১.
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন স্পিনারদের জয়জয়কার চলছে। বিশেষ করে রিস্ট স্পিনাররা অধিকতর সাফল্য পাচ্ছেন। টি-টোয়েন্টিতে বর্তমানে বিশ্বের সেরা বোলার কে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ মানুষ রশিদ খানের নাম বলবে। পরিসংখ্যানও তাই বলে, তিনি মাত্র ৩৮টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৬.০২ ইকোনমি রেইটে এবং ১১.৫ স্ট্রাইক রেইটে ৭৫ উইকেট শিকার করেছেন। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা বোলারদের তালিকায় তিনি ৬ষ্ঠ স্থানে উঠে এসেছেন।
তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নিজের ঘূর্ণিতে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করছেন। সব ধরনের টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মাত্র ১৫৫ ম্যাচেই ২৩৭ উইকেট শিকার করেছেন রশিদ খান। রান খরচের দিক থেকেও তিনি বেশ কৃপণ। টি-টোয়েন্টিতে ওভারপ্রতি মাত্র ৬.০৯ রান খরচ করেছেন তিনি। শুধুমাত্র রশিদ খান নন, টি-টোয়েন্টিতে এখন বেশ কিছু স্পিনার সাফল্য পাচ্ছেন। আইসিসি র্যাংকিংও তাই বলে। বর্তমানে টি-টোয়েন্টিতে বোলারদের র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ১১জনের মধ্যে দশজনই স্পিনার। রশিদ খানের পর শাদাব খান, ইমাদ ওয়াসিম, কুলদ্বীপ যাদব, আদিল রশিদ, অ্যাডাম জাম্পা, সাকিব আল হাসান, ইশ সোধি, মিচেল স্যান্টনার এবং মোহাম্মদ নবী র্যাংকিংয়ের উপরের দিকেই অবস্থান করছেন।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা বোলারটিও স্পিনার। শহীদ আফ্রিদি তালিকায় শীর্ষে থেকে ৯৮ উইকেট শিকার করেছেন। সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা বোলারদের তালিকায় শীর্ষ নয়জনের মধ্যে ছয়জন স্পিনার।
২.
টি-টোয়েন্টিতে সাধারণত কোনো অধিনায়ক পাওয়ার-প্লে এবং ডেথ ওভারে স্পিনারদেরকে দিয়ে বোলিং করাতে চান না। তবে এই প্রথা থেকে অনেক দল বের হয়ে আসছে, এবং তারা সফলও হচ্ছে। সব ধরনের টি-টোয়েন্টি ম্যাচে স্পিনারদের ইকোনমি রেট পেসারদের থেকে কম। তাই অনেক দলই স্পিনারদের দিয়ে দল সাজিয়ে প্রতিপক্ষের রানের চাকা চেপে ধরার চেষ্টা করে।
আইপিএলে সবচেয়ে সফল দল মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস। ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আইপিএলের ছয় আসরের মধ্যে পাঁচবার ফাইনাল খেলেছে তারা। তাদের এই সাফল্যের পিছনে একটি কারণ হিসাবে ধরা যায় স্পিনারদের উপর আস্থা রাখা। ২০১০ সালে চেন্নাই সুপার কিংসের মূল একাদশে প্রায় নিয়মিত খেলতেন মুত্তিয়া মুরালিধরন, রবীচন্দ্রন অশ্বিন, শাদাব জাকাতি। এই তিনজন স্পেশালিস্ট স্পিনারের পাশাপাশি সুরেশ রায়নাকেও বল হাতে দেখা যেতো। চেন্নাই তাদের ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্পিনারদের সদ্ব্যবহার করতো। উপমহাদেশ এমনিতেই স্পিনারদের স্বর্গ। আর চেন্নাইয়ের ‘ঘরের মাটি’ এম.এ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে স্পিনাররা আরেকটু বাড়তি সুবিধা পায়। সেটাই কাজে লাগাতো চেন্নাই।
২০১০ সালে আইপিএলের ফাইনালে মুম্বাইয়ের মুখোমুখি হয় চেন্নাই। প্রথমে ব্যাট করে চেন্নাই ১৬৮ রান তুলেছিলো। জবাবে টেন্ডুলকারের মুম্বাইকে ১৪৬ রানে থামিয়ে দেয় চেন্নাইয়ের বোলাররা। বিশেষ করে স্পিনারদের কথা বলা যায়। চেন্নাইয়ের চার স্পিনার এই ম্যাচে মোট ১৩ ওভার বল করেছিলেন। বিপরীতে স্পিনার হিসাবে মুম্বাইয়ের হয়ে শুধুমাত্র হরভজন সিং খেলেছিলেন। আইপিএলের পরের আসরেও চেন্নাই শিরোপা জিতেছিলো। ফাইনালে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে ২০৫ রান করেছিলো চেন্নাই। জবাবে ক্রিস গেইল, বিরাট কোহলি এবং এবি ডি ভিলিয়ার্সদের মতো ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে ১২ ওভার স্পিনারদেরকে দিয়ে বোলিং করান ধোনি। পার্টটাইম বোলার সুরেশ রায়নাও চার ওভার বোলিং করেছিলেন ব্রাভো, অ্যালবি মরকেল এবং ডগ বোলিঞ্জারের মতো পেসার থাকা সত্ত্বেও। স্পিনারদেরকে প্রাধান্য দেওয়ার সুবাদে ব্যাঙ্গালোরের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে ১৪৭ রানে বেঁধে রেখে টানা দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো চেন্নাই।
৩.
টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তান বেশ সফল দল। এখন পর্যন্ত ৭১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ৪৯ ম্যাচে জয় পেয়েছে তারা। শতকরা হারে জয়ের দিক দিয়ে তারা সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। তাদের সাফল্যের পিছনে রয়েছে স্পিনারদের হাত। তাদের স্পিন ডিপার্টমেন্টে সব রকমের স্পিনার রয়েছে। লেগ স্পিনার রশিদ খানের পাশাপাশি দলে নিয়মিত খেলেন অফস্পিনার মোহাম্মদ নবী এবং রহস্যময় স্পিনার মুজিব-উর রহমান। এছাড়া বাঁহাতি স্পিনার আমির হামজা ও পার্টটাইম স্পিনার হিসাবে সামিউল্লাহ শেনওয়ারিও বেশ কার্যকরী। তাদের ব্যাকআপ স্পিনাররাও বেশ প্রতিভাবান। বর্তমানে আফগানিস্তানের হোম গ্রাউন্ড হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ভারতের মাঠ। এর আগে তারা খেলতো সংযুক্ত আরব আমিরাতে। দুই জায়গাতেই স্পিন সহায়ক উইকেট তৈরি করা হয়। তাই তো ম্যাচে তাদের স্পিনাররা ৫৬% বল করে প্রতিপক্ষকে অল্প রানের মধ্যে বেঁধে রাখছে
ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্টে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত স্পিনারদেরকে দিয়ে সবচেয়ে বেশি ওভার করিয়েছে সিপিএলের দল গায়ানা অ্যামাজন ওয়ারিয়ার্স। তারা মোট ওভারের ৫১% ওভার করিয়েছে স্পিনারদের দিয়ে। টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তানের পর তারাই সবচেয়ে বেশি স্পিনার ব্যবহার করেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে মানসম্মত স্পিনারের সংখ্যা খুব বেশি নেই। ওখানকার আবহাওয়ায় পেসাররাই বেশি সাফল্য লাভ করেন। কিন্তু গায়ানার ঘরের মাঠ প্রভিডেন্স স্টেডিয়াম ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যান্য মাঠের মতো না। এখানে স্পিনাররা অনেক সুবিধা পেয়ে থাকেন। স্পিন সহায়ক পিচ হওয়ার কারণে ব্যাটসম্যানদের রান তুলতে সংগ্রাম করতে হয়।
ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগাতে গায়ানা সেভাবেই তাদের বোলিং আক্রমণ সাজিয়েছে। সিপিএলের শেষ আসরে বিদেশি কোটায় খেলিয়েছে ইমরান তাহির এবং ক্রিস গ্রিনকে। লেগ স্পিনার তাহির এবং অফস্পিনার গ্রিন পুরো আসরেই রানের চাকা আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাহির ১২ ম্যাচে ১৬ উইকেট শিকার করেছেন। তিনি ১২ ম্যাচে ওভারপ্রতি মাত্র ৫.৯১ রান করে দিয়েছেন। এছাড়া ১১ ম্যাচ খেলে গ্রিন ১০ উইকেট শিকার করেছেন এবং প্রতি ওভারে খরচ করেছেন মাত্র ৬.২৭ রান।
৪.
ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রতিবছর বিশ্বমানের বেশ কয়েকজন পেসার উঠে আসছে। সেই তুলনায় আন্তর্জাতিক মানের স্পিনারের দেখা পাচ্ছেনা তারা। তাই গায়ানা ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগাতে শরণাপন্ন হয়েছিলো দুই বিদেশি স্পিনারের। এছাড়া তাদের দলে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের দুই স্পিনার দেবেন্দ্র বিশু এবং ভেরাস্বামী পেরমল। শোয়েব মালিকও দলের প্রয়োজনে হাত ঘুরাতেন। নিজেদের মাঠের সদ্ব্যবহার করেই তারা সিপিএলের শেষ আসরের ফাইনালে উঠেছিল। গায়ানা অবশ্য নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করতেই পারে। পুরো টুর্নামেন্টে ভালো খেলার পরও শিরোপা ঘরে তোলা হয়না তাদের। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সিপিএলের ছয় আসরের মধ্যে চারবার ফাইনালে উঠেছিলো তারা, কিন্তু একবারও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। যে দুইবার ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিলো, ঐ দুইবার তারা তৃতীয় স্থানে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করেছিলো।
টি-টোয়েন্টিতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা গায়ানার কিউই ব্যাটসম্যান লুক রঙ্কিও প্রভিডেন্সে ব্যাট করতে সমস্যায় পড়েছিলেন। সেখানকার অস্বাভাবিক বাউন্স এবং গতির কাছে নিজে পরাস্ত হলেও দলের স্পিনারদের কৃতিত্ব দিতে ভুল করেননি তিনি। দুই বিদেশি স্পিনাররের পাশাপাশি ঘরের স্পিনাররা আঁটসাঁট বোলিং করেছিলেন।
ক্রিকেট বিশ্লেষক জো হ্যারিস জানান, সিপিএলে স্পিনারদের গুরুত্ব কতটা। সিপিএলে কমপক্ষে দুইজন বিদেশি স্পিনার নিয়ে খেলেছে, এমন দলগুলো ৬০% ম্যাচ জিতেছে। একজন বিদেশি স্পিনার নিয়ে খেলা দল গুলোর জয়ের হার ৫২.৬%। আর একজনও বিদেশি স্পিনার খেলায়নি, এমন দলগুলোর জয়ের হার মাত্র ৩৮.৭%।
পাঁচ.
টি-টোয়েন্টিতে শেষের পাঁচ ওভারে সাধারণত পেসারদেরকে বোলিং আক্রমণে আনা হয়। কারণ প্রায় সব দলই মনে করে, শেষদিকে স্পিনাররা আক্রমণে আসলে ব্যাটসম্যানরা অনায়াসে ১৫ রান তুলতে পারবে। এইজন্য স্পিনারদের সেভাবে ব্যবহার করা হয়না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে ভিন্ন কথা।
ক্রিকভিজের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত শেষ পাঁচ ওভারে পেসারদের ইকোনমি রেট ৯.৫৮ এবং স্পিনারদের ইকোনমি রেইট ৮.৫৪। স্পিনাররা প্রায় এক রান করে কম খরচ করছে। তবুও অনেক দল এখনও স্পিনারদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। স্পিন সহায়ক উইকেট না হলে শেষদিকে স্পিনারদেরকে আক্রমণে আনার পরিকল্পনাও কেউ করেনা।
রশিদ খান এবং সুনিল নারাইন এই ধারণা কিছুটা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা দুইজনই শেষের ওভারগুলোতে দুর্দান্ত বোলিং করেন। শেষ পাঁচ ওভারে তাদের ইকোনমি রেইট মাত্র ৮.৭৫। আফগানিস্তানের স্পিনার মুজিব-উর রহমান শেষের দিকে বল না করলেও নিয়মিত বল হাতে ইনিংস উদ্বোধন করেন। পাওয়ার-প্লে’তে নতুন বলে তিনি বেশ সফল।
স্পিনারদেরকে দিয়ে দল সাজালে যে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না, সেটা গত বছর হায়দরাবাদ প্রমাণ করেছে। তারা একাদশে নিয়মিত সাকিব আল হাসান এবং রশিদ খানকে খেলাতেন, সেই সাথে মোহাম্মদ নবীও কয়েক ম্যাচে খেলেছেন। হায়দরাবাদ ২০১৩ সালেও অমিত মিশ্র এবং করন শর্মাকে নিয়মিত একাদশে রাখতো। এই দুই লেগ স্পিনারের সফলতায় তারা শেষ চারে ওঠে। ২০১৬ সালে সিপিএলে জ্যামাইকা তালাওয়াস তিনজন বাঁহাতি স্পিনার নিয়ে খেলেছিলো। তিনজনেই প্রতি ওভারে সাতের নিচে রান দিয়েছেন। টুর্নামেন্টে ১৩ ম্যাচের মধ্যে তিন বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান, ইমাদ ওয়াসিম, ফাবিয়ান অ্যালেন একসাথে নয় ম্যাচে খেলেছিলেন। নিয়মিত তিন স্পিনার খেলানো জ্যামাইকাই শেষপর্যন্ত ঐ আসরের শিরোপা ঘরে তুলেছিলো।
বর্তমানে টি-টোয়েন্টিতে পেস নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে। রশিদ খান, মুজিব-উর রহমান, সাকিব আল হাসান, কুলদ্বীপ যাদবসহ বেশ কয়েকজন ভয়ংকর স্পিনারের কল্যাণে এখনকার টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলোতে অধিনায়কের কমপক্ষে অর্ধেক ওভার স্পিনারদেরকে দিয়ে করান। আফগানিস্তান, চেন্নাই এবং গায়ানার বাতাস এখন অন্যান্য দলের গায়েও লাগছে।