এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের ক্রিকেট একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
২০১৫-১৬ সালে যে উচ্চতায় বাংলাদেশ দল উঠেছিলো, সেখান থেকে আমরা বেশ খানিকটা নেমে এসেছি। এর মাঝে টুকটাক সাফল্য পেলেও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের দীনতা একেবারে কঙ্কাল হয়ে বেরিয়ে আসছে।
এরকম একটা সময় ছোটবড় বেশ কিছু আলোচনা হঠাৎ করে সামনে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এর মধ্যে খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সাকিব আল হাসান ও মুস্তাফিজুর রহমান বিষয়ক আলোচনা। বিসিবি সভাপতি বলেছেন, সাকিব-মুস্তাফিজ সহ অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারই টেস্ট খেলতে চাচ্ছেন না। এছাড়া মুস্তাফিজ সম্পর্কে বোর্ড সভাপতির আরেকটা মূল্যায়ন হলো, তিনি বাইরের ফ্রাঞ্চাইজি লিগগুলো খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ছেন। ফলে তাকে কিছুকাল বাইরে এসব লিগ খেলতে না দেওয়ার কথা ভাবছে বোর্ড।
স্বভাবতই এসব আলোচনা মানুষের মধ্যে একধরনের ঝড় তৈরি করেছে। আমরা একটু ধাপে ধাপে আলোচনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখি।
দেশের বাইরে টেস্টে ব্যর্থতা
দেশের বাইরে বাংলাদেশ সব ধরনের ক্রিকেটেই খারাপ করে। বাংলাদেশ ভালো সময়ে প্রবেশ করার পর উপমহাদেশের বাইরে এই নিয়ে তৃতীয় সফর করছে। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড সফরে লড়াই করলেও সবগুলো ম্যাচ হেরেছিলো বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে কোনো ম্যাচে ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বীতাও করতে পারেনি। আর এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে দুটি টেস্টেই যাচ্ছেতাইভাবে হেরেছে।
বোর্ড সভাপতি যথার্থই বলেছেন যে, বাইরে খেলার অভিজ্ঞতা কম থাকায় এই ধরনের ব্যাপার ঘটছে। সেই সাথে তিনি উল্লেখ করেছেন, ডিউক বলটা একটা ভূমিকা রেখেছে। আমাদের ক্রিকেটাররা মূলত কোকাবুরা বলে খেলে অভ্যস্থ। সেখানে হঠাৎ বেশি মুভমেন্টের ডিউক বল আরও বিপদে ফেলেছে ক্রিকেটারদের।
বোর্ড সভাপতির মূল্যায়ন এমন,
“আমাদের তো বাইরে খেলার অভিজ্ঞতা একেবারেই কম। যার কারনে ছেলেরা বাইরে ভালো করতে পারছে না। এই বছর থেকে আমাদের বাইরে অনেক ম্যাচ। হয়তো ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। তবে পারফর্মেন্স এত খারাপ হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে ব্যাটিংটা এতটা বাজে হওয়ার কথা নয়। তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, যে ধরনের উইকেটে খেলা হয়েছে এই ধরনের উইকেটে আমাদের খেলোয়াড়রা খেলে অভ্যস্ত নয়।
সব কন্ডিশনে ভালো হতে যে লেভেল প্রয়োজন, সেখানে আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি। অমন কন্ডিশনে খেলতে খেলতে অভিজ্ঞতা হবে। তাছাড়া ডিউক বলে খেলা হয়েছে। এই বলে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের কেউই অভ্যস্ত নয়, যার কারণে বলের মুভমেন্ট বুঝতে পারেনি।”
কোচ না থাকার ফল!
বাংলাদেশের নতুন কোচ স্টিভ রোডস মাত্র এই সিরিজেই যোগ দিয়েছেন দলের সাথে। এর আগে দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ কোনো স্থায়ী প্রধান কোচ ছাড়াই চলেছে। সেই দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে আর বাংলাদেশে ফেরেননি চান্দিকা হাথুরুসিংহে। ফলে এই লম্বা সময় কোচ ছাড়া খেলতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বোর্ড সভাপতি মনে করেন, কোচ না থাকার এই সময়টা দলের খারাপ পারফর্মেন্সের একটা কারণ।
তিনি বলছেন, এতে খেলোয়াড়রা অতিরিক্ত স্বাধীনতা পেয়েছে, যেটা হিতে বিপরীত হয়েছে।
এখানে অবশ্য তর্কের সুযোগ আছে। আমরা যতদূর জানি, খেলোয়াড়রা স্বাধীনতা চায়। তারা সেটা বোর্ডের কাছে বলেছেও বিভিন্ন সময়। কিন্তু তারা কোচ নিয়োগের বিরোধী তো কখনোই ছিলো না। কোচ পাওয়া যায়নি এতদিন, সেটা খেলোয়াড়দের কারণে নয়। বোর্ড কোচ জোগাড় করতে পারেনি। তাই এই দায় খেলোয়াড়দের দেওয়া কঠিন।
বোর্ড সভাপতি এ নিয়ে যা বললেন,
“ক্রিকেটাররা বেশ ফ্রি একটা পরিবেশের মধ্যে ছিল। হাথুরুসিংহে চলে গেছে। কোচ নেই, আমিও দূরে সরে আছি। আমি তো আগে ওদের সঙ্গেই থাকতাম। হাথুরুসিংহে চলে যাওয়ার সময় ওরা আমাকে বলেছিল ওরা একাই চালিয়ে নিতে পারবে। আমরা ওদের কাছে ছেড়ে দিয়েছিলাম। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হারলো। নিদাহাস ট্রফিতে মোটামুটি ভালো খেললো। এখন আবার খারাপ খেলছে। ওরা নিজেরাই এখন বুঝতে পারছে ওরা ভুল বলেছিল। ওরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, কোচ খুব প্রয়োজন।”
খেলোড়দের শৃঙ্খলা ও শাস্তি
এটা সত্যি যে বাংলাদেশ দলের কয়েকজন খেলোয়াড় গত বেশ কিছুদিন ধরে খুবই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করছেন। বিসিবিকে এজন্য বারবার তাদের শাস্তিও দিতে হয়েছে। আবারও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন নাসির হোসেন। বোর্ড সভাপতি বললেন, দলে না রেখেই নাসিরকে একধরনের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
তবে খেলোয়াড়দের আসলে বুঝতে হবে তারা জাতীয় দলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং হাজার হাজার তরুণের রোল মডেল। ফলে তাদের জীবনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
শাস্তি নিয়ে বোর্ড সভাপতি যা বলছিলেন,
“কাউকে শাস্তিও কম দেওয়া হচ্ছে না। সাব্বিরকে তো অনেক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সাকিবকে দিয়ে শুরু হয়েছিল। নাসিরকে তো আমরা এখনো রাখছিই না। সে না থাকাটা তো একপ্রকার শাস্তি। কোনো অভিযোগ আসলে আবার কঠিন শাস্তিই মুখেই পড়তে হবে।”
মুস্তাফিজের জন্য বাইরের লিগ নয়
মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে এই চিন্তাটা বিসিবি অনেক আগে থেকেই করছে। তাকে একবার ভর্তুকি দিয়েও বাইরের লিগ থেকে দূরে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু আজীবন তো ভর্তুকি দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা সত্যি যে, তিনি বাইরের লিগ খেলতে গেলেই ইনজুরিতে পড়ছেন। যার ভার বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বিসিবি সভাপতি বলছেন, মুস্তাফিজের বাইরের লিগ খেলা দুই বছরের জন্য বন্ধ করে দেবেন তারা,
“দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সে (মুস্তাফিজ) ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সময় চোট পায়। তারপর আর জাতীয় দলে খেলতে পারে না। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি এরই মধ্যে তাকে বলে দিয়েছি, পরের দুই বছর সে জাতীয় দলের বাইরে খেলতে পারবে না।”
বিশ্বকাপে প্রত্যাশা
মাঝের এই নড়বড়ে সময়টা বাদ দিলে ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে ভালো কিছু স্বপ্ন দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছিলো বাংলাদেশের। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলে আসার পর স্বপ্নটা আরও বড় হয়েছিলো। বোর্ড সভাপতি মনে করেন, বিশ্বকাপে ভালো করা সিনিয়রদের ওপর নির্ভর করছে,
“আশা তো সবাই করে। বিশ্বকাপ তো সব সময়ই কঠিন। কন্ডিশনও কঠিন। আমাদের সবকিছুই সাকিব-তামিম-রিয়াদ-মুশফিক এই চার খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করবে। ব্যাটিংয়ে নতুন কারো পক্ষে দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হবে। সিনিয়র খেলোয়াড়েরা বিশ্বকাপে ভালো খেলতে পারলে! ওদের ওখানে পারা উচিত। ওরা পারফর্মেন্স করতে পারলে ভালো হবে। তবে এবারের বিশ্বকাপ বেশ কঠিন হবে।”
বিশ্বকাপেই শেষ মাশরাফির!
মাশরাফির বয়স ৩৪ হয়ে গেছে। ফলে তিনি আর খুব বেশিদিন জাতীয় দলে থাকবেন না, এটা অনুমান করাই যায়। গত বছর তিনেক কোনো চোট ছাড়া যেভাবে খেলে যাচ্ছেন, সেটাই বরং এই চোট জর্জরিত ক্রিকেটারের জন্য বিস্ময়ের ব্যাপার।
বোর্ড সভাপতি জানা কথাটাই জানালেন,
‘খুব সম্ভবত বিশ্বকাপ খেলেই মাশরাফি তার আান্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করবেন। তবে ও যতদিন খেলতে চায় খেলবে। আমি জানি না ওর প্লান কী। ও কী করবে ওকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের তরফ থেকে বলতে চাই, মাশরাফি যতদিন ইচ্ছে খেলতে পারে, আমাদের কোনো বাধা নেই।”
ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা
বাংলাদেশ এখনও যে ক্রিকেটটা ভালো খেলছে, তার প্রধান কারণ সিনিয়র ক্রিকেটারদের পারফর্মেন্স। এখনও তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ বা মাশরাফির বিকল্প হিসেবে কেউ নিজেদের দাঁড় করাতে পারছেন না। তরুণদের এই উঠে না আসাটা নিয়ে একটা হতাশা তৈরি হয়েছে।
তবে বোর্ড সভাপতি বলছেন, তারা তরুণদের সুযোগ আরও বাড়াতে চান। এখন থেকেই বিকল্প তৈরির চেষ্টা চালাতে চান,
“ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমাদের নতুনদের সুযোগ দিতে হবে। তবে সবকিছু চিন্তা করে সুযোগ দিতে হবে। যেখানে অভিজ্ঞরাই যেখানে পারে না সেখানে তরুণদের জন্য কাজটা কঠিন। তবে তাদের সুযোগ দিতে হবে। শুরুতে হয়তো তারা ভালো করবে না। তারপরও তাদের সুযোগ দিয়ে তৈরি করতে হবে। বর্তমান দলে অনেকই আছেন ৫-৬ বছর পর দলে থাকবে না। তাদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য তরুণদের সুযোগ দিয়ে তৈরি করতে হবে।”
টেস্টে সাকিবদের অনীহা
সাকিব আল হাসান নিজেই এমসিসিতে বক্তৃতা করতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ফ্রাঞ্চাইজি লিগগুলোর কারণে ক্রিকেটাররা টেস্টে আগ্রহ হারাচ্ছে। এবার বোর্ড সভাপতি বললেন, সাকিব-মুস্তাফিজসহ অনেকেই টেস্ট খেলতে চান না।
সাকিব ও মুস্তাফিজের অবশ্য শারীরিক ক্লান্তি এখানে একটা ভূমিকা রাখছে। সারা বছর দেশে ও দেশের বাইরে এত ক্রিকেট খেলছেন যে, টেস্ট তাদের কাছে ক্লান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। বোর্ডকেই এর বিকল্প ভাবতে হবে।
বিসিবি সভাপতি বলেছেন,
“টেস্টের প্রতি আইসিসিরই আগ্রহ নেই। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কেউ আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু আমাদের দেশে এখন দেখছি আমাদের বেশ কিছু সিনিয়র ক্রিকেটার আছে যারা টেস্ট খেলতে চায় না। যেমন সাকিব টেস্ট খেলতে চায় না। মোস্তাফিজও টেস্ট খেলতে চায় না। তবে বলে না যে খেলবো না। কিন্তু এড়িয়ে যেতে চায়। হয়তো ইনজুরি প্রবণ বলেই চায় না।”