অলিম্পিকের সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট হিসেবে অলিম্পিক ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কার্ল লুইস। ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকেই তার অভিষেক ঘটতে পারতো। অংশগ্রহণের জন্য যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন তিনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সে অলিম্পিক বয়কট করায় লুইসকে অপেক্ষা করতে হয় আরো চারটি বছর। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত টানা ১২ বছর চারটি অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই কেবল নয়, চারটি লং জাম্পে সোনা জিতে তিনি ছুঁয়েছেন আল অর্টারকে, ধরেছেন পাভো নুর্মির রেকর্ডও। অলিম্পিকে মোট ৯টি সোনা- এতদিনের ইতিহাসে এ দুজন ব্যক্তিই শুধু পেয়েছেন, যে রেকর্ড বর্তমানে ভেঙে দিয়েছেন মাইকেল ফেল্পস।
শৈশবের কার্ল লুইস
ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের এই অনন্য প্রতিভার জন্ম ১৯৬১ সালের ১ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যের বার্মিংহাম শহরে। পুরো নাম ফ্রেডেরিক কার্লটন লুইস। বাবা উইলিয়াম লুইস ও মা এলভিন লুইসের তৃতীয় সন্তান কার্ল লুইস। বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন অ্যাথলেটিক্সের কোচ। উইলিংবোরো হাই স্কুল থেকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা লাভের পর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ভর্তি হন হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অ্যাথলেট ছিলেন কার্লই। ১৫ বছর বয়সে হঠাৎ তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। মাত্র ২০ বছর বয়সের মধ্যেই ১০০ মিটার দৌড় ও লং জাম্পে তিনি বিশ্বে এক নম্বর স্থান দখল করে নেন।
১৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক
১৯৮৪ সালের অলিম্পিকে যখন তিনি প্রথম অংশ নেন, তখন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক লুইসের বয়স ২৩ বছর। এই অলিম্পিকে লুইসের প্রথম ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে অভিষেক ঘটে। অভিষেকেই ঘটান চমক। নিজের দেশের অসাধারণ অ্যাথলেট জেসি ওয়েন্সের রেকর্ড স্পর্শ করেন তিনি।
ওয়েন্সের মতো লুইসও একাই তুলে নেন চারটি সোনা: ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়, ৪ X ১০০ মিটার রিলে দৌড় এবং লং জাম্পে। ৮.৯০ মিটার লাফিয়ে ভেঙে দেন বব বিমনের বিশ্বরেকর্ড। ২০০ মিটার দৌড়ে তৈরি করেন নতুন অলিম্পিক রেকর্ড। রিলে বিভাগে ৩৭.৮৩ সেকেন্ডে ফিনিশিং টাচ অতিক্রম করে গড়েন বিশ্বরেকর্ড। ফলে ১৯৮৪ অলিম্পিকের ‘সুপারস্টার’-এর মর্যাদা তার দখলেই আসে।
১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিক
১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে লুইস কানাডার আরেক প্রতিদ্বন্ধী বেন জনসনের সামনে দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। ১০০ মিটার দৌড়ের ফাইনালে লুইসকে পিছনে ফেলে প্রথম হন বেন জনসন। লুইস হন দ্বিতীয়। কিন্তু ডোপ টেস্ট পরীক্ষায় পজিটিভ প্রমাণিত হওয়ায় জনসনের কাছ থেকে সোনার পদক ছিনিয়ে নেয়া হয়। আর অলিম্পিক কমিটি ১০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় হওয়া লুইসকে দ্রুততম পুরুষ হিসেবে ঘোষণা করে। এই অলিম্পিকে ১০০ মিটার ছাড়াও লং জাম্পে সোনা জেতেন লুইস। ২০০ মিটার দৌড়ে তিনি স্বদেশী জো ডিলোচের কাছে পরাজিত হয়ে রৌপ্য পদক পান। তবে ৪ X ১০০ মিটার রিলেতে দৌড়ে ব্যাটন হস্তান্তরে অনিয়মের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রিলে দলকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে তার পদক সংখ্যা দাঁড়ায় ৩টি।
১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিক
১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিকের শুরুতেই ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক টিমে নাম লেখাতে ব্যর্থ হন লুইস। কিন্তু তার পছন্দের লং জাম্প ও ৪ X ১০০ মিটার রিলেতে যোগ্যতা অর্জন করে অলিম্পিক দলে নাম লেখান। এই অলিম্পিকে লং জাম্প ও ৪ X ১০০ মিটার রিলেতে মিলিয়ে দুটি স্বর্ণ পদক জেতেন। তাছাড়া ৩৭.৪০ সেকেন্ডে রিলে দৌড় সম্পন্ন করে গড়ে তোলেন নতুন বিশ্বরেকর্ড।
১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিক
১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিক কার্ল লুইসের শেষ অলিম্পিক জয়যাত্রা। এই অলিম্পিকে তিনি পেলেন তার নবম সোনা। আর সে ইভেন্টটি হচ্ছে তার পছন্দের লং জাম্প, ১৮ বছর বয়স থেকে যে বিভাগে তিনি সবসময় কৃতিত্ব দেখিয়ে এসেছেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পরপর চারটি অলিম্পিকে তিনি লংজাম্পে ৪টি স্বর্ণপদক পান।
যেকোনো ইভেন্টের বিবেচনায় তার আগে এমন কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিলেন আর মাত্র দু’জন: গোলক নিক্ষেপে আল ওয়েরটার এবং নৌকাবাইচে পল এলভসট্রম। এই ন’টি সোনার মধ্যে কোন সোনাটির স্বাদ আলাদা? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে কার্ল লুইসের সহাস্য মন্তব্য, “সবকটাই আলাদা। একেকটার স্বাদ একেক রকম। তবে নবম সোনাটা পেতে সবচেয়ে বেশি মনঃসংযোগ করতে হয়েছে।”
অন্যান্য সাফল্য
১৯৮৩ সালের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম অভিষেক ঘটে কার্ল লুইসের। ঐ প্রতিযোগিতায় লং জাম্প, ১০০ মিটার এবং ৪ X ১০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণপদক জিতেন তিনি। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে তিনি ৮টি স্বর্ণপদক, ১টি রোপ্য ও ১টি ব্রোঞ্জ পদক পান। এছাড়াও প্যান আমেরিকান গেমস এবং গুড উইলস গেমসে অংশগ্রহণ করে যথাক্রমে ২টি স্বর্ণপদক ও ১টি ব্রোঞ্জ এবং ৩টি স্বর্ণপদক, ১টি রোপ্য ও ১টি ব্রোঞ্জ পদক জিতে নেন। অলিম্পিকসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি ২২টি স্বর্ণপদক, ৩টি রোপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। পদকের সংখ্যা হয়তো আরো বাড়তে পারতো, যদি যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক বয়কট না করতো। তারপরও তার প্রাপ্তির থালা বেশ ঈর্ষণীয়ই বটে।
অবসর গ্রহণ
১৯৯৬ সালের অলিম্পিকের পর কার্ল লুইস ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তার মিউজিক ব্যান্ড ‘ব্রেক ইট আপ’ এর পুনরজ্জীবন ঘটান। তবে খুব একটা সাফল্য পাননি।
কিছুদিন বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালে অভিনয়ের চেষ্টাও করেন। রাজনীতিতে নাম লেখানোর ইচ্ছা তার ছিল। ২০১১ সালের নিউজার্সি সিনেটের একটি আসনে ডেমোক্র্যাট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু নাগরিকত্বের ঝামেলায় তা আর হয়ে উঠেনি। বর্তমানে তিনি লস অ্যাঞ্জেলসে আছেন।
২০১৬ সালে কার্ল লুইস হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের সহকারী কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি লং জাম্প ও দৌড়ে ভবিষ্যতের অলিম্পিয়ান তৈরিতে নিয়োজিত। বর্তমানে আসন্ন ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে অলিম্পিকের আসর আয়োজনের লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি।
স্পোর্টসম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি
১৯৮৪ সালের অলিম্পিক শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল কার্ল লুইসের নাম। পৃথিবীর সেরা স্পোর্টিং সেলিব্রেটিদের একজন হিসেবে তিনি পরিচিতি পান সারা বিশ্বে। পরপর দুই অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জেতার পর প্রচার মাধ্যমগুলো কার্ল লুইসকে ‘কিং কার্ল’ হিসেবে ডাকতে শুরু করে। ১৯৯৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির ভোটে ‘স্পোর্টসম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি’ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। আমেরিকান ক্রীড়া ম্যাগাজিন স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড তাকে ঘোষণা করেছিল ‘অলিম্পিয়ান অব দ্য সেঞ্চুরি’ হিসেবে। ২০০১ সালে লুইস যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত হন।
বিতর্ক যাকে পিছু ছাড়েনি
এতো সাফল্যের পরও কার্ল লুইসের জীবন থেকে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। অলিম্পিক ভিলেজ সহ অলিম্পিয়ানদের সাথে তার রূঢ় আচরণ, মিডিয়ার সাথে তার বৈরিভাব সবসময় ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ড্রাগ নেয়া বিষয়েও ছিল তার সম্পর্কে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। ১৯৮৮ সালের অলিম্পিকের আগে কার্ল লুইস ডোপ টেস্ট উৎরাতে ব্যর্থ হন। তারপরও আইএএএফ তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছিল।
স্পষ্টভাষী কার্ল লুইস এক সাক্ষাৎকারে জানান, ড্রাগ নেয়ার ব্যাপারে অনেকেই তাকে প্ররোচিত করলেও তিনি কোনো সময়ই তাতে রাজি ছিলেন না। কিছু ভেষজ সামগ্রী গ্রহণের কথা স্বীকার করে নেন তিনি। এরপর তাকে অলিম্পিক ট্রায়ালে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষের বিচারে কার্ল লুইস ভেষজ সামগ্রী গ্রহণের ব্যাপারে অনবহিত ছিলেন এবং এগুলোর কোনোটিই শক্তিবর্ধক নয়। ফলে পার পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর আর কোনোদিনই তার বিরুদ্ধে নৈপুণ্যবর্ধক কোনো কিছু ব্যবহারের অভিযোগ ওঠেনি।
কৃতিত্ব ছাড়াও লুইস অলিম্পিকের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের কারণে। ১৯৮৭ সালে তার বাবা যখন ক্যান্সারে মারা যান, তখন কাঁদতে কাঁদতে তার কফিনের ওপর একটা সোনার পদক রাখেন কার্ল, বাবার গর্ব ছিল ছেলের সোনার পদক নিয়ে। বিস্মিত হয়ে যান মা, তখন কার্ল মাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, “ভেবো না মা, আমি আবার সোনা জিতব”। একজন সেরা অলিম্পিয়ানের মুখেই এই বক্তব্য শোভা পায়। কার্ল লুইস শুধু কথাই রাখেননি, দৌড় ও লংজাম্পে নানা বিস্ময়কর রেকর্ড গড়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে আদর্শ হয়ে আছেন। ইতিহাসের বুকে দুরন্ত অলিম্পিয়ান হিসেবে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছেন।