অবশেষে জাতীয় দলে ডাক পেলেন মাইকেল ক্লিংগার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আসন্ন টি-টুয়েন্টি সিরিজের জন্য ঘোষিত ১৩ সদস্যের দলে জায়গা করে নিলেন ভিক্টোরিয়ার এই ব্যাটসম্যান। ৩৭ বছর বয়সে এসে অভিষেক হতে যাচ্ছে প্রায় ২০ বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা মাইকেল ক্লিংগারের।
অস্ট্রেলিয়ার সোনালি যুগে মাঝারি মানের ক্রিকেটার হয়ে জন্ম নিয়ে এতদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডাক পাননি মাইকেল ক্লিংগার। শেষপর্যন্ত জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেলেন ডানহাতি এই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। সদ্য সমাপ্ত বিগ ব্যাশে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করে নিজ দল পার্থ স্কোচার্সকে শিরোপা জিতানোর পাশাপাশি নির্বাচকমণ্ডলীর নজরে পড়েন।
বিগ ব্যাশের ফাইনালে অপরাজিত ৭১ রান করে পার্থকে সহজ জয় এনে দেওয়া সহ টুর্নামেন্টে ৩৭.১১ ব্যাটিং গড়ে ৩৩৪ রান করে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক মাইকেল ক্লিংগার।
সামনেই উপমহাদেশের মাটিতে লম্বা সিরিজ। দলের নিয়মিত সদস্যদের বিশ্রাম দিয়ে বিগ ব্যাশে পারফর্ম করা ক্রিকেটারদের নিয়েই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টুয়েন্টি সিরিজের জন্য দল ঘোষণা করেছে অস্ট্রেলিয়া। সেখানে জায়গা করে নিয়েছেন “দ্যা জুয়েশ ব্রাডম্যান।”
ক্রিকেটাঙ্গনে মাইকেল ক্লিংগার নামটা ইতোমধ্যেই বেশ পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিচিত মুখ, সেইসাথে কাউন্টি ক্রিকেট এবং আইপিএলের কল্যাণেও ক্রিকেটপ্রেমীদের নজরে পড়েছেন ক্লিংগার।
১৯৮০ সালে ভিক্টোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করা মাইকেল ক্লিংগার প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট একাডেমির হয়ে। এর আগে অস্ট্রেলিয়া অনুর্ধ্ব-১৯ দলের নেতৃত্ব দেন ক্লিংগার, যেখানে তার সহকারী হিসাবে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক।
দ্রুত উন্নতি করে মাইকেল ক্লার্ক জাতীয় দলে জায়গা করে নিলেও ক্লিংগারের সুযোগ হয়ে উঠেনি হেইডেন, গিলক্রিস্ট, পন্টিংদের মতো ব্যাটসম্যানদের টপকে অস্ট্রেলিয়ার সোনালি সময়ে সাজঘরে প্রবেশ করার।
প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করার পর লিংগার আলোচনায় আসেন ঐতিহাসিক ৯৯ রানে অপরাজিত থাকার পর। ২০০০-০১ মৌসুমে ৯৯ রানে ব্যাট করার সময়ে অধিনায়ক পল রাইফেল তাকে শতক হাঁকানোর সময় না দিয়ে ইনিংস ঘোষণা করেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ঘটনার সাক্ষী হতে পারেননি আর কেউই।
এই ঘটনার পর মাইকেল ক্লিংগার বেশ কয়েকবছর ব্যাটে রান পাচ্ছিলেন না সেভাবে। শেষ পর্যন্ত তার মতো আরেক ক্রিকেটার ব্রাড হজ জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার কারণে ভিক্টোরিয়ার হয়ে খেলার সুযোগ পান। ব্রাড হজের ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ার কারণে জাতীয় দলে বেশিদিন টিকতে পারেননি। আর মাইকেল ক্লিংগারের ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ার কারণে ভিক্টোরিয়ার মূল একাদশেই নিয়মিত সুযোগ পাননি।
২০০৮-০৯ মৌসুমে ভিক্টোরিয়া ছেড়ে যোগ দেন সাউথ অস্ট্রেলিয়ায়, সেখানে ওপেনিংয়ের চেয়ে তিন নাম্বার পজিশনেই বেশি ব্যাট করতে দেখা যায় তাকে। এখানে নিয়মিত রান পেতে থাকেন মাইকেল ক্লিংগার। সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় নিজের প্রথম শতক হাঁকান ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ১৫০ রানের ইনিংসের মধ্য দিয়ে। তার কিছুদিন পর ২৫৫ রানের ইনিংস হাঁকিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বিশতকের দেখা পান ক্লিংগার। ঐ মৌসুমে শেফিল্ড শেইল্ড এবং ফর্ড রেঞ্জার কাপে নিয়মিত রান পেতে থাকেন সাউথ অস্ট্রেলিয়া রেডব্যাকসের হয়ে।
ধারাবাহিক পারফরমেন্সের কারণে ২০১০ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়া রেডব্যাকসের অধিনায়কের দায়িত্ব পান ক্লিংগার।আইপিএল, বিগ ব্যাশের কারণে তখন টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের উন্মাদনা চলছিলো ক্রিকেট বিশ্বে। আর এতে নিজের জাত চেনানোর সুযোগ মিলে গেল ক্লিংগারের। ২০১১ সালে আইপিএলের নিলামে তাকে দলে ভেড়ান কোচি টাস্কার্স কেরালা। ঐ আসরে ৪ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে সর্বসাকুল্য ৭৩ রান সংগ্রহ করেন ক্লিংগার।
২০১২ সালের শেষ মাসে ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে গ্লৌচেস্টারশায়ারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন মাইকেল ক্লিংগার। নিজের প্রথম মৌসুমে এই দলের অন্যতম বিদেশি ক্রিকেটার তো ছিলেনই, গ্লৌচেস্টারশায়ারের অধিনায়কের দায়িত্বও পেয়ে যান ক্লিংগার।
ঐ মৌসুমে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ এবং লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটে হাজারের উপর রান করেন ক্লিংগার। ২০১৪ সালে নিয়মিত অধিনায়ক হিসাবে গ্লৌচেস্টারশায়ারের হয়ে খেলেন এবং ইনজুরিতে পড়ার আগে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাদের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন। ধারাবাহিক পারফরমেন্সের কারণে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ায় গ্লৌচেস্টারশায়ার।
২০১৫ মৌসুমে ইনজুরি কাটিয়ে ফিরে আসেন ন্যাটওয়েস্ট টি-টুয়েন্টি ব্লাস্ট টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে। ঐ টুর্নামেন্টে মাত্র ১২ ম্যাচে ৮১.৭৫ ব্যাটিং গড় এবং ৩ টি শতক এবং ৪ টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৫৬ রান করে বুড়ো বয়সে সবার নজর কাড়েন মাইকেল ক্লিংগার।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলে তখনও সুযোগ পাননি ক্লিংগার। রিকি পন্টিং, গিলক্রিস্ট, হেইডেনদের মতো ক্রিকেটারদের অবসরের পর ক্লিংগারের বয়স তখন ত্রিশের ঘর অতিক্রম করেছে। এসময় তাকে দলে নেওয়ার চেয়ে ওয়ার্নার, খাজা, স্মিথদের মতো তরুণ ক্রিকেটারদের দলে নেওয়াটাই ভালো মনে করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বোর্ড কর্মকর্তারা, যার দরুন জাতীয় দলে খেলার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন মাইকেল ক্লিংগার।
শেষপর্যন্ত টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট দিয়ে হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পেলেন ক্লিংগার। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট তার জন্য এসেছে আশীর্বাদ স্বরূপ। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্ট বিগ ব্যাশে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। বিগ ব্যাশে ৫১ ম্যাচে ৩৬.৫৪ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১৬০৮ রান।
সব ধরনের টি-টুয়েন্টি ম্যাচে এখন পর্যন্ত ক্লিংগার ১৩০ ইনিংসে ৩৮.৭৬ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৪২২৫ রান এবং হাঁকিয়েছেন ৬ টি শতক। এই পারফরমেন্স দেখিয়েই অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন আধপাকা চুল এবং দুর্দান্ত সব শট সাথে নিয়ে।
মাইকেল ক্লিংগার সীমিত ওভারের ক্রিকেটে পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ছিলেন অসাধারণ। ঘরোয়া একদিনের ক্রিকেটে ১৬৩ ম্যাচে ৪৮.৮৬ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৬৭৪৩ রান। এর মধ্যে ১৬১ ইনিংসে মধ্যে ১৫ টি শতক এবং ৪২ টি অর্ধশতকের ইনিংস খেলেছেন তিনি।
টেস্ট ক্রিকেটে তুলনামূলক কম সাফল্য পেয়েছেন সীমিত ওভারের ম্যাচের তুলনায়। ১৭৭ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে রান করেছেন ৩৯.৭৩ ব্যাটিং গড়ে। ১৭৭ ম্যাচের ৩১৩ ইনিংসে ৩০ টি শতক এবং ৪৮ টি অর্ধশতকের মাধ্যমে করেছেন ১১ হাজার ১২৫।
নিয়মিত ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করা মাইকেল ক্লিংগারের পরিচয় জানতে হলে অনেকেরই দুইবারের বেশি ভাবা লাগে। কখনো ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে কিম্বা বিগ ব্যাশে অধিনায়কের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাকে, কিন্তু এই দুই দেশের কোনোটিতেই দেশের সাজঘরে প্রবেশ করার ছাড়পত্র পাননি এতদিন।
শেষপর্যন্ত বুড়ো বয়সে হলেও নিজেকে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসাবে ক্রিকেট বিশ্বে পরিচয় দিতে পারবেন কুঁজো হয়ে ব্যাটিং করা ক্লাসিক এই ওপেনিং ব্যাটসম্যান।