জোহানেসবার্গ, স্বর্ণের শহর। এই শহরের তলায় লুকিয়ে থাকা স্বর্ণ এবং স্বর্ণের খনিকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে জীবিকা আবর্তিত হয়েছে কতশত মানুষের। জীবিকার সাথে মিশে আছে শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচারের গল্প। সেসব চাপা পড়ে আছে খনির অতল গহ্বরে। একেকটা গল্প ধুলিস্মাৎ হয়ে গেছে ডিনামাইটের আঘাতে।
মূলত গোল্ড মাইন বা স্বর্ণের খনিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে শহরটি। ডিনামাইট, শ্রমিক আর অন্ধকারে ভরা স্বর্ণের খনির গল্পটা না হয় তোলা থাক অন্য কোনোদিনের জন্য। তার চেয়ে চলুন ঘুরে আসি প্রায় এক যুগেরও আগে জোহানেসবার্গেই হওয়া একটা ক্রিকেট ম্যাচ থেকে। ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট স্টেডিয়ামের স্মৃতির খনিতে একটু খোঁড়াখুঁড়ি করলেই সবার আগে উঁকি দেবে সেই অমূল্য রতনটি।
সে এক ম্যাচ ছিল বটে…
মিড অফ, কভার, পয়েন্ট আর গালিতে দাঁড়িয়ে অফ সাইড ব্লক করে দিয়েছেন ফিল্ডাররা। ফাইন লেগ, মিড উইকেট, মিড অনেও প্রহরী বসিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং। প্রতিপক্ষের টুঁটি চেপে ধরা ফিল্ড পজিশন নিয়ে বল হাতে ছুটছেন ব্রেট লি। পুরো স্টেডিয়াম তখন জীবন্ত। গতি তারকার হাত থেকে ছুটে গেল একটা গুড লেংথ ডেলিভারি। মিড অনের উপর দিয়ে তুলে মারলেন মার্ক বাউচার। পুরনো হয়ে যাওয়া বলটাও তখন ছুটছে বাউন্ডারি পানে। প্রোটিয়াদের জন্য, ক্রিকেটের জন্য নতুন একটা দিনের খোঁজে…
মিরাকল, অদ্ভুতুড়ে
৫০ ওভার শেষে স্কোরকার্ডে ২৫০ রান মানেই তখন ম্যাচ জেতার রসদ। একাদশে তিন-চারটা বারুদে বোলার। আর কী চাই!
২০০৬ সালের ১২ মার্চ। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ২-২ সমতায় স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা ও অতিথি অস্ট্রেলিয়া। শেষ ওয়ানডের গায়ে লেগে গেল তাই ‘অঘোষিত ফাইনাল’। টস জিতে ব্যাটিং নেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-সাইমন ক্যাটিচ জুটি টিকে থাকলো প্রায় ১৬ ওভার পর্যন্ত। গিলক্রিস্ট ফিরলেন ক্যাটিচের সঙ্গে ৯৭ রানের জুটির পর।
মাখায়া এনটিনি, অ্যান্ড্রু হল, ইয়োহান ভ্যান ডার ওয়াথদের ওপর অজি ব্যাটসম্যানের ছড়ি ঘোরানো দেখে সবাই হয়তো ভেবেছিলেন, ৩০০ অথবা খুব বেশি হলে ৩৫০ রান করবে অস্ট্রেলিয়া। কারণ, তখনও ৪০০ রান দেখেনি ওয়ানডে ক্রিকেট। বিখ্যাত ইংরেজি প্রবাদ আছে, ‘মর্নিংস শোজ দ্য ডে’। কিন্তু ভোজবাজির মতো সব পাল্টে যেতে থাকে পন্টিং ব্যাটিংয়ে আসার পরপরই।
এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অজি অধিনায়ক কামান দাগালেন প্রোটিয়াদের ওপর। সেই প্রবাদকেও ছাড়িয়ে গেল তার ব্যাটিং। একটা করে ওভার কেটেছে, সাথে বেড়েছে রানরেটের গ্রাফ পেপারের উলম্ব রেখার গতি। ব্যাটিংয়ের সঙ্গী বদলেছে, ক্যাটিচ ফিরেছেন, মাইকেল হাসি এসেছেন। দু’জনের তাণ্ডবে হু হু করে বেড়েছে রানরেট। দিশেহারা হয়েছে প্রোটিয়া বোলাররা। আলাদা করে বলতেই হবে পন্টিংয়ের কথা। ইনিংসের বয়স যত বেড়েছে, আরো নির্দয় হয়েছেন তিনি। হাঁকিয়েছেন ১৩ চার ও নয়টি ছক্কা!
তখনকার ‘সেইফ স্কোর’ ২৫০ অস্ট্রেলিয়া ছাপিয়ে যায় ৩৫ ওভারেই। ইনিংসের বাকি ১৫ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে অস্ট্রেলিয়ার রান ৪৩৪/৪! ওয়ান্ডারার্সে রান পাহাড় গড়ল অজিরা, যার মধ্যে একাই ১৬৪ করেছেন পন্টিং। এই মাঠেই ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে দারুণ একটা সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। সেই সেঞ্চুরিটা তাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিল।
প্রোটিয়া বোলাররা কেমন বোধ করছিলেন তখন? মাখায়া এনটিনির ভাষ্য,
‘একেকটা ওভার শেষ করার পর আমাদের বোলাররা স্রেফ পালিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কেউই চাচ্ছিল না অধিনায়কের ডাকে সাড়া দিতে।’
বলাই বাহুল্য, সেই মুহূর্তে সেটাই ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ড। কে জানতো, স্রেফ কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই রেকর্ডটা হাতছাড়া হয়ে যাবে অজিদের?
ডাবল মিরাকল, আরো বেশি অদ্ভুতুড়ে
ব্রেট লি, নাথান ব্র্যাকেন, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক, আর মাইক লুইস। চার পেসারকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বোলিং অ্যাটাক। শেষজন খুব একটা নামজাদা কেউ না হলেও প্রথম তিনটি নাম তো রীতিমতো সমীহ-জাগানিয়া। ৪৩৫ রানের ‘অসম্ভব আর পর্বতপ্রতীম’ লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নামা দক্ষিণ আফ্রিকা কি পারবে শেষ পর্যন্ত?
এই রান পাহাড় টপকাতে যেমন শুরুর দরকার ছিল, তেমনটা হয়নি। দ্বিতীয় ওভারেই ফিরে যান বোটা ডিপেনার। সেটাই শাপেবর হয়েছিল, ডিপেনারের আউট হওয়া। তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাট করতে যান হার্শেল গিবস। অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ আর গিবস মিলে শুরু করেন তাণ্ডবলীলা। পাত্তাই পাননি ব্রেট লি-ব্র্যাকেন-ক্লার্ক-লুইসরা।
১৮৭ রানের বিশাল জুটি। স্মিথ থামেন ৫৫ বলে ৯০ রান করে। অল্পের জন্য সেঞ্চুরিটা হয়নি। অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোরবোর্ডে তখন ২২ ওভারে ১৯০ রান! অসম্ভব, বৈরি আর বিশাল রানের পর্বত টপকানোর কথা বোধহয় তখনই ভেসে বেড়াচ্ছিল জোহানেসবার্গের বাতাসে। সেই হাওয়া আরো জোরালো করে দিলেন গিবস। ১১১ বলে ১৭৫ রান করে থামেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ২১টি চার ও সাত ছক্কা! পন্টিংকেও ছাপিয়ে গেলেন তিনি। অজি বোলারদের করে দিলেন ম্লান, মলিন।
কিন্তু তাতেও কি আদৌ বোঝা যায় এই ইনিংসের মূল্যমান? পরিসংখ্যান যে মুগ্ধতার ফিরিস্তি দেয় না!
কাজ তখনও ঢের বাকি। জ্যাক ক্যালিস খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। পারেননি জাস্টিন কেম্পও। একাই রইলেন মার্ক বাউচার। তাকে অপর প্রান্তে রেখে ভ্যান ডার ওয়াথ টানা দুই ছয় হাঁকান লুইসকে। সেই লুইসের ওপর দিয়েই সবচেয়ে বড় ঝড়টা গিয়েছে, ১০ ওভার বল করে দিয়েছেন ১১৩ রান। ওয়ানডেতে যা এখনো টিকে রয়েছে সবচেয়ে খরুচে বোলিং ফিগার হিসেবে।
ভ্যান ডার ওয়াথের ৩৫ রানের ক্যামিও থামে ব্র্যাকেনের বলে। তখন ২১ বলে আরো ৩৬ রানের প্রয়োজন প্রোটিয়াদের। অজিদের ম্যাচ জিততে চাই আরো তিন উইকেট। পেন্ডুলামের মতো দুই পাশেই দুলতে থাকে ম্যাচটা। এক ওভার পর আউট হন রজার টেলেমেকাস। ম্যাচের পাগলা ঘোড়ার লাগাম তখন চলে যায় পন্টিংদের হাতে।
পেন্ডুলাম
শেষ ওভারের সমীকরণ, দুই উইকেট রেখে সাত রানের দরকার আফ্রিকার। ব্রেট লি’র করা প্রথম বলে সিঙ্গেল নেন বাউচার, পরের বলে অ্যান্ড্রু হলের চার। ম্যাচটা ঝুঁকে যাচ্ছে আফ্রিকার দিকে। নাটকীয়তা তখন আরো বাকি। ওয়ান্ডারার্সের দর্শকরা তখন একদম জীবন্ত। ম্যাচের আবহের সাথে বদলে যাচ্ছে তাদের চিয়ারিং। হল থামেন ক্লার্কের হাতে ক্যাচ দিয়ে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে এনটিনি। থার্ড ম্যানে গাইড করে দিয়ে প্রাণপণে এক সিংগেল।
দুই বলে প্রয়োজন এক রান। চোকার তকমাটা গায়ে লেগে আছে প্রোটিয়াদের। বাউচারেরর সামনে সুযোগ সেই তকমাটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলার। সুযোগটা নিলেন তিনি। মিড অন দিয়ে তুলে মারলেন ব্রেট লি’কে। প্রাণপণ দৌড়াতে দৌড়াতেই বাউচার খেয়াল করলেন, পুরনো হয়ে যাওয়া বলটা ততক্ষণে বাউন্ডারি পেরিয়েছে, সাক্ষী হয়েছে অসম্ভবকে সম্ভব করার। চার! অসাধ্য সাধন করেছে তারা, অবিশ্বাস্য এক মাইলফলক! প্রোটিয়াদের জন্য, ক্রিকেটের জন্য বাউন্ডারিটা এনে দিয়েছে নতুন একটা দিন।
ক্রিকেটে এমন ম্যাচ প্রতিদিন দেখা যায় না। ২৫০ রানের ভিন্টেজ ক্রিকেটের যুগে এভাবে রানবন্যায় ভাসার কথাও ভাবেননি কেউ। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে তখনও ৪০০ রানের দেখা মেলেনি। সেখানে একই ম্যাচে দুইবার ৪০০ ছাড়ানো স্কোরবোর্ড! রীতিমতো অলৌকিক, অবিশ্বাস্য, পিলে চমকে দেয়া এক ম্যাচ। ভৌতিক কাণ্ডই বটে। কে ভেবেছিল, অস্ট্রেলিয়ার ৪৩৪ রান এক বল হাতে রেখেই টপকে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা!
মাউন্ট এভারেস্টের চুড়ায় প্রথম পা রেখেছিলেন এডমন্ড হিলারি ও শেরপা তেনজিং নোরগে। ঠিক তেমনি ঘন্টা তিন-চারেকের ব্যবধানে রানের এভারেস্টে পতাকা উড়ানো অস্ট্রেলিয়াকে ছুঁয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের পতাকাটা অজিদের চেয়ে আরো একটু উঁচুতে উড়ছে এখনো। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ডটা এখনও বহাল তবিয়তে আছে প্রোটিয়াদের দখলে।
ক্রিকেটে এখন ৪০০ ছাড়ানো স্কোর হয় অহরহ। এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ইংল্যান্ডের। ৪৮১/৬, সেটাও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই। ক্রিকেটের বদলে যাওয়া নিয়মে বেশি নিরুপায় বোলাররাই; ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন, পাওয়ারপ্লে আর ব্যাটসম্যানদের হাত খুলে খেলা। টাই, বোল-আউট, সুপার ওভার… কত কিছুর দেখাই মিলেছে এতদিনে। তবুও টি-টোয়েন্টির দাপটের এই যুগে কোনো দলই ফিরিয়ে আনতে পারেনি ২০০৬ সালের ওয়ান্ডারার্সকে। দুনিয়াকে চমকে দেওয়া এমন আর একটি ম্যাচও হয়নি। সর্বকালের সেরা ওয়ানডের তালিকা করলে জোহানেসবার্গের সেই ম্যাচটা সবার ওপরেই থাকবে বোধহয়।
২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল সবার মনে আলাদা করে জায়গা নিয়েছে দারুণ নাটকীয়তার জন্য। কারণ, বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে এমন দৃশ্য দেখা যায়নি আগে। তবে পরিস্থিতি, ক্রিকেটের সার্বিক নিয়ম, প্রতিপক্ষ বিবেচনায় জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা হয়তো এগিয়েই থাকবে। ক্রিকইনফোও তখন লিখেছিল,
‘সর্বকালের সেরা ম্যাচটা দক্ষিণ আফ্রিকাই জিতেছে।’
হ্যাঁ, ওয়ান্ডারার্সে মিরাকল ঘটিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সেই মিরাকলের মোহ, মায়াবী ঘোর কেটে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার দাপটে। সেটা তার চেয়ে বড় মিরাকলই বটে! সেই বিস্ময়ের ঘোর এখনো হয়তো কাটেনি দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া আর ওয়ান্ডারার্সের দর্শকদের।