১০ অক্টোবর, ২০১৭। অধিনায়ক গুনারসনের সাথে তাল মিলিয়ে বিখ্যাত ভাইকিং ক্ল্যাপ করছেন স্টেডিয়ামে থাকা অগণিত আইসল্যান্ড ভক্তরা। ২০১৬ ইউরোতে ফিনিক্স পাখির মতোই জাগরণ ফুটবলের এই ভাইকিংদের। সে পাখি এখন পুরোদমে ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে। প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বকাপের মতো ফুটবলের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞে। নিজেদের গায়ে ‘ডার্কহর্স’ তকমাও জুটিয়েছে গিলফি সিগুর্ডসনের দল। তাদের সাথে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে কনকাকাফ অঞ্চল থেকে বাছাই পর্ব ডিঙ্গিয়ে আসা পানামাও। ৩ লক্ষ ৩৪ হাজার মানুষের দেশ আইসল্যান্ড কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ করে মূলপর্বে আসা পানামা বিশ্বকাপে কতটুকু চমক দেখাবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে তার আগে দেখে নেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে আসা দলগুলোর মধ্যে কারা কারা ভড়কে দিয়েছিলো প্রতিপক্ষকে আর চমকে দিয়েছিলো বিশ্বকে।
পর্তুগাল ( ১৯৬৬ বিশ্বকাপ–সেমিফাইনাল )
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণের সুযোগ পায় ‘ইউরোপের ব্রাজিল’ খ্যাত পর্তুগাল। পর্তুগালের প্রথম মহাতারকা ইউসেবিওর হাত ধরেই বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নেয় তারা। তবে প্রথম রাউন্ডেই সবাইকে চমকে দেয় পর্তুগীজরা। ব্রাজিল, হাঙ্গেরি আর বুলগেরিয়ার মতো টিমের কঠিন গ্রুপ থেকে সবাইকে টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় রোনালদোর পূর্বসূরিরা। প্রথম ম্যাচে জোসে অগাস্তোর জোড়া গোল আর তোরেসের গোলে হাঙ্গেরির মতো পরাশক্তিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দেয় পর্তুগাল। দ্বিতীয় ম্যাচে বুলগেরিয়াকেও হারায় ৩-০ গোলে। এই ম্যাচেই বিশ্বকাপে নিজের প্রথম গোলটি করেন ইউসেবিও। শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় মহাপরক্রমশালী ব্রাজিলের সাথে। সাবেক চ্যাম্পিয়ন পেলে, গ্যারিঞ্চা, টোস্টাওয়ের ব্রাজিলের সাথে জিততে অসম্ভব কিছুই করতে হতো পর্তুগালের। আর সেই দায়িত্ব একাই নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ইউসেবিও। ইউসেবিওয়ের জোড়া গোলে পেলের ব্রাজিলকে গ্রুপ পর্ব থেকেই নক আউট করে দেয় পর্তুগাল। ম্যাচটি তারা জিতে নেয় ৩-১ গোলে।
গ্রুপ পর্বের অসাধারণ সাফল্যে পর্তুগালকে নিয়ে আশাবাদীও হয়ে ওঠে তাদের সমর্থকরা। সেই আস্থার প্রতিদানও দেয় পর্তুগাল। পর্তুগাল বলতে ইউসেবিওই। উত্তর কোরিয়ার সাথে নখ কামড়ানো কোয়ার্টার ফাইনালে একাই চার গোল করে পর্তুগালকে শেষ চারে নিয়ে যান ইউসেবিও। ম্যাচটি তারা জিতে নেয় ৫-৩ গোলে। সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে ২-১ গোলে হেরে বাদ পড়ে স্বপ্নের পর্তুগাল। দলের হয়ে একমাত্র গোলটি করেন ইউসেবিও। স্বপ্নের মতো কাটানো টুর্নামেন্টে পর্তুগাল শেষ তুলির আঁচড়টা কাটে তৃতীয় স্থান নির্ধারিত ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-১ গোলে হারিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, এটিই বিশ্বকাপে পর্তুগালের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ফিগো, ডেকো, রোনালদোরা মিলেও ইউসেবিওর সেই পর্তুগালের সাফল্য ছুঁতে পারেননি।
সেই টুর্নামেন্টে ৯ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন কিংবদন্তি ইউসেবিও। যেখানে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল ছিলো হেলমুট হলারের, ৬ টি।
আয়ারল্যান্ড (১৯৯০ বিশ্বকাপ–কোয়ার্টার ফাইনাল)
১৯৯০ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের টিকেট কাটে রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ড। প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় আয়ারল্যান্ড। মজার ব্যাপার হলো পুরো টুর্নামেন্টে একটি ম্যাচও না জিতেই কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে ইংল্যান্ডের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
গ্রুপ পর্বে তারা পায় ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডের মতো বড় দল। সাথে মোকাবিলা করতে হয় মিশরকেও। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র করার পর তিনি নাম্বার ম্যাচে এসেও মিশরের সাথে গোলশূন্য ড্র করে বসে। কিন্তু নেদারল্যান্ডকে টপকে ইংল্যান্ডের পিছে থেকে গ্রুপ রানার্স আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রাখে আয়ারল্যান্ড।
দ্বিতীয় রাউন্ডে তারা মুখোমুখি হয় রোমানিয়ার সাথে। সেই ম্যাচটিও জিততে ব্যর্থ হয় আয়ারল্যান্ড। তবে টাইব্রেকার নামক ধাঁধা কাটিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে এসে রীতিমতো চমকে দেয় সবাইকে। গোলশূন্য ড্র হওয়া ম্যাচটিতে আয়ারল্যান্ড ৫-৪ গোলে টাইব্রেকারে পরাস্ত করে রোমানিয়াকে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক ইতালির কাছে ১-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় সবাইকে ভড়কে দেওয়া এই দলকে। বলা বাহুল্য, এটিই এখন পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ অর্জন হয়ে আছে।
ক্রোয়েশিয়া (১৯৯৮ বিশ্বকাপ–সেমিফাইনাল)
প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেই বাজিমাত করে বসে ডেভর সুকারের ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপপর্বে জ্যামাইকাকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শুভসূচনা করে ক্রোটরা। পরের ম্যাচে জাপানকে হারায় ১-০। সেই সুবাদে শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনার কাছে ১-০ গোলে হারলেও নক আউট পর্ব নিশ্চিত করতে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি ক্রোয়েশিয়াকে।
দ্বিতীয় রাউন্ডে রোমানিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে ক্রোটরা সবচেয়ে বড় চমক দেখায় কোয়ার্টার ফাইনালে। শক্তিশালী জার্মানিকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয় তারা। সুকার করেন একটি গোল। তবে স্বাগতিক ফ্রান্সের কাছে হেরে শেষ চারে স্বপ্নভঙ্গ হয় ক্রোয়েশিয়ার। প্রথমে সুকারের গোলে ১-০ তে এগিয়ে গেলেও, সবশেষে থুরামের জোড়া গোলে ২-১ এ হেরে সেমিফাইনালেই সমাপ্তি ঘটে ক্রোট জয়জয়কারের। তবে নেদারল্যান্ডকে তৃতীয় স্থান নির্ধারিত ম্যাচে ঠিকই ২-১ গোলে হারায় ক্রোয়েশিয়া। সেই তৃতীয় স্থান অর্জনই ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ মঞ্চে সবচেয়ে বড় সাফল্য। সেইসাথে ব্যক্তিগত সাফল্যও অর্জন করেন ডেভর সুকার। ৬ গোল করে টুর্নামেন্টের সোনালী বুট বগলদাবা করেন এই ক্রোট স্ট্রাইকার।
সেনেগাল (২০০২ বিশ্বকাপ–কোয়ার্টার ফাইনাল)
২০০২ সালের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় চমক ছিলো আফ্রিকার দেশ সেনেগালের বিশ্বকাপ যাত্রা। প্রথমবারের মতো খেলতে আসা এই দল মোটামুটি ডেথ অফ গ্রুপেই পড়ে। তাদের সাথে সঙ্গী ছিলো টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট ফ্রান্স, উরুগুয়ে আর ডেনমার্ক। প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব মঞ্চে তোলপাড় ফেলে দেয় আফ্রিকার এই দেশ। শিরোপার দাবিদার জিদান, অঁরি, ত্রেজেগের ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দেয় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে ডেনমার্কের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে তারা। শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের সাথে ৩-৩ গোলে ড্র করে উরুগুয়েকেও বিশ্বকাপ থেকে আউট করে দেয় চমক জাগানিয়া সেনেগাল।
দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইডেনের সাথে ২-১ গোলে জিতে গোল্ডেন গোলের কল্যাণে। প্রথম ৯০ মিনিটে ১-১ গোলে শেষ হওয়া ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গেলে সেখানে গোল্ডেন গোলে ২-১ এ ম্যাচটি জিতে নেয় তারা। তবে আয়োজক দল তুরস্কের কাছে হেরে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচটিতে এবার উল্টো তিক্ত স্বাদ নিতে হয় দলটিকে। গোল্ডেন গোলে ১-০ গোলে হেরে কোয়ার্টারেই থামে তাদের স্বপ্নের জয়যাত্রা। তবে দর্শকদের উদযাপন দিয়ে মাতিয়ে সবার মনে জায়গা করে নেয় সেনেগাল।
ইউক্রেন (২০০৬ বিশ্বকাপ–কোয়ার্টার ফাইনাল)
প্রথমবারের মত সেবার বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ইউক্রেন মোটামুটি সহজ গ্রুপেই পড়ে। স্পেনের সাথে গ্রুপে তারা মোকাবিলার সুযোগ পায় তিউনিসিয়া আর সৌদি আরবের। প্রথম ম্যাচেই স্পেনের সাথে ৪-০ গোলে হেরে বড় ধাক্কা খায় বিশ্ব মঞ্চে নতুন এই ইউরোপিয়ান দেশটি। তবে দমে না যাওয়া মানসিকতা থেকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরের দুটো ম্যাচ জিতে নেয় ইউক্রেন। সৌদি আরবকে ৪-০ আর তিউনিসিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে স্পেনের পেছন থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকেট কাটে তারা।
সেকেন্ড রাউন্ডে তারা মুখোমুখি হয় সুইজারল্যান্ডের সাথে। যে সুইজারল্যান্ড গ্রুপ পর্বে ফ্রান্সকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নক আউট পর্ব খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। টাইব্রেকারে ইউক্রেন জিতে যায় কোয়ার্টার ফাইনালের টিকেটও। ০-০ ড্র হওয়া ম্যাচটিতে ৩-০ গোলে টাইব্রেকারে তারা হারায় সুইসদের। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে সেবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালির কাছে নাকানি চুবানি খেয়ে দেশের পথ ধরতে হয় ইউক্রেনকে। ৩-০ গোলে হেরে বিদায় নেয় তারা। তবে প্রথম বিশ্বকাপেই এতদূর আসার জন্য বাহবা অর্জন করে নেয় ইউক্রেন।
মজার ব্যাপার হলো, এটিই এখন পর্যন্ত প্রথম ও শেষ বিশ্বকাপ হয়ে আছে ইউক্রেনের। ২০১০, ২০১৪ এর মত রাশিয়াতেও চূড়ান্ত পর্বের টিকেট কাটতে পারেনি ইউরোপিয়ান এই দেশটি।