ভারতের ঐতিহ্যবাহী রনজি ট্রফির ৮৪ তম আসরে দিল্লীকে নয় উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো রনজি ট্রফির শিরোপা জিতেছে বিদর্ভ। বিদর্ভ ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে রনজি ট্রফিতে নিজেদের প্রথম টুর্নামেন্ট খেলেন। ৬১ তম আসরে এসে প্রথমবারের মতো শিরোপার স্বাদ পায় বিদর্ভ। রনজি ট্রফির ৮৪ তম আসরে নতুন চ্যাম্পিয়ন দেখার পাশাপাশি বেশ কিছু উদীয়মান তারকার মুখও দেখা গিয়েছে। রনজি ট্রফির উদীয়মান তারকাদের নিয়েই আজকের লেখা।
১. রজনীশ গুরবানি
রজনীশ গুরবানি রনজি ট্রফির ২০১৭-১৮ মৌসুমে ছয় ম্যাচে ১৭.১২ বোলিং গড়ে ৩৯ উইকেট শিকার করেছেন। আসরের সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারীদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন তিনি। বিদর্ভর শিরোপা জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের দ্বিতীয় মৌসুম খেলতে নামা ২৪ বছর বয়সী এই ডানহাতি পেসার। রনজি ট্রফির ফাইনালে দিল্লীর বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে হ্যাটট্রিক সহ ছয় উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে দুই উইকেট শিকার করেন গুরবানি।
গুরবানি বিশেষ করে নক আউট পর্বে দুর্দান্ত বোলিং করেন। সেমি ফাইনালে কর্ণাটকের বিপক্ষে মোট ১২ উইকেট এবং কোয়ার্টার ফাইনালে কেরালার বিপক্ষে সাত উইকেট শিকার করেন তিনি। গ্রুপ পর্বে হিমাচল প্রদেশের বিপক্ষেও দুর্দান্ত বোলিং করে প্রথম ইনিংসে ছয় উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে দুই উইকেট শিকার করেন।
২. পৃথ্বী শাও
পৃথ্বী শাও বর্তমানে অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ভারত অনুর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক তিনি। ইতোমধ্যেই আলোচনায় চলে এসেছেন তিনি। প্রায় প্রতি বছরই দুর্দান্ত সব ব্যাটসম্যানের দেখা পায় ভারত। দুর্দান্ত পারফরমেন্স করে পৃথ্বী শাও তার নাম এই তালিকায় লিখিয়েছেন। ২০১৭ সালের পহেলা জানুয়ারি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে পৃথ্বীর। সবেমাত্র আঠারোতে পা দেওয়া পৃথ্বী নিজের অভিষেক ম্যাচেই তামিলনাড়ুর বিপক্ষে ১২০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন। যার সুবাদে ম্যাচ বাঁচিয়ে ফাইনালে উঠে তার দল মুম্বাই। ফাইনালে তার দল গুজরাটের কাছে পরাজিত হলেও পৃথ্বী ৭১ এবং ৪৪ রানের ইনিংস খেলেন।
পৃথ্বী শাও ২০১৭-১৮ ক্রিকেট মৌসুমও শুরু করেন দুর্দান্তভাবে। দিলীপ ট্রফিতে ইন্ডিয়া রেডের হয়ে ১৫৪ রানের ইনিংস খেলেন। তার ইনিংসের উপর ভর করে তার দল ১৬৩ রানে জয় পেয়েছে। ভারতের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলের অধিনায়ক পৃথবী ২০১৭-১৮ মৌসুমের রনজি ট্রফির প্রথম ম্যাচে তামিলনাড়ুর বিপক্ষে ১২৩ রান এবং পরের ম্যাচে ওড়িশার বিপক্ষে ১০৫ রানের ইনিংস খেলেন। তিনি রনজি ট্রফিতে ছয় ম্যাচে তিনটি শতক এবং দুটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪৮.২১ ব্যাটিং গড়ে ৫৩৭ রান করেছেন।
৩. আনমলপ্রিত সিং
পাঞ্জাবের ১৯ বছর বয়সী মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান আনমলপ্রিত সিং নিজের প্রথম রনজি ট্রফিতে চতুর্থ সর্বাধিক রান সংগ্রাহক হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষ করেন। হিমাচল প্রদেশের বিপক্ষে রনজি ট্রফিতে নিজের অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৫০ রান করেন। আনমলপ্রিত সিং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এবং রনজি ট্রফিতে নিজের প্রথম শতক হাঁকান গোয়ার বিপক্ষে। গোয়ার বিপক্ষে তিনি ১১৩ রানের ইনিংস খেলেন। পরের ম্যাচে ছত্তিসগড়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ২৬৭ রানের ইনিংস খেলেন। তিনি রনজি ট্রফিতে প্রথম তিন ম্যাচে যথাক্রমে ৫০, ১১৩ এবং ২৬৭ রান করেন।
রনজি ট্রফিতে পাঞ্জাবের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে সার্ভিসের বিপক্ষে ২৫২* রানের আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন আনমলপ্রিত সিং। পাঞ্জাব গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ যাওয়ার দরুন আনমলপ্রিতের প্রথম মৌসুম শেষ হয় দুর্দান্ত এক দ্বিশতকের মধ্য দিয়েই। তিনি পাঁচ ম্যাচের সাত ইনিংস ব্যাট করে তিনটি শতক এবং একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১২৫.৫০ ব্যাটিং গড়ে ৭৫৩ রান করেন।
৪. অক্ষয় ওয়াদকার
চ্যাম্পিয়ন দল বিদর্ভের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান অক্ষয় ওয়াদকার নিজের প্রথম মৌসুমে কয়েকটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন। গ্রুপ পর্বে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেছিলেন ২৩ বছর বয়সী অক্ষয় ওয়াদকার। প্রথম দুই ম্যাচে মাত্র এক ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। রনজি ট্রফি এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেন গোয়ার বিপক্ষে। অভিষেক ম্যাচে ওয়াদকার ব্যাট করার সুযোগ পাননি। রনজি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালে কেরালার বিপক্ষে দলের বিপর্যয়ের মুখে ১৪৭ বলে সাতটি চারের মারে ৫৩ রানের ইনিংস খেলেন অক্ষয় ওয়াদকার। একপর্যায়ে ৯৫ রানে ছয় উইকেট থেকে প্রথম ইনিংসে ২৪৬ রান সংগ্রহ করে বিদর্ভ। দ্বিতীয় ইনিংসেও অপরাজিত ৬৭* রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
অক্ষয় ওয়াদকার নিজের সেরাটা তুলে রেখেছিলেন রনজি ট্রফির ফাইনালের জন্য। প্রথম ইনিংসে দিল্লীর করা ২৯৫ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২৪৬ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে বসে বিদর্ভ। সেখান থেকে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সাথে জুটি বেঁধে প্রথম ইনিংসে বিদর্ভকে ৫৪৭ রানের পুঁজি এনে দেন ওয়াদকার। তিনি ৪২৫ মিনিট ক্রিজে থেকে ২৬২ বলে ১৬টি চার এবং একটি ছয়ের মারে ১৩৩ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন। রনজি ট্রফিতে নিজের প্রথম মৌসুমে পাঁচ ম্যাচে ৬১.৬০ ব্যাটিং গড়ে একটি শতক এবং দুটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩০৮ রান করেন অক্ষয় ওয়াদকার। উইকেটের পেছনেও তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত। ২০টি ক্যাচ লুফে নেওয়ার পাশাপাশি একটি স্ট্যাম্পিং করেছেন তিনি।
৫. চিন্তন গাজা
গুজরাটের ২৩ বছর বয়সী চিন্তন গাজা রনজি ট্রফিতে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে অসাধারণ বোলিং করেছেন। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার চিন্তন রনজি ট্রফির ২০১৭-১৮ মৌসুমে সাত ম্যাচে ১৯.৪৬ বোলিং গড়ে ২৬ উইকেট শিকার করেছেন। গুজরাট তাদের ম্যাচগুলো স্পিন সহায়ক পিচে খেলেছেন, যেখানে পেসারদের বাড়তি কোনো সুবিধা ছিলো না। চিন্তন পিচ থেকে সুবিধা না পেলেও ম্যাচের শুরুতেই উইকেট শিকার করতেন। এতে করে স্পিনারদের কাজটা সহজ হয়ে যেতো। রনজি ট্রফির ৮৪তম আসরে এক ইনিংসে সেরা বোলিং ফিগার চিন্তনের। রাজস্থানের বিপক্ষে তিনি ৪০ রানের বিনিময়ে আট উইকেট শিকার করেছেন।
৬. সিদ্ধার্থ দেশাই
অভিজ্ঞ স্পিনার পিযুষ চাওলার সাথে জুটি বেঁধে রনজি ট্রফিতে নিজের প্রথম আসরে পাঁচ ম্যাচে ২৯ উইকেট শিকার করেছেন ১৭ বছর বয়সী গুজরাটের বাঁহাতি স্পিনার সিদ্ধার্থ। আসরে গুজরাটের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলারদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন এই তরুণ স্পিনার। ইনিংসে তিনবার পাঁচ উইকেট সহ ৩০.৫১ বোলিং গড়ে ২৯ উইকেট শিকার করেছেন। গুজরাটের হয়ে তার চেয়ে বেশি উইকেট করেছেন শুধুমাত্র পিযুষ চাওলা। তিনি ছয় ম্যাচে ৩২ উইকেট শিকার করেছেন।
৭. অভিষেক রমন
অভিষেক রমন রনজি ট্রফিতে নিজের দ্বিতীয় মৌসুম খেলেন এবার। বেঙ্গলের এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ব্যাট হাতে অসাধারণ সময় কাটায় রনজি ট্রফিতে। ২৪ বছর বয়সী অভিষেক রনজি ট্রফির এই আসরে বেঙ্গলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। অভিষেক রমন হিমাচল প্রদেশের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ১৭৬ রানের ইনিংস খেলেন গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে। টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই উইকেট হারিয়ে বসে বেঙ্গল। এরপর দলের হাল ধরেন অভিষেক রামান এবং অধিনায়ক মনোজ তেওয়ারি। অভিষেক ১৭৬ রান করে ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতেন।
পাঞ্জাবের বিপক্ষে তার ১৫৫ রানের ইনিংসে উপর ভর করে ইনিংস ব্যবধানে জয় পায় বেঙ্গল। অভিষেক রমন রনজি ট্রফির সদ্য সমাপ্ত আসরে আট ম্যাচে ৪৪.৫০ ব্যাটিং গড়ে দুটি শতক এবং একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬২৩ রান করেন। রনজি ট্রফির ৮৪ তম আসরে বেশ কিছু উদীয়মান ক্রিকেটার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। এই তালিকায় বেঙ্গলের পেসার ইশান পোরেল এবং কেরালার দুই বাঁহাতি স্পিনার কেচি অক্ষয় ও সিজোমন জোসেফের নামও থাকবে।
ফিচার ইমেজ – Sportswallah