শেষটা খুব সুন্দর হলো না। ফাইনালে এসে দেখলেন কিছু বিতর্ক। শুনলেন সেরেনা উইলিয়ামসের বৈষম্যের অভিযোগ। দেখলেন নিজের ছোটবেলার আইডল সেরেনার কান্না। এসব বিতর্ক আর চোখের পানিতে মঞ্চটা একটু ম্লান হয়ে গেল। কিন্তু তাতে কি আর অর্জন ছোট হয়ে যায়?
বিশাল এই মঞ্চে শেষবেলায় সেরেনা উইলিয়ামসকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদলেন। তবে এই কান্না গর্বের, এই কান্না আনন্দের। এই কান্না দিয়ে ইউএস ওপেনের ৫০তম আসরে রানী হিসেবে অভিষেক হলো নাওমি ওসাকার। আর এই কান্নার ভেতর দিয়েই জাপানের ঘরে উঠলো ইতিহাসের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম ট্রফি। হ্যাঁ, ইউএস ওপেনের নতুন রানী এখন নাওমি ওসাকা।
নামের মাঝেই যেন আছে তার জন্মস্থানের উল্লেখ। ১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর জাপানের ওসাকা নগরীতে জন্ম আজকের এই তারকার। জন্মসূত্রে তিনি জাপানের নাগরিক, খেলেনও জাপানের পতাকা হাতে নিয়ে, তবে তার জাতীয়তার পরিচয় বহুবিধ।
ওসাকার বাবা লিওনার্দ স্যান ফ্রান্সিস মূলত হাইতির অধিবাসী। এরপর অবশ্য তিনি ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে উঠেছেন। সেখানেই পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে জাপানি ছাত্রী তামাকি ওসাকার সাথে। তারা দুজন একসময় সংসার করেছিলেন জাপানে এসে। সেখানেই তাদের কোল জুড়ে আসে নাওমি।
নাওমি ওসাকার বয়স ৩ হতে না হতেই তারা সপরিবারে আবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। সেখানেই নাওমির টেনিস শেখা, সেখানেই বড় হয়ে ওঠা। নাওমি যখন পেশাদার টেনিসে এলেন, তখন তিনি ইচ্ছে করলে তিনটি দেশের যেকোনো একটি দেশকে নিজের দেশ বলে বেছে নিতে পারতেন- যুক্তরাষ্ট্র, হাইতি ও জাপান। এই কিশোরী সিদ্ধান্ত নিলেন, মায়ের দেশ ও নিজের জন্মভূমি জাপানেরই প্রতিনিধিত্ব করবেন।
জাপানি ভাষাটা ঠিক বলতে পারেন না। তবে শুনলে দিব্যি বুঝতে পারেন। জাপানি বলতে না পারায় নাওমির জাপানি হয়ে ওঠায় কোনো বাঁধা আসেনি। তিনি নিজেকে জাপানি বলে খুব গর্ববোধ করেন। সেই সাথে নিজেকে হাইতির একজন বলেও পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। আর যুক্তরাষ্ট্র তো আছেই।
২০১৩ সালে পেশাদার টেনিস শুরু করার আগে জাপানি টেনিস ফেডারেশনে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন নাওমি। শুধু নাওমি নাম লেখান, তা নয়। তার বোন মারি ওসাকাও খেলছেন জাপানের হয়ে। নাওমি ও মারি আবার ডাবলসে জুটি বেঁধে খেলেন।
নাওমি যখন পেশাদার টেনিস শুরু করেন, ততদিনে সেরেনার ১২টি গ্র্যান্ড স্লাম জেতা হয়ে গেছে। এই দারুণ সাফল্যের কারণে আর শরীরের রংয়ের মিলের কারণে সেই ছোটবেলা থেকেই সেরেনার ভক্ত হিসেবে বেড়ে উঠেছেন নাওমি। শরীরের কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ অবশ্য নাওমিকে জাপানে মাঝে মাঝে একটু বিপদে ফেলে। জাপানিরা ‘জাপানি’ বলতে সাদা মানুষই চেনে। সেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গ জাপানিকে দেখে তারা একটু অবাক হয়।
নাওমি নিজে এক সাক্ষাতকারে বলছিলেন,
“আমি যখন জাপানে যাই, লোকেরা একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আমার নাম শুনে তারা আশা করতে পারে না যে, তারা কৃষ্ণাঙ্গ এক মেয়েকে দেখবে।”
কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে একসময় টেনিসেই বেশ বৈষম্য ছিলো। ১৯৫৬ সালে অ্যালথিয়া গিবসন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন; ফ্রেঞ্চ ওপেন। এরপর উইলিয়ামস বোনেরা এসে সংষ্কারটা ভেঙে দিয়েছেন। দুই বোন গন্ডা গন্ডা গ্র্যান্ড স্লাম জিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, শরীরের রং নয়, যোগ্যতাটাই এখানে বড় ব্যাপার।
এখন কৃষ্ণাঙ্গ যেসব নারী সর্বোচ্চ স্তরে টেনিস খেলছেন, তারা সবাই নাওমির মতো করে বলেন, সেরেনা ও ভেনাসকে দেখেই তারা টেনিসে এসেছেন। এই দুই বোনকে দেখেই সাহস পেয়েছেন সর্বোচ্চ স্তরে লড়াই করার।
এই বছরই সেরেনার সাথে টেনিস কোর্টে ওসাকার প্রথম সাক্ষাত হয়েছিলো। মিয়ামি ওপেনেও সরাসরি সেটে সেরেনাকে হারিয়েছিলেন নাওমি। কিন্তু গ্র্যান্ড স্লামের ব্যাপারটা তো একটু আলাদা। এখানে জয় পাওয়ার পর তাই আত্মহারা হয়ে গেছেন নাওমি।
তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় সেরেনাকে নিয়ে একটি স্কুল রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন নাওমি। শৈশবের তারকাকে নিজের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালেই হারানোর পরে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন জাপানি তারকা। তার ভাষায়,
“যখন আমি সেরেনাকে নেটের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরি তখন নিজেকে আবারো ছোট এক বাচ্চা বলে মনে হচ্ছিলো।”
প্রথম জাপানি খেলোয়াড় হিসেবে নাওমির গ্র্যান্ড স্লাম জয়ে উচ্ছ্বসিত জাপানিরাও। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাকে। তিনি বলেন,
“ইউএস ওপেন জয় করায় তোমাকে অভিনন্দন। প্রথম জাপানি খেলোয়াড় হিসেবে গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছ। গোটা জাপানকে শক্তি এবং অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
এবারের শিরোপা জিতেছেন নাওমি র্যাংকিংয়ের ২০ নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে এসে। তবে তাকে ‘আউটসাইডার’ ভাবার কোনো কারণ নেই। ক’দিন আগেই ইন্ডিয়ান ওয়েলস শিরোপা জেতার পথে নিজেকে চিনিয়ে এসেছেন। প্রথম রাউন্ডে মারিয়া শারাপোভা ও সেমিফাইনালে এক নম্বর তারকা সিমোনা হালেপকে হারিয়ে প্রথম অবাছাই তারকা হিসেবে ওই টুর্নামেন্ট জেতেন তিনি।
২০১৩ সালে ক্যারিয়ার শুরু করার পর ২০১৪ সালেই তিনি স্ট্যানফোর্ডে ওয়েস্ট ক্লাসিকে ২০১১ সালের ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন সামান্থা স্টসুরকে হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তখন সারা বিশ্বে লেখালেখি হয়েছিলো যে, টেনিস এক নতুন তারকা পেতে চলেছে।
২০১৫ সালে ডব্লুটিএ ফাইনালে খেলেন নাওমি। ‘রাইজিং স্টার ইনভাইটেশনাল’ টুর্নামেন্ট জেতেন তিনি ক্যারোলিন গার্সিয়াকে হারিয়ে। ওই বছরই তার গ্র্যান্ড স্লাম অভিষেক হয়। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের তৃতীয় রাউন্ডে উঠেছিলেন তিনি। ঐ বছর ফ্রেঞ্চ ওপেনেরও তৃতীয় রাউন্ডে পৌঁছান নাওমি। ২০১৬-১৭ মোটামুটি কাটানোর পর সেরা বছরটা কাটাতে শুরু করেন এই ২০১৮ সালে এসে। আর এখানেই বছরের শেষে এসে প্রথম গ্র্যান্ড স্লামের দেখা পেয়ে যান।
নাওমি হতাশ করে দিলেন নিজের আইডল সেরেনাকে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে কন্যা সন্তান অলিম্পিয়ার জন্মের পর প্রথম কোনো গ্রান্ড স্লাম শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে সেরেনা কোর্টে নেমেছিলেন; এটা ছিলো কোর্টে ফেরার পর সেরেনার দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল। কিন্তু মার্গারেট কোর্টের সর্বকালের সর্বোচ্চ ২৪টি স্লাম জয়ের রেকর্ড এবারও স্পর্শ করতে পারলেন না সেরেনা।
স্মরণীয় এই শিরোপা জয় করে নাওমি বলেন,
“ইউএস ওপেনের ফাইনালে সেরেনার বিপক্ষে খেলাটা সবসময়ই আমার স্বপ্ন ছিল। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, তার বিপক্ষে খেলতে পেরেছি।”
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী খেলোয়াড়দের একজন মনে করা হয় নাওমি ওসাকাকে। সেরেনার মতোই বড় ফোরহ্যান্ড ও আক্রমণাত্মক বেসলাইন খেলার জন্য খ্যাত তিনি। নাওমি বারবারই বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, তিনি সেরেনার মতোই হতে চেয়েছেন সারাটা জীবন।
গত বছর বিশ্বের সেরা তারকাদের একজন হয়ে ওঠার পথে নাওমি তার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটা গ্রহণ করেন। তিনি কোচ হিসেবে নিয়োগ দেন এখন মেয়েদের টেনিসে সবচেয়ে খ্যাতনামা কোচ শাশা বাজিনকে। শাশা বাজিন একজন ছিলেন সেরেনা উইলিয়ামসের অনুশীলন সঙ্গী। সেখান থেকে কাজ ছাড়ার পর সাবেক এক নম্বর ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা ও ক্যারোলিন ওজনিয়াকির কোচ ছিলেন তিনি। এরপর এখন দায়িত্ব নিয়েছেন নওমির। এই নিয়ে তৃতীয় চ্যাম্পিয়নের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আর এই ব্যাপারটা নাওমিকে সেরা হওয়ার পথে বেশ এগিয়ে দিয়েছে বলেই মনে করা হয়।