দু’দল মিলিয়ে রান করেছে প্রায় চারশো, মোট তিনজন পেরিয়েছেন অর্ধশতক। অথচ ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় কি না নির্বাচিত হলেন একজন বোলার, তাও পরাজিত দলের! বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে।
এবার তবে বোলিং স্পেলটাকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক। ৪ ওভার, ২৫ রান, ৫ উইকেট। দলের বাকিরা যেখানে রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি কমপক্ষে আটের উপর, সেখানে তার ইকোনমি রেট ছয়ের কিছু বেশি। তার চাইতেও বড় কথা, বাকিরা নিতে পারেনি একটা উইকেটও, যেখানে এই বোলার একাই নিয়েছেন পাঁচটা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন ঘটনাই ঘটলো প্রথমবার। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর স্মার্ট স্ট্যাটস অনুযায়ী, এই স্পেলটা ছিল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ইতিহাসে সবচাইতে ‘ইমপ্যাক্টফুল ফাইফার’।
ম্যাচের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ঋদ্ধিমান সাহাকে ফিরিছেন ১৫৩ কি.মি./ঘন্টার ইয়র্কারে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দ্রুততম বোলারদের একজন লকি ফার্গুসনের সাথে একই ম্যাচে খেলে স্পিডগানে তুলেছেন তার থেকে বেশি গতি। ইতোমধ্যে বলাবলি শুরু হয়ে গেছে, ভারতের ইতিহাসের দ্রুততম পেসার বোধহয় তিনিই।
বলছি জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে উঠে আসা ফাস্ট বোলার উমরান মালিকের কথা, কয়েক বছর আগেও যিনি ক্রিকেট বলটাই হাতে নেননি।
ধারাভাষ্য কক্ষে শোনা যায় তাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। ম্যাথু হেইডেন তাকে তুলনা করেন ওয়াকার ইউনিসের সাথে; উমরান বল হাতে নেবার পর সাইমন ডুল তো বলেই বসেন,
“এই সেই মুহূর্ত, যার জন্যে বহু মানুষ সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের খেলা দেখতে বসেছেন।”
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই যুগে একমাত্রিক বোলার হয়ে টিকে থাকা ভীষণ কঠিন। বোলাররা, পেসাররা যেখানে টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন অস্ত্র, বৈচিত্র্য, স্লোয়ার বল রপ্ত করার চেষ্টায় মত্ত, সেখানে উমরান মালিকের আগমন তুমুল গতি নিয়ে। বেশিরভাগ ডেলিভারিই পেরোচ্ছে ১৪৫ কি.মি./ঘন্টার সীমানা, গতি কমিয়ে ব্যাটারদের বিভ্রান্ত করার বদলে বেছে নিয়েছেন গতি দিয়ে ব্যাটাদের পর্যুদস্ত করার পথ।
২৪ এপ্রিল পর্যন্ত লব্ধ পরিসংখ্যান বলছে, আইপিএলে তার করা ৯০.৮% ডেলিভারিই ছিল ১৪০ কি.মি./ ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন।
উঠে এসেছেন জম্মু-কাশ্মীর থেকে, যাকে কখনোই মুম্বাই বা দিল্লীর মতো ক্রিকেটারদের অভয়ারণ্য বলা যাবে না। এই রাজ্য থেকে ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন কেবল একজনই। সেই পারভেজ রসূলও এক ওয়ানডে আর এক টি-টোয়েন্টির বেশি খেলার সুযোগ পাননি। আইপিএলে তার আগে এই রাজ্য থেকে সুযোগ পেয়েছেন মাত্র তিনজন।
পথটা যে মোটেই সহজ ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়। বাবা আবদুল রশিদ গুজ্জার নগরের শহীদী চকে ফল বিক্রি করে দেখভাল করেন পাঁচ সদস্যের পরিবারকে। পড়াশোনায় বিশেষ ভালো ছিলেন না উমরান, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ইস্তফা দেন পড়াশোনায়। স্কুলে যতদিন পড়েছেন, বাসায় এসে ব্যাগটা রেখে আবার দৌঁড়ে চলে গেছেন ক্রিকেট খেলতে। কিন্তু আবদুল রশিদ কখনো ছেলেকে বাধা দেননি। মা আর বড় দু’বোনও তাই।
গলি ক্রিকেটের বাইরে যে জগৎ আছে, উমরান সেটায় পা রাখেন ১৭ বছর বয়সে। টেপ-টেনিস টুর্নামেন্টগুলো খেলা শুরু করেন জম্মুর বিভিন্ন জায়গায়। রাতে খেলা হতো বলে লোকও হতো বেশ, ছোট বাউন্ডারি বলে রানও হতো অনেক। কিন্তু তাদের ছাপিয়ে প্রায়শই নজরে আসতো উমরানের গতি। দলগুলোর মধ্যে তো রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যেত তাকে নিয়ে।
স্থানীয় এক ম্যাচে ২০১৭ সালে প্রথম হাতে নেন ক্রিকেট বল। সেই ম্যাচেই করলেন আগুনে এক বোলিং স্পেল, ব্যাটিং করতে এসে বড় বড় ক’টা ছক্কাও মারলেন।
নাম করতে খুব বেশি সময় লাগল না। ছোট ছোট চুল আর শক্তসমর্থ শরীর দেখে সবাই তাকে ডাকতে লাগলো ‘গজনী’ (‘গজনী’ সিনেমায় আমির খানের চরিত্র) নামে। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লো, “গজনী বাড়ে ছক্কে মারতা হ্যায়, গজনী বাড়ি তেজ বোলিং কারতা হ্যায়…” অর্থাৎ গজনী বড় বড় ছক্কা মারে, গজনী খুব জোরে বোলিং করে।
বন্ধুদের পরামর্শে একদিন গেলেন এমএ স্টেডিয়ামে, যেখানে স্থানীয় কোচ রণধীর সিং মানহাস ছেলেদের ক্রিকেট শেখান। সকালবেলায় খুব বেশি বোলার ছিল না, মানহাস উমরানকে দেখে বললেন বোলিং করতে।
এমন সময় জম্মু-কাশ্মীরের সিনিয়র ক্রিকেটার রাম দয়াল নেটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, উমরানের বোলিং দেখে দাঁড়িয়ে যান। বলেন,
“কে এই ছেলে? মনে হচ্ছে এর প্রতিভা আছে, ১৩৫-১৪০ [কি.মি./ঘন্টা] গতিতে বোলিং করছে।”
রণধীর সিং মানহাস উমরানের বোলিংয়ের কিছু জিনিস শুধরে দেন। গতি তো ছিলই, পাতলা টেনিস বলে জোরে বোলিং করতে করতে বাড়তি শক্তি প্রয়োগ করা তো আগেই শিখেছেন।
একই নেটে অনুশীলন করতেন আবদুল সামাদ, যিনি পরবর্তীতে হার্ডহিটার তকমা পান, জায়গা করে নেন আইপিএলের দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদে। সামাদকে আগে থেকেই চিনতেন উমরান, তবে বন্ধুত্বটা গাঢ় হওয়া শুরু করে ২০১৮ সাল থেকে।
জম্মু-কাশ্মীরের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ট্রায়াল দিতে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা, বলা হলো জেলা পর্যায়ে না খেললে ট্রায়ালে অংশ নেয়া যাবে না। জেলা পর্যায়ে তো উমরান খেলেননি, তবু পরদিন ট্রায়ালে হাজির হলেন। ভাবলেন, তারা কী করে জানবে আমি জেলা পর্যায়ে খেলেছি কি না? ভেবেই বল হাতে নিলেন। এক বল করেছেন কি করেননি, নির্বাচক এসে তাকে বললেন,
“তুমি আমাদের দলে থাকছ, শুধু নিজেকে প্রস্তুত রেখো।”
পরের বছর জম্মু-কাশ্মীরের অনূর্ধ্ব-২৩ দলে ট্রায়াল দিলেও উত্তীর্ণ হননি। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে তাই উমরানের ব্যাপারে কথা বলতে বন্ধু সামাদ দেখা করেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচের সাথে। ততদিনে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়ে গেছে সামাদের।
আইপিএলেও পা রাখেন সামাদের হাত ধরেই। ২০২০ এর আইপিএলে হায়দরাবাদ দলে ডাক পাওয়ার পর সামাদ ফ্র্যাঞ্চাইজিটিকে উমরানের কথা জানান। এরপর উমরান নিজের বোলিংয়ের কিছু ভিডিও সামাদকে পাঠালে জলদিই নেট বোলার হিসেবে উমরানের ডাক পড়ে হায়দরাবাদ শিবিরে।
এসেই দুরন্ত গতিতে ব্যাটারদের বিভ্রান্ত করা শুরু। কেদার যাদব জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি নেট বোলার নাকি দলের সঙ্গে আছ?” জনি বেয়ারস্টো নেটে তাকে খেলার সময় বললেন, “একটু গতিটা কমিয়ে বোলিং কর”৷ ইংরেজিটা বোঝেননি উমরান, গতি কমানোর তাই প্রশ্নই আসে না। এরপর কেউ এসে বলে দেন, “তোমাকে তো গতি কমাতে বলেছে, কিন্তু তুমি তো বেশি জোরে বোলিং করছ!”
পরের মৌসুমেও নেট বোলার হিসেবে সঙ্গী হলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় লেগের সময় ডাক পড়ল রাজ্যের ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন থেকে, সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফির ট্রায়ালের জন্য। কিন্তু উমরান যেতে পারলেন না, কারণ কোভিড আক্রান্ত নটরজনের বদলি হিসেবে হায়দরাবাদের মূল দলে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি।
প্লে-অফে ওঠার দৌড়ে হেরে যাবার পর উমরানকে সেরা একাদশে সুযোগ দেয় হায়দরাবাদ। এর আগে নিজের গতি সম্পর্কে ধারণা ছিল না উমরানের; ভাবতেন, “১৪০-১৪৫ হবে”।
কিন্তু প্রথম ওভারেই ছুঁড়লেন ১৫০ কি.মি./ঘন্টা এর গোলা। পরের তিন ওভারে ১৫০ কি.মি./ঘন্টা ছুঁলেন আরও দু’বার। পরের ম্যাচে ১৫২.৯৫ কি.মি./ঘন্টা গতি রেকর্ড করলেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিপক্ষে, মুগ্ধ করলেন বিরাট কোহলিকে। মিলে গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের নেট বোলার হওয়ার টিকিট।
তিন ম্যাচ খেলেই নিজের প্রতিভা প্রমাণ করা উমরানকে ২০২২ মৌসুমের জন্য রিটেইন করে হায়দরাবাদ।
কিন্তু এবারে শুরুটা হলো কঠিন। প্রথম ওভারেই জস বাটলারের সামনে পড়লেন তিনি, আর এই ইংলিশম্যান গতির ফায়দা উঠিয়ে এক ওভারেই আদায় করলেন ২৫ রান। পাওয়ারপ্লে’তে সেই এক ওভার আর ডেথে তিন, এছাড়া বাকি সব ওভার এবার উমরান করেছেন ৭ম থেকে ১৫তম ওভারের মধ্যে অর্থাৎ মিডল ওভারে। অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন তাকে ব্যবহার করছেন মিডল ওভার ‘এনফোর্সার’ হিসেবে এবং ফলও পাচ্ছেন। ১২ উইকেট নিয়েছেন মিডল ওভারেই, পেসারদের মধ্যে যা টুর্নামেন্টে এখন অবধি সর্বোচ্চ।
তবে মুদ্রার উল্টো পিঠটাও দেখেছেন। তার গতিকে কাজে লাগিয়ে উইকেটের পেছনে অনেক রান করেছেন ব্যাটাররা, অন্তত টুর্নামেন্টের শুরুর কয়েক ম্যাচে। ব্যাটাররা ব্যবহার করেছেন আপার কাটের মতো শট, এছাড়া ব্যাটের কানায় লেগেও রান কম হয়নি। প্রথম চার ম্যাচের তিনটিতেই রান দিয়েছেন প্রায় ওভারপ্রতি দশ করে। দলে জায়গাটা নড়বড়ে হতে শুরু করবে, ঠিক এমন সময়টাতেই সেরা ফর্মে ফিরলেন উমরান। প্রথম চার ম্যাচে তিন উইকেট নেয়া এই পেসার পরের চার ম্যাচে তুলে নেন ১২ উইকেট। পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে ২৮ রানে চার উইকেট নেয়ার পর এক ম্যাচ বাদেই গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে নেন ২৫ রানে পাঁচ উইকেট।
অ্যাকুরেসিটা বাড়িয়েছেন, যা মুগ্ধ করেছে স্বয়ং সুনীল গাভাস্কারকে। শেষ চার ম্যাচে ইকোনমিটা একবারও সাতের উপর ওঠেনি। কাজ করছেন ডেল স্টেইনের সঙ্গে, শিষ্যের উন্নতিতে মুগ্ধ সাবেক প্রোটিয়া তারকা। শ্রেয়াস আইয়ারের স্টাম্প উড়িয়ে দেবার পর ডাগআউটে লাফিয়ে উঠেছিলেন স্টেইন। শিষ্য উমরানও গুরুকে ট্রিবিউট দিয়েছেন বিখ্যাত ‘চেইন স সেলিব্রেশন’ অনুকরণ করে।
উমরান যখন পাঁচ উইকেট নিয়ে গুজরাটের ব্যাটিং লাইনআপ ধসিয়ে দিয়েছেন, বাবা আবদুল রশিদ তখনও শহীদী চকে ফল বিক্রি করছেন, ব্যস্ততার কারণে দেখতে পারছেন না ছেলের খেলা। হঠাৎই লোকজন এসে অভিনন্দন জানানো শুরু করল। আবদুল রশিদ বুঝলেন, তার ছেলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। রাতে ফোনে বললেন,
“উমরান, তুমি আমার নাম উজ্জ্বল করেছ।”
বড় বোন শেহনাজ উমরানের ম্যাচের সময় প্রার্থনায় ব্যস্ত থাকেন। সৃষ্টিকর্তা তার প্রার্থনা শুনলে হয়তো দ্রুতই ভারতের জার্সি গায়ে দেখা যাবে তাকে। ইনস্টাগ্রাম বায়োতে সেই চার বছর আগে লিখে রেখেছেন, “India soon”। এই দুরন্ত ফর্ম ধরে রাখলে সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়া এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।