২৩ বছর… বেশ লম্বা একটা সময়। দীর্ঘ ২৩ বছর পর ওয়ানডে ক্রিকেট পেতে যাচ্ছে নতুন এক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ঐতিহাসিক লর্ডসে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে নিউ জিল্যান্ড ও স্বাগতিক ইংল্যান্ড। দুই দলই বিশ্বকাপজয়ের খুব কাছাকাছি এসে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। নিউ জিল্যান্ড তো রেকর্ডসংখ্যক ছয়বার সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছে! গতবার ঘরের মাঠে নিজেদের সেমিফাইনাল গেরো কাটালেও মেলবোর্নের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে আবারও খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে।
প্রতিপক্ষ নিউ জিল্যান্ডের ঝুলিতে যেখানে সবচেয়ে বেশি সেমিফাইনালে হারার রেকর্ড, সেখানে ইংলিশদের ঝুলিতে রয়েছে সবচেয়ে বেশিবার ফাইনালে হারার রেকর্ড। তিনবার শিরোপা জয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি এসেও ব্যর্থতার সাগরে ডুবতে হয়েছে তাদের। তবে এবার লর্ডসের ফাইনালে এই দুই দলের মধ্যে যেকোনো একটি দলের আক্ষেপ শেষ হতে যাচ্ছে, বহু প্রচেষ্টার পর অবশেষে একটি দল পৌছাতে যাচ্ছে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। এখন প্রশ্ন একটাই, কাদের আক্ষেপ ঘুচবে? আর কারা আবারও হতাশার চক্রে ঘুরপাক খাবে?
কাগজে-কলমের হিসাবে শক্তিমত্তার বিচার আর স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা নিয়ে নিউ জিল্যান্ডের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে থেকেই ফাইনালে নামবে ইংল্যান্ড। যদিও আসরের মাঝপথে ইংলিশদের অবস্থা এতটাই সঙ্গীন হয়ে গেছিল যে, তাদের শেষ চারে ওঠা নিয়েই বড় সংশয় দেখা গিয়েছিল। তবে ইনজুরি থেকে ফিরে ওপেনার জেসন রয় যেন পুরো দলের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন! রয়কে সাথে পেয়ে আরেক ওপেনার বেয়ারস্টোও যেন নিজেকে ফিরে পেয়েছেন, এই জুটির দাপুটে পারফরম্যান্সে ভর করে ভারত আর নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে ২৭ বছর পর ইংলিশরা পায় সেমিফাইনালের টিকিট। সেখানেও দুই ওপেনারের দাপট, অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে উড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিত করেছে ফাইনালে খেলাটা। এমন দাপুটে পারফরম্যান্স অব্যাহত থাকলে টানা তৃতীয়বার স্বাগতিক দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি।
অন্যদিকে, নিউ জিল্যান্ডের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত, প্রথম ছয় ম্যাচে অপরাজিত থেকে তখনই সেমিফাইনালের দিকে এক পা দিয়ে রেখেছিল তারা। এই অসাধারণ সেই শুরুর মূল কৃতিত্বটা ছিল ‘ব্ল্যাকক্যাপস’ বোলারদের। ব্যাট হাতে অধিনায়ক উইলিয়ামসন আর অভিজ্ঞ টেইলর ছাড়া কেউই তেমন অবদান রাখতে পারছিল না, আর এই ব্যর্থতাই তাদের জন্য কাল হয়ে আসে গ্রুপ পর্বের শেষ তিন ম্যাচে।
পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের কাছে বাজেভাবে হেরে আরেকটু হলেই নিশ্চিত সেমিফাইনালের টিকিট হাত থেকে ফসকে যাচ্ছিল তাদের, পাকিস্তানের সমান ১১ পয়েন্ট থাকলেও নিট রানরেটে এগিয়ে থাকায় শেষ পর্যন্ত পয়েন্ট টেবিলের চতুর্থ দল হয়ে সেমিফাইনালে আসে তারা। সেই সেমিফাইনালে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে এক প্রকার খড়কুটোর মতোই উড়ে যাবে নিউ জিল্যান্ড – এমন ভবিষ্যদ্বাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করেছে দলটি।
ইংল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ড, দুই দলের শক্তির জায়গাটাও ভিন্ন। ইংলিশদের শক্তির জায়গা তাদের ডায়নামিক ব্যাটিং লাইনআপ, রয়-বেয়ারস্টো জুটি তো বর্তমান বিশ্বেরই সেরা উদ্বোধনী জুটি। তিন নাম্বারে জো রুট অনন্য এক আস্থার প্রতীক, ইনিংস ধরে খেলার দায়িত্বটা তার কাঁধে থাকলেও স্ট্রাইকরেটটা ঠিকই বজায় রেখে চলেন। মরগ্যান, স্টোকস, বাটলার – তিনজনই নিজেদের দিনে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতে সক্ষম। অলরাউন্ডার হিসেবে ক্রিস ওকসও ভীষণ কার্যকরী, উড বাদে বাকি বোলারদের ব্যাট হাতে কার্যকরী ভূমিকাও ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
অন্যদিকে, নিউ জিল্যান্ডের এতদূর আসার মূল কারণ তাদের দুর্দান্ত বোলিং লাইনআপ, খুব সম্ভবত এই আসরেরই সবচেয়ে শক্তিশালী বোলিং লাইনআপগুলোর একটি তাদের। নতুন বলে ট্রেন্ট বোল্ট আর ম্যাট হেনরি ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর, সেটা সেমিফাইনালে ভারত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। মিডল ওভারে বল হাতে ঝড় তোলার জন্য দ্রুতগতির পেসার লকি ফার্গুসন তো আছেনই, সাথে দুই মিডিয়াম পেস অলরাউন্ডার কলিন ডি গ্রান্ডহোম আর জিমি নিশাম প্রায় প্রতি ম্যাচেই ফ্রন্টলাইনের তিন পেসারকে সহায়তা করে গেছেন। পেসারদের তৈরি করা চাপ দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনার, কার্যকরিতার বিচারে এই আসরের অন্যতম সেরা স্পিনার স্যান্টনার।
শুধু বোলিং দিয়ে নিউ জিল্যান্ড এতদূর এসেছে, এই কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। তাদের এই অভিযাত্রায় ফিল্ডিংটাও অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।
আবারও সেই সেমিফাইনালে ফিরে যাওয়া যাক, ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচে জিমি নিশামের দুর্দান্ত ক্যাচটাই কিন্তু ব্ল্যাকক্যাপসদের জয়ের পথটা সুগম করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। আর অবিশ্বাস্য এক থ্রোয়ের মাধ্যমে ধোনিকে যেভাবে রান আউট করেছেন গাপটিল সেটা হয়তো সমগ্র বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা মুহূর্ত।
তাই ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে আসরের সেরা ব্যাটিং লাইনআপের সাথে সেরা বোলিং লাইনআপের লড়াইটা যে দর্শকমহলে দারুণ উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে শুধু এক বিভাগ দিয়ে তো আর ম্যাচ জেতা যাবে না, অন্য বিভাগ থেকেও সহায়তা লাগবে। আর ঠিক সেটাই শক্তিমত্তার বিচারে ইংল্যান্ডকে এগিয়ে দিচ্ছে। ইংলিশদের বোলিং লাইনআপটাও ভীষণ শক্তিশালী, সেমিফাইনালে নতুন বলে ওকস আর আর্চার অজিদের ব্যাটিং লাইনআপকে কঠিন এক ধাক্কা দিয়েছেন। মিডল ওভারে দারুণ বল করছেন মার্ক উড, লিয়াম প্লাঙ্কেট ও বেন স্টোকস। আর প্রয়োজনীয় সময়ে উইকেট তুলে নেওয়ার জন্য লেগ স্পিনার আদিল রশিদ তো আছেনই। ইকোনমি রেট আর প্রতি উইকেটের জন্য রান খরচার হিসেবে নিউ জিল্যান্ডের ঠিক পরের অবস্থানটাই ইংলিশদের।
অন্যদিকে, নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ কিছুতেই রিদম খুঁজে পাচ্ছে না, গত আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক মার্টিন গাপটিল তো এই আসরে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। তার সঙ্গী হিসেবে কলিন মুনরো ব্যর্থ হওয়ার পর হেনরি নিকোলসকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনিও ব্যর্থ। পাঁচ নাম্বারে টম ল্যাথাম পুরো আসরে করেছেন মাত্র একটি ফিফটি, দুই অলরাউন্ডার নিশাম আর গ্রান্ডহোম এক ম্যাচ ভালো করলে অন্য ম্যাচে উধাও! তাই সব চাপ উইলিয়ামসন আর টেইলরের উপর এসেই পড়ছে। ওভারপ্রতি রানরেটের হিসাবে পুরো আসরে নিউ জিল্যান্ডের অবস্থান নবম! ইংলিশ বোলারদের সামনে যদি নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ নিজেদের সেরা ছন্দে ফিরতে আবারও ব্যর্থ হয়, তবে বরাবরের মতো আরেকটি একপেশে ফাইনাল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
সাফল্যের মূলমন্ত্র
ইংলিশদের মূল শক্তির জায়গা রয়-বেয়ারস্টোর উদ্বোধনী জুটি। তাই ফাইনাল জয়ের ক্ষেত্রে নিউ জিল্যান্ডের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত এই জুটিকে দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়া। অন্যদিকে, নিউ জিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা নতুন বলে বোল্ট-হেনরির অনবদ্য স্পেল। তাই যেভাবেই হোক, প্রথম দশ ওভারে ব্ল্যাকক্যাপসরা যাতে উইকেট না পায়, সেদিকে ইংলিশদের নজর রাখতে হবে।
প্লেয়ার্স টু ওয়াচ
অবশ্যই জেসন রয়ের দিকে আলাদা করে নজর রাখতেই হবে। ইংলিশ দলে যত ম্যাচ উইনারই থাকুক না কেন, রয়ের প্রভাব এই দলে অনেক বেশি। এই মারকুটে ওপেনারের অভাব শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে স্বাগতিকরা। তিনি যেভাবে সাবলীলভাবে ব্যাট চালান, তাতে বেয়ারস্টোর পক্ষেও উইকেটে থিতু হওয়াটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাই রয় টিকে গেলে ইংলিশদের প্রথম বিশ্বকাপজয়ের স্বপ্নের তরী যে এক লাফে অনেকদূর এগিয়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে, নিউজিল্যান্ডের মূল আশার কেন্দ্র তাদের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন, দলটির ফাইনালে আসার পিছনে তার অবদান অসামান্য। গ্রুপপর্বে প্রোটিয়া ও ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে বলতে গেলে একাই ম্যাচ বের করে এনেছিলেন তিনি। পুরো আসরে ৯১ গড়ে রান, সাথে অনবদ্য অধিনায়কত্বের কারণে টুর্নামেন্টসেরা হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে আছেন তিনি। মেলবোর্নের দুঃসহ সেই ফাইনালের স্বপ্ন ঘুচানোর জন্য উইলিয়ামসনের দিকেই তাকিয়ে থাকবে সমগ্র নিউ জিল্যান্ড।
কেমন হতে পারে একাদশ?
ইংলিশদের অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে নামার সম্ভাবনাই বেশি। তবে নিউ জিল্যান্ডের প্রথম আটজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে চারজনই বাঁহাতি, তাই অফ স্পিনার মঈন আলি দলে চলে আসাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু লর্ডসে যে উইকেটে ফাইনাল হবে, সেখানে ঘাসের পরিমাণ বেশি থাকায় সেই সম্ভাবনা আর নেই বললেই চলে।
সম্ভাব্য ইংল্যান্ড দল: জেসন রয়, জনি বেয়ারস্টো, জো রুট, ইয়োন মরগ্যান, বেন স্টোকস, জস বাটলার, ক্রিস ওকস, লিয়াম প্লাঙ্কেট, আদিল রসিদ, জোফ্রা আর্চার, মার্ক উড।
অন্যদিকে নিউ জিল্যান্ড দলে একটি পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, মুনরোর বদলে সুযোগ পেয়ে নিকোলস নিজেকে মেলে ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ। তাই ফাইনালে আবারও হয়তো একাদশে ফিরতে পারেন বাঁহাতি মারকুটে ওপেনার কলিন মুনরো।
সম্ভাব্য নিউজিল্যান্ড দল: মার্টিন গাপটিল, কলিন মুনরো, কেন উইলিয়ামসন, রস টেইলর, টম লাথাম, জিমি নিশাম, কলিন ডি গ্রান্ডহোম, মিচেল স্যান্টনার, ম্যাট হেনরি, লকি ফার্গুসন, ট্রেন্ট বোল্ট।
অবতরণিকা
শুরু করেছিলাম বিশ্বকাপে দুই দলের পূর্ববর্তী দুর্ভাগ্যের মিল টেনে, শেষটাও করছি দুই দলের মধ্যে আরেকটা অদ্ভুত মিলের কথা বলে। ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেওয়ার পর যখন ইংল্যান্ড দল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা ভাবছিল, তখন ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নিউ জিল্যান্ড থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই এক পুরোদস্তুর আক্রমণাত্মক দল সাজিয়েছিলেন ইংলিশ অধিনায়ক মরগ্যান। আর আজ ফাইনালে সেই নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখিই হতে যাচ্ছে ইংলিশরা।
নানা ব্যাপারে দুই দলের স্রোত যতই মিলিত হোক না কেন, ফাইনালে দুর্ভাগ্যবান দলের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে একটি দলই। এখন দেখা যাক, ফাইনালের পর্বতসম চাপ সামলে কারা বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলতে পারে।