যারা ক্রিকেট নিয়ে টুকটাক খবর রাখেন তাদের, অনেকের কাছেই রমাকান্ত আচরেকার নামটি বেশ পরিচিত। কে তিনি? তিনি কোনো ভালো খেলোয়াড় নন বা কোনো বড় কোচও নন। তবে কীসের জন্য তাঁর এই নামডাক? কারণ তিনিই শচীনের প্রথম কোচ, বলা চলে শচীনকে তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। কেন তাঁর কথা এলো? আসছি সে ব্যাপারেই।
কার্লোস রেক্সাচ একজন আপাদমস্তক বার্সেলোনা ম্যান। সেই ১২ বছর বয়সে ক্লাবে যোগ দিয়ে খেলেছেন টানা ১৭ বছর। এরপর এই ক্লাবেই সহকারী কোচ, স্কাউট, প্রধান কোচ, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, এডভাইজর এমন বহু পদে আসীন থেকেছেন তাঁর পুরো ক্যারিয়ারে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি এমন একজন যিনি অনায়াসে বার্সার ইতিহাসে ঠাই পেয়ে যাব।’’ পেতেই পারেন, এত বর্ণাঢ্য বার্সা ক্যারিয়ার তাঁর। তবে কি কারণে ইতিহাসে স্থান পাওয়ার কথা বলেছিলেন জানেন? একজন খেলোয়াড়কে বার্সায় সাক্ষর করানোর জন্য! খেলোয়াড়টি আর কেউ নন, লিওনেল মেসি।
এগারো বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাবে খেলার সময় মেসির হরমোনের সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিদিন প্রায় ১০০০ ডলারের ইঞ্জেকশন দেয়া প্রয়োজন। স্থানীয় ক্লাবের এত বাজেটই নেই, তারা অস্বীকৃতি জানালো চিকিৎসার ভার বহনে। বাবা স্টিল ফ্যাক্টরি শ্রমিক আর মা অন্যের ঘরদোর পরিষ্কার করেন। তাদের পক্ষেও খরচ জোগাড় করা সম্ভব না। তাই মেসির ক্যারিয়ার তখন প্রায় শেষের পথে। কিন্তু ততদিনে তাঁর প্রতিভা অনেকেরই চোখে লেগেছে। ক্যাটালুনিয়ায় থাকা তাঁর কিছু আত্মীয়ের মাধ্যমে বার্সেলোনা ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করা হলো। বার্সা অফিশিয়াল মিনেগুয়েল্লার সাথে কথা হয় তাঁর আত্মীয়ের। তারা মিনেগুয়েল্লাকে মেসির কিছু ভিডিও দেখায়। ভিডিও দেখার পর মিনেগুয়েল্লা এক মিনিটও দেরী করেননি, বলে দেন মেসিকে পুরো পরিবার নিয়ে ক্যাটালুনিয়া আসতে ট্রায়াল দেওয়ার জন্য।
১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০০০। হোরাসিও গাজ্জাওলি ক্যাটালুনিয়া এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন মেসিদের রিসিভ করার জন্য, তারও খানিকটা বিরক্তি। একটি বাচ্চা ছেলের জন্য এত আদিখ্যেতা। মেসিকে সপরিবারে নিয়ে গেলেন মিনেগুয়েল্লার কাছে। মিনেগুয়েল্লা মেসিকে আবার নিয়ে যান সোজা কার্লোস রেক্সাচের কাছে। গিয়েই রেক্সাচকে বলেন, “আমি একে সোজা আর্জেন্টিনা থেকে আনিয়েছি। ম্যারাডোনার পর এর মতো স্কিল আমার চোখে আর পড়েনি। এর ট্রায়াল আয়োজন করা হোক।’’ মিনেগুয়েল্লার কথা রেক্সাচ ফেলতে পারলেন না। কারণ ২০ বছর আগে এই মিনেগুয়েল্লাই ম্যারাডোনাকে বার্সায় নিয়ে আসেন। তিনি সম্মতি দিলেন।
পরদিন মেসিকে ট্রেনিংয়ে নিয়ে আসা হয়। ড্রেসিংরুমে পিকে, সেস্ক ফ্যাব্রেগাসরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে পাঁচ ফুটেরও কম হ্যাংলা একটি ছেলে তাদের সাথে প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছে। প্র্যাকটিস করতে গিয়েও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, মানুষ এত ট্যালেন্টেড হয় কীভাবে! যেদিন রেক্সাচের ট্রায়াল দেখার কথা, সেদিন রেক্সাচ আসতে দেরি করছেন, উনি স্বভাবতই দেরি করেন মাঝেমাঝে। ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে, মিনেগুয়েল্লার কপালে ঘাম, যদি রেক্সাচ না আসেন! খেলার মাঝামাঝি সময়ে উনি এলেন। বসার পরই দেখলেন পায়ে বলটি পেয়ে বডি ফেইন্টে দুই প্লেয়ারকে বিট করে হেলায় আরো দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোলে শ্যুট নিলেন মেসি। রেক্সাচের ভাষায়, “তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। যে কেউই নিত সেই খেলা দেখলে।’’ মেসিকে বলা হয় তাকে রাখতে বার্সেলোনা ক্লাব রাজি হয়েছে। সেই সাথে তাঁর চিকিৎসার সমস্ত খরচ আর পরিবারের ভরণপোষণ। তাঁর বাবাকে বাৎসরিক ৪০,০০০ পাউন্ড দেয়ারও কথা বলা হয়। মেসিরা উঠে এলেন ফ্ল্যাটে, ঠিক ক্যাম্প ন্যু ঘেঁষা। তবে তখনও বার্সা তাঁর সাথে লিখিত চুক্তি করেনি।
বার্সার সেই সময়টা মোটেও ভালো যাচ্ছিলো না। ট্রফি খরা চলে, ওদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের আবার দাপট শুরু হয়েছে, ক্লাব ক্যাপ্টেন ফিগো গিয়ে যোগ দিয়েছেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদে, চলে অর্থ সংকট। সব মিলিয়ে বার্সার অবস্থা তখন তথৈবচ। সে অবস্থায় একটি ১৩ বছরের ছেলের জন্য তাঁর পুরো পরিবারের ভার বহন, ৪০,০০০ পাউন্ড বাৎসরিক দেয়া আর এত দামী হরমোন ইঞ্জেকশনের খরচ বহন করা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই আনুষ্ঠানিক চুক্তির ব্যাপারটা বার্সা গুছিয়ে আনতে পারেনি। ওদিকে মেসি স্প্যানিশ বয়সভিত্তিক লীগ খেলতে পারছেন না তাঁর নন-স্প্যানিশ সিটিজেনশিপের জন্য। সব মিলিয়ে বাজে অবস্থা। খবর পেয়ে আরো অনেক ইউরোপিয়ান বড় ক্লাবই তাকে কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিভক্ত বোর্ডের কারণে তাঁর চুক্তি আনুষ্ঠানিক হচ্ছে না, আবার অনেক ক্লাবই উৎসাহী। আর ঐদিকে তাঁর পরিবারও হতোদ্যম।
এমতাবস্থায় তাঁর বাবা রেক্সাচের সাথে মিটিং করতে চান। রেক্সাচ তাকে সময় দিলেন। দেখা করে মেসির বাবা তাঁর হতাশার কথা জানিয়ে বলেন যে, আরো অনেক বড় ক্লাবই মেসিকে পেতে চায়। এর মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদও আছে। তারা কিছু না করলে তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে চলে যাবেন। এ কথা শুনেই রেক্সাচের টনক নড়ে যায়। কী ভেবে লাঞ্চ টেবিলেরই একটি বড় টিস্যু পেপার নিয়ে তাতে লিখলেন, “I, Charly Rexach, in my capacity as technical secretary for FC Barcelona, and despite the existence of some opinions against it, commit to signing Lionel Messi as long as the conditions agreed are met.”, ক্যাটালান ভাষার অনুবাদ করলে ঠিক এটাই দাঁড়ায়। সেখানে স্বাক্ষর করলেন মেসি নিজেও।
সমস্যা তারপরও ছিল। মেসির মা আর ভাইয়েরা ক্যাটালুনিয়ায় ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তারা চলে যেতে চাইছিলেন, মেসি নিজেও বেশ হোমসিক। তারা ভেবেছিলেন সবাই চলে গেলে ঘর কাতর মেসিও ঠিকই তাদের সাথে চলে আসবে। হলো এর উল্টো। যখন তাঁর মা তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি বাকি ভাইদের নিয়ে আর্জেন্টিনা ফিরে যাচ্ছেন, মেসিও কি তাদের সাথে ফিরে যাবে কি না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘরকাতর ছেলেটিই দৃঢ় গলায় মানা করলো, থেকে গেলো লিওনেল মেসি।
এরপর বার্সার সাথে তাঁর আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়। একে একে জুভেনাইল এ, বি, বার্সা সি, বার্সা বি, বার্সা এ হয়ে এস্পানিওলের সাথে এক ফ্রেন্ডলি ম্যাচে প্রথম বার্সা স্কোয়াডে চান্স পান মেসি। এরপরে আর ফিরে দেখা হয়নি। বিশ্বকে পায়ের মোহনীয় জাদুতে মোহিত করে রেখেছেন আজ অবধি। বার্সাকে জিতিয়েছেন অসংখ্য ট্রফি। নিজে ব্যালন ডি অর জিতেছেন ৫ বার, অনেক সময় বার্সাকে একা হাতে টেনেছেন, টানছেন।
সেদিন রেক্সাচ খানিকটা দেরি করলে আজ হয়ত মেসি আর্সেনাল বা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলতেন। বার্সার ইতিহাসের সফলতম এই প্লেয়ারটি অন্য কোনো জার্সি গায়ে হয়ত অন্য কোনো ক্লাবের ট্রফি ক্যাবিনেট পূর্ণ করতে থাকতেন। রেক্সাচের অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তা আর হয়ে উঠেনি, আর ঠিক এই কারণটার জন্যই রেক্সাচ ভাবেন, তিনি বার্সা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। খুব একটা অবান্তর ভাবনা কি?
কোনো উপায়ে এই টিস্যুটি ক্লাব অফিশিয়াল হোরাশিও গিজ্জিওলির হাতেই এসে পড়ে। বহু অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তার কাছ ছাড়া করে এটি কোনো জাদুঘরে দেননি। যত্ন করে আগলে রাখুন হোরাশিও, বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান আর গুরুত্ববহ টিস্যুটি যে আপনারই কাছে!