গেল বছরের কথা। নিউজিল্যান্ডে সিরিজ খেলতে গিয়ে একেবারেই দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। ওয়েলিংটনে টেস্ট ম্যাচ হবে। বাংলাদেশ কী হবে না হবে সেই দুশ্চিন্তায় বিভোর। কিন্তু খেলতে তো হবেই। ব্যাটে নামবেন মুশফিকুর রহিম। তামিম কেন যেন মুশফিকের দুশ্চিন্তাটা টের পাচ্ছিলেন খুব ভালো করে। হাতে একটা কয়েন ছিল। আপন মনে সেটা নিয়ে খেলে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা এই ব্যাটসম্যান। কী মনে হতেই সেটা মুশফিকের হাতে দিলেন। বললেন, “ভাই, এটা পকেটে রেখে নামেন। রান পাবেন।” বলে নেওয়া ভালো, এই কয়েনটি কিন্তু মুশফিকেরই ছিল। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে ভুগছিলেন মুশফিক, তখনকার সময়ের। তার পকেট থেকেই কয়েনটি পড়ছিল। তুলে নিয়েছিলেন তামিম।
হাস্যকর মনে হলেও সত্য যে, মুশফিক সেই কয়েন পকেটে নিয়েই মাঠে নেমেছেন। কুসংস্কারে তিনি বিশ্বাস করেন আর না করেন, তিনি সেই ম্যাচে সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন। উদযাপনের সময় তাই কয়েনটি উঁচিয়ে ধরতে ভোলেননি।
খেলোয়াড়দের মধ্যে এমন অদ্ভুত কিছু কুসংস্কার দেখা যায় প্রায় সময়ই। বিশেষ করে ফুটবলে যেন আরও বেশি। পেলে থেকে শুরু করে রোনালদো, ক্যাসিয়াস, এমনকি ফুটবলে দলীয় কুসংস্কারের গল্পও শোনা যায়। ফুটবলের কিছু অদ্ভুত কুসংস্কার নিয়ে এই আয়োজন।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ডান পা
রিয়াল মাদ্রিদ সুপারস্টার, চারবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী ও বিশ্ব ফুটবলের এযাবতকালের অন্যতম সেরা একজন খেলোয়াড় পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তার নাম মুখে এলেই তার পারফর্মেন্স নিয়ে অনেক কথা হতে পারে। তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কেন তিনি এত বেশি সফল? উত্তরে ভক্ত-সমর্থকরা বলবে, তার কঠোর পরিশ্রমের কথা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নিজের সফলতার পেছনে কেবল এই পরিশ্রমকেই কৃতিত্ব দেন না সিআরসেভেন। এসবের পেছনে অনেকখানি হাত রয়েছে তার কুসংস্কারে বিশ্বাসী মনের।
সত্যিই তাই। খেলার ব্যাপারে কিছু কুসংস্কার মেনে চলেন রোনালদো। বিমানে চড়ে যদি কোথাও খেলতে যান, বিমান থেকে নেমে সবসময় আগে ডান পা মাটিতে রাখেন। ঠিক যেভাবে ম্যাচে ফ্রি-কিক দেওয়ার আগে তার ডান পা সামনে থাকে সেভাবে।
শুধু তা-ই নয়। রোনালদো যখন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেন, তখন মাঠে নামার আগে টানেল থেকে সবার পরে বের হন তিনি। কিন্তু উল্টোটা করেন পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে। সেখানে সবসময় সবার আগে মাঠে নামেন তিনি!
একই কাজ করতেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার রোনালদো। তিনি অবশ্য যেকোনো ম্যাচেই মাঠে নামার আগে ডান পা দিয়ে নামতেন।
ম্যাচ জিততে ডাইনীর শরণাপন্ন অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দল
যেকোন মূল্যে ১৯৭০ ফুটবল বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা পেতে চায় অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দল। ১৯৬৯ সালের সেই বাছাইপর্বে তাই মোজাম্বিকের এক স্টেডিয়ামে তারা মুখোমুখি হলো জিম্বাবুয়ে দলের বিপক্ষে খেলতে। সেখানে ঘটেছিল অদ্ভুত ঘটনা। কয়েকজন খেলোয়াড় কোনোভাবে জানতে পারলো, মোজাম্বিকে একজন ডাইনি আছে। সে নাকি চাইলেই ঝাড়ফুঁক দিয়ে প্রতিপক্ষকে অভিশপ্ত করতে পারে। চাইলেই হারিয়ে দিতে পারে। ব্যস, ওই কয়েকজন ফুটবলারের চাপে পড়ে পুরো দলই রাজি হয়ে গেল সেই ডাইনির সাহায্য নিতে।
সেই ডাইনী তাদেরকে একটা কিছু হাড় দিলো, যেগুলোকে প্রতিপক্ষের গোল পোস্টের মাটির নিতে পুঁতে রাখতে হবে। অজি দল সেটাও করেছিল।
ডাইনীর সেই ওষুধ কাজে লেগেছিল। অস্ট্রেলিয়া জিম্বাবুয়েকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দেয়। কিন্তু ঝামেলা হয়ে যায় ম্যাচের পরে। ওই ডাইনি অজি দলের কাছে ১,০০০ পাউন্ড চেয়েছিল। দিতেও রাজি ছিল অস্ট্রেলিয়া দল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা সেই অর্থ ডাইনীকে দেয়নি। ফলাফল, রেগেমেগে ডাইনি ডাক্তার অভিশাপের মোড় দিল ঘুরিয়ে! বদলে গেল অস্ট্রেলিয়ার পরের ম্যাচের গুটি! তখন থেকেই নাকি অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ফুটবল দল অভিশপ্ত।
তারা ১৯৭৪ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করলেও মূল পর্বে বাজেভাবে হেরে যায়। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ইরানের বিপক্ষে প্রথমার্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে থেকেও ম্যাচ হেরে যায় তারা। ২০০১ সালেও একই অবস্থা হয়।
অবস্থার পরিবর্তন না করলে যেন হচ্ছিলোই না। সাবেকরা শেষপর্যন্ত বাধ্য হয় আবারো মোজাম্বিকে গিয়ে সেই ডাইনীর শরণাপন্ন হতে। ডাইনি তাদেরকে আবারও সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচের স্টেডিয়ামে পাঠায়। সেখানে একটা মুরগি জবাই করা হয়, পুরো স্টেডিয়ামে মুরগির রক্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুজন ফুটবলার সেই স্টেডিয়ামের কাদা মেখে গোসল করেন। তারপর অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ করে অস্ট্রেলিয়া দল। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে তারা দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
পেলের জার্সি
ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে কেবল জাতীয় দলেরই নয়, ক্লাব ফুটবলেও ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই ফুটবলই তাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলে। কোনো এক মৌসুমে তিনি ম্যাচ শেষে নিজের একটি জার্সি এক ভক্তকে দিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই নাকি তার পারফর্মেন্স খারাপ হতে থাকে। মাঠে নিজেকে একেবারেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। এমন সময় তার হঠাৎ মনে হলো, ওই জার্সিই এসব ঝামেলার জন্য দায়ী। তখন তার বন্ধুকে তিনি পাঠালেন সেই জার্সি খুঁজে বের করতে। যেভাবেই হোক, ভক্তের কাছ থেকে সেই জার্সি নিয়ে আসলেই নাকি তিনি আবারও মাঠ কাঁপাতে পারবেন এমনই ধারণা বদ্ধমূল ছিল তার।
পেলের সেই বন্ধু জার্সি ফিরিয়ে এনেছিলেন। কয়েক ম্যাচ বাদে পেলে আবারও স্বরূপে মাঠে ফিরেছিলেন। তিনি আরও বিশ্বাস করে বসেছিলেন, এই জার্সি ফিরে পেয়েছেন বলেই আবারও ভালো খেলতে পারছেন তিনি। কিন্তু ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। পেলের বন্ধু ওই জার্সি খুঁজে পাননি। তিনি পেলের সর্বশেষ ম্যাচের আগের ম্যাচে ব্যবহৃত একটি জার্সি পেলের হাতে ধরিয়ে দেন।
তিনবারের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার পেলে সেটাকেই সেই জার্সি মনে করে নিয়ে নেন। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটিই ছিল পেলের কুসংস্কার। পেলের কাছে ওই জার্সি কেবল জার্সিই ছিল না, ভাগ্য ঘুরিয়ে দেওয়ার পথও ছিলো!
মাঠে প্রস্রাব করলেই পেনাল্টিতে জয়
মাঠে প্রস্রাব করলেই পেনাল্টি আটকানো যাবে। এমন ভাবনা বদ্ধমূল হয়েছিল সাবেক আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক সার্জিও গয়কোচিয়ার। ঘটনার শুরু ১৯৯০ বিশ্বকাপে। সেবার আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল যুগোস্লাভিয়া। সার্জিও মাঠে নামার আগে এত বেশি পানি পান করেছিলেন যে পেনাল্টির আগে বেদম চাপ হলো। কিন্তু তখন প্রস্রাব করতে যাওয়ার জন্য মাঠের বাইরে যাওয়ার মতো অবস্থা বা সময় কোনোটাই ছিল না। অগত্যা সবার অজান্ত মাঠের মধ্যেই প্রস্রাব করে দিলেন। পেনাল্টিও আটকে দিলেন। একই আসরে সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষেও ম্যাচ গড়লো পেনাল্টিতে। কী মনে হলো, সার্জিও গয়কোচিয়া এবারও মাঠে প্রস্রাব করলেন। তাজ্জব হয়ে নিজেই টের পেলেন, পেনাল্টি আটকে আর্জেন্টিনাকে জেতাতে পেরেছেন তিনি!
তখন থেকেই তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, পেনাল্টির আগে যদি মাঠে প্রস্রাব করা যায় তাহলেই পেনাল্টিতে জয় পাওয়া যাবে। সার্জিও নিজেই এই তথ্য স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি কতদিন পর্যন্ত এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছেন তার কোনো তথ্য জানা যায়নি।
ইকার ক্যাসিয়াসের কুসংস্কার
স্পেনের বিশ্বকাপজয়ী ও রিয়াল মাদ্রিদের তারকা গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসকে বলা হয় কালের অন্যতম কুসংস্কারাছন্ন ফুটবলার। মাঠে নামার আগে এবং মাঠে নেমে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা করতেন ক্যাসিয়াস এবং সেগুলো মনেপ্রাণে মেনেও চলতেন ঠিকঠাক।
কুসংস্কারগুলো কেমন? ক্যাসিয়াস নিজের জার্সির হাতা কেটে ফেলতেন, কখনও বা ইচ্ছে করে মোজা পরতেন উল্টো করে। আর সবচেয়ে বেশি যা করতেন, তা হলো গোল লাইন পর্যন্ত বাঁ পা দিয়ে চিহ্ন দিয়ে রাখতেন। এগুলো তার বেশ কাজেও দিতো! তার দাবী, প্রায়ই নাকি ফল পেতেন হাতেনাতে!
ফিচার ইমেজ- FIFA