করছি। খেলার জন্যই খেলছি। যেটা হলো, পারফরম্যান্স বা অন্য সব কিছু মিলায়া বলেন, সবকিছু তো ওনারাও ভাববে, যারা দায়িত্বে আছেন।
যে কথাটা আমি মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে বলেছি, তাকে যত্ন করাটা খুব জরুরী। এ কথাটা সংক্ষেপে বলেছি। তাকে নিয়ে যদি সমালোচনা আমরাই করতে থাকি… আপনাদের কথা, দর্শকদের কথা আলাদা। সবাই চাইবে ভালো করুক, দর্শকরাও চাইবে ভালো করুক, ভালো না করলে সমালোচনা করবে এটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি যখন মুস্তাফিজের দায়িত্বে আছি, তখন আমি কেন মুস্তাফিজকে নিয়ে আপনাদের সামনে সমালোচনা করব?
তখন আমি মুস্তাফিজকে আগলে রাখার চেষ্টা করব। আমার যদি মুস্তাফিজের অর্ধেকও থাকে বাংলাদেশে, ফাইন, আমাকে একটা হাফ-অফ মুস্তাফিজ দেখান বাংলাদেশে। থাকলে আপনি দেখান আমাকে। সেটা নাই, তো আমরা যারা মুস্তাফিজকে তৈরি করতে চাচ্ছি, মুস্তাফিজ বিশ্বকাপে ২১ উইকেট নিয়ে এসেছে, হয়তো বা ইকোনোমি রেট খারাপ, অনেক কিছু থাকতে পারে। এখন এ জিনিসটা ঠিক করব কীভাবে? ঠিক করার তো একটা উপায় আছে। পৃথিবীর অনেক বড় বোলারেরও খারাপ ফর্ম গিয়েছে। আমাদের দেশে কেন হচ্ছে না?
কারণ, আমাদের দেশে মুস্তাফিজকে নিয়ে যারা কাজ করছে, তারাও আপনাদের ভাষায় কথা বলছে, বাইরের মানুষ যেটা বলছে, সেভাবেই কথা বলছে। তো নিজস্ব চিন্তাভাবনা কই, আমি মুস্তাফিজকে ঠিক করব? মুস্তাফিজকে নিয়ে সমালোচনা করে পরের দিন তাকে নিয়ে আবার আমি মাঠে কাজ করতে যাচ্ছি। তো মুস্তাফিজ কি মানুষ না? তার যে চিন্তাভাবনা, সে আপনার কাছে কীভাবে শেয়ার করবে? কারণ, আপনি ২৪ ঘন্টা আগে মুস্তাফিজকে নিয়ে সমালোচনা করে আসছেন।
খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে অনেক বুস্টআপ করার প্রয়োজন আছে। আমার মনে হয়, এটা মিসিং। আমার মনে হয়, যে বোলাররা ফর্মে এসেছে, তাদের যে ঘাটতি আছে, মুস্তাফিজের ইকোনমি রেট বা অন্য যা কিছু সমস্যা আছে, সব ঠিক করার জন্য কাজ করা উচিত বলে মনে করি। তাহলে মনে হয় ফল আসবে, সবার মতো ওনারাও গা ভাসায়া দিলে বাংলাদেশ ক্রিকেট এভাবেই চলতে থাকবে।
মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা কি আপনার সাথেও হয়েছে?
না, আমার ক্ষেত্রে হয়নি। সমস্যাটা এখানেও আছে। আমার কাছে যেটা মনে হচ্ছে, আমার সাথে যেটা হয়েছে, অগোচরে। আর মুস্তাফিজের সাথে যেটা হচ্ছে, সেটা সামনে। আপনাদের সাথে এসে যারা কথা বলছে, সেটা তো মুস্তাফিজ দেখছে। একটা কথা হলো, আপনি বিশ্লেষণ করছেন, এটা ঠিক আছে। কারণ, আপনাদের কাজই এটা। আমি সবসময় যেটা মনে করি, দর্শকরাও সেভাবে দেখবেন, কারণ তারা আমাদের কাছে ভালো পারফরম্যান্স আশা করেন, না হলে সমালোচনা করবেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যখন মুস্তাফিজের সাথে কাজ করছি, আমি কিন্তু মুস্তাফিজের একটা অংশ। আমার তো দায়িত্ব আছে মুস্তাফিজকে ঠিক করে আনার। আমি যখন মুস্তাফিজকে নিয়ে সমালোচনা করছি, তখন তো আমিও সমালোচিত হতে পারি যে, তাহলে তুমি কী কাজ করছো মুস্তাফিজের সাথে?
মাশরাফি সম্বন্ধে আরো জানতে পড়তে পারেন বই। বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-