প্রতি বছর এই দিনটায় (১৬ ডিসেম্বর) মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এসে হাজির হন সুরাইয়া খানম। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি, বিজয় দিবসের সকালেই শেরেবাংলায় হাজির তিনি। এবার তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন সালমা চৌধুরীও। দু’জনই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রিকেটার আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েলের বোন। সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসানের স্ত্রীসহ তারা বসেছিলেন ড্রেসিংরুমে।
মাঠে তখন বিজয় দিবসের প্রদর্শনী টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ব্যস্ত বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটাররা। শহীদ জুয়েল ও শহীদ সংগঠক মুশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে প্রতি বছরই এমন ম্যাচ আয়োজন করে থাকে বিসিবি, যেখানে খেলে থাকেন আকরাম-নান্নু-দুর্জয়-বিদ্যুৎ-অপিরা।
ড্রেসিংরুমে বসেই শহীদ জুয়েল সম্পর্কে কথা হয় সুরাইয়া খানমের সঙ্গে। কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে পড়ে তার চোখ, ধরে আসে কণ্ঠ। ছোট ভাইয়ের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিষাদময় স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান সুরাইয়া খানম।
প্রতি বছর এমন একটা প্রদর্শনী ম্যাচ আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনটা আপনাদের কাছে কেমন লাগে? এই দিনে কোন স্মৃতিগুলো বেশি মনে পড়ে?
তারা এই দিনটাকে (বিসিবি) মনে রেখেছে, সারা বছর আর কোনো অনুষ্ঠান হয় না। খেলোয়াড় হিসেবে সে (জুয়েল) যুদ্ধ করেছে, এটা যে প্রতি বছর মনে করে, এই জন্য আমরা ক্রিকেট বোর্ডের কাছে সন্তুষ্ট। ভালো লাগে, মনে হয় আমার ভাইরা হারিয়ে যায়নি। খেলার মাধ্যমে বছরে একবার স্মরণ করে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট তো এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বেশ প্রতিষ্ঠিত। আপনাদের পরিবার বা আপনি এখন বাংলাদেশের খেলা দেখেন?
প্রতি বছর তো এখানে আসি। এছাড়া দেখা হয়। এখানের চেয়ে টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখতে ভালো লাগে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে আসা হয়নি, টিকিট পাওয়া যায় না। বিসিবিকে বললে তখন হয়তো দেয়। দুই-একবার দিয়েছিল। আমার মতে, টিভিতে দেখলেই ভালো দেখা যায়। দূর থেকে চেনাও যায় না, বোঝাও যায় না। টিভিতে ভালো বোঝা যায়।
আপনি তো ওনার বড় বোন। আপনার সাথে নিশ্চয়ই উনার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি আছে। শহীদ জুয়েলের সম্পর্কে শুনতে চাই…
আমরা পিঠেপিঠি ভাই-বোন। আমার পরই ওর (শহীদ জুয়েল) জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই জুয়েল ক্রিকেট খেলত (ব্যাট-বল), এটাই ওর প্রাণ ছিল মনে হয়। আগের দিনে হরতাল হলে বাইরে যেতে পারত না, তখন বাসার সামনে (টিকাটুলি, যেখানে আমাদের বাসা ছিল) ব্যাটিং করতো, আমাকে বলতো বোলিং করতে। একবারে ভালো তো পারতাম না। ও খেলত, খেলাটাই ওর কাছে সবকিছু ছিল। তারপর মোহামেডানে, আজাদ স্পোর্টিংয়ে খেলত। আমরা দেখেছি, জুয়েলের মুখ্য বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল খেলা। পড়ালেখার চেয়ে খেলার প্রতি ঝোঁক বেশি ছিল।
যুদ্ধের সময়টার স্মৃতি কেমন ছিল?
যুদ্ধের সময় তো ভারত চলে গেল, ট্র্রেনিং নিল। এরপর ফিরে এসে ঢাকায় অনেকগুলো অপারেশন করে। প্রথম যখন ও ঢাকায় ফিরে বাড়িতে আসে, আমরা ওকে কেউ চিনতে পারিনি। লুঙ্গি পড়া, দাড়ি হয়ে গেছে। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ (অস্ত্রসহ)। ও বেশি বাসায় থাকত না, হয়তো মানা ছিল। মাঝে মাঝে আসত, অপারেশন করত, আবার ভারত চলে যেত, আবার আসত – এভাবে গেছে। ফার্মগেটে যে অপারেশনটা হয়, সেটায় জুয়েল ছিল। সেই অপারেশনে ১৮ জনের মতো (পাকিস্তানি আর্মি) মারা যায়। এরপর সে যখন বাসায় আসে, কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার মানুষ মারল তো।
সে সময় আমরা বোনরা বাসায় ছিলাম। ও ভেবেছে যে, আর্মিদের মেরেছি, বাসায় রেইড পড়বে। আমাদের বাসাটা একটু ভিতরে ছিল কিন্তু ওরা তো বের করবেই। খালি বলছিল, আমাদের (বোনদের) দেশে পাঠিয়ে দেও, দেশে পাঠিয়ে দেও। আমরা গ্রামে (বিক্রমপুর) চলেও গেছিলাম (বোনরা)।
এই প্রথম ওকে একটু অন্যরকম দেখেছিলাম। এরপর ও যে খাটে ঘুমাত, সেখানে দেখি একটু উঁচু উঁচু। কোণা উঠায়ে দেখি, অস্ত্র। আরেকবার সে অনেকগুলো অস্ত্র নিয়ে আসে। আমাদের বাসায় অনেকগুলো ঘর ছিল, মাঝে যে ঘরটা ছিল সেখানে আমার বাবা-মা সারারাত পাহারা দিয়েছে (অস্ত্রগুলোকে)। পরে এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। ও যেমন সাহসী ছিল, তেমন সৌখিনও ছিল। সবসময় সুন্দরভাবে, পরিপাটি হয়ে থাকতো। লেখাপড়া করত, জগন্নাথ থেকে বিএসসি পাশ করেছিল। পাশ করার পর ও চাকরি করেছিল কিছুদিন। সাত্তার গ্যাস ফ্যাক্টরি থেকে ওকে স্কলারশিপ দেয়া হয়েছিল। গ্যাস টেকনোলজি করার জন্য জুয়েলকে বিদেশে পাঠাবে। সেটারই প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু তখনই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পরে আর যেতে পারেনি। চট্টগ্রামে আরেকটা চাকরি করেছিল (নাম মনে নেই)। কিন্তু ও সবসময় খেলাধুলা নিয়েই থাকত।
উনি কখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে ভারত যাবেন? ওই মাসের কথা কি মনে আছে আপনার?
২৫শে মার্চ কালরাত্রির সময় মুশতাককে যখন মেরে ফেলা হয়, এরপরই সে সিদ্ধান্ত নেয়, যুদ্ধে নামবে, ভারত যাবে। আমাদের পাড়ায় জুয়েলের যে বন্ধু-বান্ধব (ফতেহ আলিসহ অনেকেই) ছিল, ওরা সবাই আমাদের বাসায় এসে একটা ছিল সিঁড়ির মতো জায়গা ছিল, সেখানে আলোচনা করত। আমরা বুঝতাম যে, মিটিং করছে বা কবে যাবে। এর মধ্যে দুই-একবার যাওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু যেতে পারেনি। শেষের দিকে গেছে, মে মাসের দিকে।
ভারত থেকে ফিরে এসেছিলেন কবে?
আমার নির্দিষ্ট তারিখ তো মনে নেই। কিন্তু সেখানে যাওয়ার ১-২ মাস পরই সে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে আসে।
ওনাদের কোনো অপারেশন সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলেছিলেন কখনো?
না, জুয়েল আমাদের এই ব্যাপারে কোনোদিন কিছু বলত না। কোনো আলোচনা করত না। যা আলোচনা হতো, সব আজাদদের বাসায় হতো, ওদের যে দলটা ছিল সেখানে। আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাদের বাসায় ওরা বৈঠক করত। কিন্তু অপারেশন সম্পর্কে কখনো বাসায় কিছু বলত না। কারণ, একটা ভয় ছিল। আমরাও আশেপাশের অ্যাকশনে বুঝতাম যে, কিছু করতে যাচ্ছে।
যুদ্ধের সময় এমন কোনো স্মৃতি আছে কি? যেখানে হয়তো বা আপনি ওনাকে সাহায্য করেছেন, এমন?
না, তখন আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমি সিলেটে চলে গেছিলাম। আমার ছোট বোনটাও (পাশে বসা সালমা চৌধুরী) অনেক ছোট। ওর এত কিছু মনে নেই। আমার যে আর দুই বোন আছে, ওরা বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল বাসায়।
ক্রিকেট নিয়ে ওনার স্বপ্নটা কেমন ছিল?
ওর সব সময় ইচ্ছে ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ার। মাঝে মাঝে সে করাচিতে গিয়েও খেলেছে। ওর ইচ্ছে ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ার, কিন্তু তখন বাংলাদেশিদের এত সুযোগ দিত না। সে সময় পাকিস্তানিরাই খেলত। ওর অনেক আশা ছিল। ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিল; ভালো খেলত, অনেক ভালো খেলত। করাচিতে যখন খেলেছে, সেখানেও অনেক ভালো খেলেছে। সে সময় করাচির উর্দু পেপারগুলো আমদের বাসায় ছিল, ওখানে ওকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। জুয়েলের অনেক আশা ছিল। যখন ওর হাতে গ্রেনেড ফেটে যায় (আশুগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন চলাকালীন), তখন ও আলমদের বাসায় ছিল। সেখানে ডাক্তার দেখত ওকে। সেখানে চিকিৎসা হয়েছে ওর। সে তখন ডাক্তারকে বলত, আমার হাতটা যে এমন হয়ে গেল, আমি কি আর জীবনে খেলতে পারব না? এই হাতটা দিয়ে খেলতে পারব কি না?
ওনাকে ধরে নিয়ে যায় কোন মাসে?
জুয়েল, আলমদের বাসা ছিল ইস্কাটনে। ওখান থেকে বের হয়েছে এটা বলে যে অনেকদিন আম্মার সঙ্গে দেখা হয় না, একটু দেখা করে আসি। এটা বলে সে আবার আজাদদের বাসায় গেছে (মগবাজার)। ওখানে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধারা ছিল। ওইখানে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়, তখন আজাদের মা ওদের ওখানে থেকে যেতে বলে। ওইদিন ওরা সেখানে ফ্লোরিং করে থেকে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে। তখন রাজাকাররা খবর পেয়ে রেইড দিয়ে ওদের ধরে নিয়ে যায়। এটা আগস্ট মাসে ছিল।
এই খবরটা আপনারা কীভাবে পেয়েছিলেন?
জুয়েলকে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাতে রাখা হতো, সকাল ১০টার দিকে এসে নিয়ে যাওয়া হতো। এমপি হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে ওদের নির্যাতন করা হতো কথা বের করার জন্য। একদিন ভোরের দিকে ক্যাপ্টেন রোকসানার (প্লেন চালাতেন যিনি) বাবা রমনা থানায় গিয়ে ওকে দেখতে পায়। তখন সে বলে, আমার বাবাকে একটু খবর দিয়েন, আমাকে ধরে নিয়ে আসছে। সেখান থেকে এসেই উনি আমার বাবাকে খবর দেন যে, ওকে ধরে নিয়ে গেছে। আব্বা অনেক চেষ্টা করেছেন ওকে ছাড়ানোর জন্য, অনেক জায়গায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছে, কিন্তু পারেনি।
ওকে রোজ নিয়ে যাওয়া হতো রমনায়। তখন আবার আমি দেশে ছিলাম, কিন্তু থাকতে পারছিলাম না। খুব অস্থির লাগছিল আমার। যেহেতু পিঠেপিঠি ভাই-বোন ছিলাম, একটা টেলিপ্যাথিও কাজ করে। অস্থির হয়ে যাচ্ছি আমি। আমার তখন বিয়ে হয়েছে, একটা বাচ্চা আছে। গ্রাম থেকে লঞ্চে করে ঢাকা আসা যায়। আমার এক মামা আছে আমি তাকে বললাম যে, আমাকে লঞ্চে উঠায় দিতে, বা ঢাকায় দিয়ে আসতে। তখন সে আমাকে বলে যে, এই গণ্ডগোলের মধ্যে ঢাকা যাওয়া যাবে না। তখন আমি বলি, আমাদের লঞ্চে উঠায় দিতে। এরপর আমরা ঢাকা আসি। বাসায় এসে দেখি, মা-বাবা কান্নাকাটি করছেন। বাবা কাঁদতেও পারছেন না ভালোভাবে। কারণ ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে, কাঁদলে আশেপাশে মানুষ আছে, জোরে যে কাঁদবে তাও পারছিল না। ছেলেরে ধরে নিয়ে গেছে, এটাও তো জানাতে পারছে না। আব্বা প্রতিদিন সকালবেলা উঠে রমনা থানায় যেতেন। গিয়ে সেখানে বাঙালি পুলিশদের সাহায্যে জুয়েলের সঙ্গে দেখা করতেন। ওর বাঁচার অনেক ইচ্ছা ছিল। আব্বাকে বলেছিল যে, চেষ্টা করেন আমাকে বাঁচাইতে পারেন কি না। আব্বা চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি।
আপনি ঢাকায় আসলেন কোন মাসে? আপনার বাবার সঙ্গে শহীদ জুয়েলের শেষ দেখা কবে হয়েছিল?
আমি সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে ঢাকায় আসি, আব্বা তখন জুয়েলের সঙ্গে দুইবার দেখা করেছে। কিন্তু সেদিন বাবার সঙ্গে গিয়ে আমরা ওকে পাইনি। পুলিশরা বলেন যে, জুয়েলকে নিয়ে গেছে, আর আনেনি। হয়তো ওইদিনই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা তো নির্দিষ্ট তারিখটা জানি না, আশায় ছিলাম যে, ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানে। দেশ ভাগাভাগি হওয়ার পর সারা ক্যান্টনমেন্ট খুঁজেও ওর লাশ পাওয়া যায়নি। তাও আমরা আশা করছিলাম, ও আসবে। অনেকের কাছে শুনেছি, জাহাজে করে অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে গেছে। আশা করছিলাম, কোনোদিন হয়তো আসতে পারবে বা আসবে। অনেক বছর আমরা আশায় ছিলাম যে, জুয়েল আসবে, উপস্থিত হবে। ও আমাদের পরিবারের ভরসা ছিল। উঠতি বয়স ওর তখন। বাবা-মা ভেবেছিল, ও চাকরি করবে। সংসারের হাল ধরবে। কারণ, বোনরা সব ছোট। জুয়েলের শোকে বাবার প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছিল। অনেক দিন বিছানায় থেকে মারা যান তিনি। আম্মা কান্নাকাটি করে শোকটা কমিয়েছিলেন, কিন্তু আব্বা পারেননি। আমার মা এরপর অনেক কষ্ট করেছেন, বোনদের পড়ালেখা শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আমাদের একটা বাড়ি ছিল ওই বাড়ির ভাড়া দিয়ে চলতো সব।
বাংলাদেশের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/