ধৈর্য্য, ধৈর্য্য, ধৈর্য্য।
টেস্ট ক্রিকেটে সফলতার মন্ত্র হিসেবে এই একটি শব্দকেই সর্বাগ্রে উল্লেখ করে থাকেন বিশেষজ্ঞ, ক্রিকেটার, কোচ থেকে শুরু করে সবাই। প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে যেটি টেস্ট ক্রিকেটে বহুল ‘চর্বিত চর্বন’।
টেস্ট মানে ধৈর্য্যের খেলা, কথাটির অনুসরণকারী বাংলাদেশ দলও। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অবশ্য ধৈর্য্য কথাটার চেয়ে ‘সহজাত ব্যাটিং’য়ের ধারক বেশি। বলা বাহুল্য, এই সহজাত ব্যাটিংয়ে আক্রমণই যেন শেষ কথা। কি টপ অর্ডার, কি মিডল অর্ডার, কি লোয়ার অর্ডার, সবাই যেন স্ট্রোকপ্লেয়ার!
উইকেট, কন্ডিশন, দলের অবস্থা বা ম্যাচের পরিস্থিতি যা-ই হোক, উইকেটের চারপাশে শটের পসরা সাজাতে ব্যস্ত সবাই। সমস্বরে সুর তুলে টেস্টের মেজাজবিরোধী ব্যাটিংকেও দলের মাঝে প্রায় ‘বৈধতা’ এনে দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, এই পদ্ধতিতে সফলতাও এসেছে কম বেশি। কিন্তু টেস্টের প্রসিদ্ধ দেয়ালরূপী চরিত্র সেখানে নির্বাসিত!
ওপেনিংয়ে তামিম ইকবালের যোগ্য সঙ্গীর খোঁজে গত এক দশক কাটিয়েছে বাংলাদেশ। শেষ কয়েক বছরে ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার, লিটন দাসদের অবলম্বন করে সেই মিশনে এগিয়েছিলেন নির্বাচকরা। চূড়ান্ত সমাধান আসেনি তিন বাঁহাতির মাধ্যমে। তামিমের চোটের সুযোগে ওপেনিংয়ের দুর্দশা কাটাতে আরেক বাঁহাতির দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। তিনি সাদমান ইসলাম অনিক। মিরপুর স্টেডিয়ামে শুক্রবার এই তরুণের ব্যাটেই মিললো স্বস্তির পরশ।
অভিষেকেই টেস্ট ব্যাটসম্যানের ছায়া দেখা গেছে তার মাঝে। রান করেছেন ৭৬, সেখানেই ছিল অনেক কিছুর বার্তা। ব্যাট হাতে দৃপ্ত পদচারণায় এঁকে গেছেন এই ফরম্যাটে দেশের ভবিষ্যতের অবলম্বন হওয়ার ছবিটা। গোটা ইনিংসে চার মেরেছেন ছয়টি। যদিও হাল জমানায় স্ট্রোকমেকারদেরই প্রতিভাবানের ট্যাগ দেয়া হয়, সাদমান বাউন্ডারিতে উদ্ভাসিত হওয়ার সেই পথে হাঁটেননি; বরং উইকেটে টিকে থাকার সামর্থ্যের প্রদর্শনী করেছেন।
টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে অভিষেকে বাংলাদেশের ওপেনারদের মধ্যে সাদমানের স্কোরটাই সর্বোচ্চ। শুধু রান নয়, চা বিরতির আগে আউট হওয়া এই বাঁহাতি ওপেনার খেলেছেন ১৯৯ বল; সেটিও রেকর্ড বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে। অভিষেক ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে এর আগে এত বেশি বল খেলেননি কোনো ওপেনার। উইকেটে টিকে ছিলেন ২২০ মিনিট, এই স্থায়ীত্বই আসলে সবচেয়ে তৃপ্তি-স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে।
শেরেবাংলার সবুজ জমিনে সাদমানের শুরুটা স্কয়ার লেগে বল পাঠিয়ে। দ্বিতীয় বলটা ঠেকিয়েছেন। রোচের করা তৃতীয় বলে সোজা ব্যাটে অসাধারণ টাইমিংয়ে লং অফ দিয়ে চার মেরে রানের খাতা খুলেছিলেন। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, ব্যাটসম্যান হিসেবে এই তরুণ নিজের স্বরূপটা তুলে ধরেছেন।
মাথা নিচু করে ব্যাটিং করে গেছেন। সাদমান বল ছেড়েছেন, সাবলীল ডিফেন্স দিয়ে বল আটকেছেন। সোজা ব্যাটে খেলেছেন বেশ কয়েকটি শট। তাতেই ব্যাটিংয়ে তার ক্লাসের রূপটা স্পষ্ট ছিল। শট খেলার সময় শরীর, মাথার ভারসাম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। পায়ের কাজও ভালো ছিল, পা নিয়েই বল খেলেছেন। বাইরের বল তাড়া করেছেন কম। চোখের সামনে আট টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক মুমিনুল বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন, তবে উচ্চাভিলাষী শট খেলার প্রতি প্রলুব্ধ হননি সাদমান।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে অবশ্য শটস খেলা ব্যাটসম্যান হিসেবেই সুনাম ছিল তার। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (৪০৬ রান) ছিলেন তিনি। তবে টেস্ট ক্রিকেটের তপ্ত জমিনে প্রথম দিনে ব্যাটিংয়ে যে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সাদমান, সেটি ধরে রাখতে পারলে নিশ্চিতভাবেই তিনি ওপেনিংয়ে অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের বয়ে চলা হাপিত্যেশ দূর করতে পারবেন।
বাউন্স-মুভমেন্ট তথা গতিময় উইকেটে, র্যাঙ্ক টার্নার, অসমান বাউন্সের উইকেটের পরীক্ষা অচিরেই দিতে হবে সাদমানকে। বড় বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিতে হবে, স্পিনের বিপক্ষে ডিফেন্সে আরও পোক্ত হতে হবে। সময়ের সঙ্গে তিনি আরও পরিণত হবেন, এমনটা আশা করাই যায়। উইকেটে স্থিতধী মানসিকতা ধরে রাখতে পারলে ব্যাটসম্যান সাদমান সঠিক কক্ষপথেই থাকবেন।
সর্বশেষ জাতীয় ক্রিকেট লিগে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন সাদমান। বাঁহাতি এই ওপেনার হাই পারফরম্যান্স, ‘এ’ দলের হয়েও খেলেছেন। অভিষেকের দিনে তিনি জানিয়েছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা ৪২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই শুক্রবার মিরপুরে খেলে গেছেন। দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাঁহাতি এই ওপেনার বলেছেন,
‘আমি যেরকম ব্যাটিং করি আমি চিন্তা করেছি যে, বল আসবে, আমি যেভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলি ঠিক সেভাবে এখানে খেলতে। আর কিছু আমি চিন্তা করিনি।’
টেস্ট অভিষেকে দলের জন্য সেরাটা দিতে চেষ্টা করেছেন ২৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। বলেছেন,
‘অবশ্যই ভালো লাগছে। সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলার। অভিষেক টেস্ট। আমি চেষ্টা করেছি আমার দলের জন্য সেরাটা দেওয়ার, হয়তো আমি পরিপূর্ণ করতে পারিনি। যতটুকু হয়েছে, আশা করি পরবর্তীতে দলের জন্য যেন কিছু করতে পারি।’
উইকেটে বেশ থিতু হয়ে গিয়েছিলেন সাদমান। দেবেন্দ্র বিশুর শিকার হয়ে ফিরে মিস করেছেন সেঞ্চুরিটা, যার জন্য কিছুটা আফসোস হতেই পারে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সাতটি সেঞ্চুরি মালিক এই ব্যাটসম্যান বলেছেন,
‘এমন কোনো হতাশা নেই, একটু তো সবারই, অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরির চাওয়া তো সবারই থাকে। ওরকম কোনো হতাশা নেই। দলের জন্য যতটুকু দেওয়ার দরকার ছিল আমি সেরকম ব্যাটিং করেছি। হয়তো পুরোটা করতে পারিনি। যেরকম দরকার ছিল শেষ করতে পারিনি। আমার মনে হয় আরেকটু দিতে পারতাম দলকে।’
একজন বাবার স্বপ্নপূরণ
দুই যুগেরও বেশি সময় বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত শহীদুল ইসলাম। বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকের পর থেকেই ছেলেকে টেস্ট ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন লালন করে ফিরছিলেন তিনি। শুক্রবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সাদমানের টেস্ট ক্যাপ পাওয়ার মধ্য দিয়ে বাবা শহীদুলের সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
ছেলেকে টেস্ট ক্রিকেটার বানানোর প্রবল উদ্দম নিয়ে শহীদুল ইসলাম বলেছেন,
‘১৯৯৯ সাল থেকে আমি ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। আমার স্বপ্ন ছিল, ছেলেকে ক্রিকেটার হিসেবে তৈরি করার। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের অনেক ঘাটতি আছে। টেস্ট ক্রিকেটই হলো সবচেয়ে মর্যাদার ফরম্যাট। আমি আমার ছেলেকে সব সময় বুঝিয়েছি টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে।’
বিসিবির এই সিনিয়র কর্মকর্তার আশা, সাদা পোশাকে ওপেনিংয়ে তামিম ইকবালের সঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশ দলে থিতু হবেন সাদমান। বাংলাদেশও পাবে পরিপূর্ণ টেস্ট ওপেনার। তিনি বলেছেন,
‘দেশের ক্রিকেটে অনেক দিন ধরেই ওপেনিংয়ে সমস্যা আছে। তামিম ইকবাল ছাড়া তেমন কেউ সুবিধা করতে পারছে না। আমি আমার ছেলেকে ক্রিকেটের সেই সমস্যা কাটিয়ে তোলার জন্য প্রস্তুত হতে বলেছি। তাকে বলেছি, নিজের উইকেটের গুরুত্ব বুঝবে এবং সাকিব-তামিম-মুশফিকদের মতো লম্বা সময় ধরে খেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে।’
নিজের ক্যারিয়ারে বাবার ভূমিকা, প্রেরণা নিয়ে কথা বলেছেন সাদমানও। শুক্রবার প্রথম দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাঁহাতি এই ওপেনার বলেছেন,
‘বাবার ভূমিকা অবশ্যই আছে। আব্বু সব সময় ক্রিকেটে সহযোগীতা করেছেন। আমি সবসময় ক্যাম্পে যেতাম, অনূর্ধ্ব ১৫-১৭ ক্যাম্পে সবসময় আমাকে নিয়ে যেত। তখন আমি ছোট ছিলাম। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল, খেলোয়াড় হবো। যেভাবে আব্বু খেলার জন্য বলেছে, আমি একাডেমি কিংবা স্কুল ক্রিকেট থেকে ওভাবেই তৈরি হয়েছি। আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে খেলার জন্য। কিভাবে খেলতে হয়, কিভাবে জীবন গঠন করতে হয় ক্রিকেটারদের, ওগুলো আমাকে এখনও বলে। নিজেকে চেষ্টা করি ওভাবে রাখার।’
মনের ভেতর টেস্ট খেলার প্রতি টান, লম্বা সময় ব্যাটিংয়ের জন্য চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, ধৈর্য্য, নিষ্ঠা অটুট থাকলে অদূর ভবিষ্যতে শুধু বাবা শহীদুল ইসলাম নন, ২২ গজে বাংলাদেশেরই অনেক চাহিদা পূরণের সম্ভাবনা রয়েছে সাদমানের মাঝে।