গুগলে পারিসা তাব্রিজের অফিসিয়াল পদবী ‘সিকিউরিটি প্রিন্সেস’ বা ‘নিরাপত্তার রাজকুমারী’। বিশ্বাস না হলে গুগল করে দেখতে পারেন।
“’ইনফরমেশন সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ার’ শুনতেও যেমন রস-কষহীন মনে হয়, কাজটাও তেমনি ভয়ঙ্কর একঘেয়ে,”
মানব সম্পদ অধিদপ্তরের হয়ে কথা বলছিল সে। সারাদিন তাব্রিজ যা যা করে, দিনশেষে সেসব আবার ঠিক করতে হয় এই ডিপার্টমেন্টের।
মানে সকল নিয়োগকর্তার আইডি হ্যাক করাই তাব্রিজের কাজ, আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে যাকে ‘ব্যাড গাই ইন বেজমেন্ট স্টাইল’ বলে আর কী। জাপান ভ্রমণের আগে একরকম অবজ্ঞাসূচক অবস্থানেই ছিল সে। কিন্তু ওখানে যেতে হলে পেশাদার পরিচয় আবশ্যক জেনে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল তাব্রিজ।
“কিছু প্রতিষ্ঠান ভাড়াটে হ্যাকার নিয়ে এসেছিল,”
জানায় সে।
“কিন্তু আমি সবসময় অন্যদের চেয়ে একটু হলেও ভালো কিছু করার চেষ্টা করি। মনে হলো এই পদবীটাই কিউট হবে!”
কিউটই বটে, কিন্তু কে তার সম্পর্কে কী ভাবছে তাতে তাব্রিজের কিচ্ছু যায় আসে না। ছেলে পটানো স্বভাবের মেয়ে সে নয়, অনেকটা মাঝারি ঘরানার ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতি মেনে চলে সে, যার কারণে সবাইকে বন্ধু ভাবতেই ভালো লাগে তার। এই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব আর যোগ্যতার বলে কাজ পারিসা তাব্রিজ কাজ করছে সিলিকন ভ্যালির মতো প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। অন্যদের মতো নাম-যশের পেছনে না ছুটে নিজের কাজটাকেই গুরুত্বের সাথে করতে ভালোবাসে সে।
“এই ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই নিজেদের নামের আগে ‘সহ পরিচালক’ বা এরকম ভারিক্কি পদবী ব্যবহার করছেন। সবারই আছে ভুরি ভুরি সার্টিফিকেট,”
বেশ মজা করে বলছিল তাব্রিজ।
“ওসব আমার ধাতে সয় না। আমার নাম যদি কোড বানর নম্বর ৫০৭-ও হয়, কিন্তু কাজের ধরনে আকর্ষণীয় কিছু থাকে তবে যেকোনো সিনিয়র সহ পরিচালকের চেয়ে আপনার সাথে কথা বলতেই আমি বেশি আগ্রহী হবো।”
হ্যাকিং দুনিয়ায় তাব্রিজকে তুলনা করা যায় গ্লিন্ডার সাথে, যে ছিল ভালো এক ডাইনি। সব ধরনের ক্ষমতা, দক্ষতা, শক্তিশালী বাহিনী সাথে থাকা সত্ত্বেও সে কারো ক্ষতি করে না। একদল হ্যাকার ইঞ্জিনিয়ারের কর্তৃত্বে থাকা তাব্রিজকে বেতন দেয়া হয় অপরাধীদের মতো চিন্তাভাবনা করার জন্য, গুগল ক্রোমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার জন্য, অন্য কেউ হ্যাক করার আগে সর্বাধিক ব্যবহৃত ইন্টারনেট ব্রাউজারের কোন কোন অংশ হ্যাক করা করা যায় তা শনাক্ত করার জন্যই বেতন দেয়া তাকে। মাত্র ৩১ বছর বয়সে তাব্রিজ হয়ে উঠেছে হ্যাকিং সার্কেলের দুর্লভ এক নারী এবং হ্যাকিং সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দূর করতে অগ্রগামী এক তারকা।
তাকে বলা হয় গুগলের গোপন অস্ত্র। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠা পোলিশ-আমেরিকান-ইরানি মেয়েটি হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের একটি দল পরিচালনা করছে, যাদের প্রধান কাজ ‘ব্যাড গাই’ হিসেবে পরিচিত ব্ল্যাক হ্যাটদের মোকাবিলা করা। ব্ল্যাক হ্যাটরা ইন্টারনেট থেকে অন্যের তথ্য চুরি করে, ওয়েবসাইট বা আইডি হ্যাক করে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধন করে, তাদের ঠেকানোই হোয়াইট হ্যাটের কাজ। গুগল ক্রোমের প্রায় এক বিলিয়ন ব্যবহারকারীর তথ্য অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে কাজ করছে পারিসা তাব্রিজ আর তার দল।
মেয়েরা নাকি প্রযুক্তির খুঁটিনাটি বোঝে না- তথাকথিত এই ভুল ধারণাটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ৩০ সদস্যের একটি পুরুষ প্রধান দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাব্রিজ। তাব্রিজের দেখাদেখি বর্তমানে সিলিকন ভ্যালিতে আরও অনেক নারী সদস্য যোগদান করছে। এ বছর প্রথমবারের মতো গুগল তাদের কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সে অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি ১০০ জন কর্মীর মধ্যে ৩০ জন নারী সদস্য রয়েছে।
“আজ থেকে ৫০ বছর আগে নারীদের এমন বিপুল অংশগ্রহণ কেবল আইন আর চিকিৎসাক্ষেত্রেই দেখা যেত, এই পরিবর্তন শুভ বলেই মনে হচ্ছে,”
মতামত দেয় তাব্রিজ।
২০০৭ সালে গুগলে যোগ দেয়ার পর থেকে কখনো নেতিবাচক লৈঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গির হামলার শিকার হতে হয়নি তার। তবে গুগলের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরপরই কলেজের এক বন্ধু মুখের উপর বলেছিল,
“মনে রেখ, শুধুমাত্র মেয়ে বলেই চাকরিটা তোমাকে দিচ্ছে।”
তাব্রিজের মতে, যারা নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে, কেবলমাত্র তাদের মুখ থেকেই এমন বাক্য বের হওয়া সম্ভব। আগা-মাথা কালো পোশাকে মোড়ানো পারিসা তাব্রিজ ২০১২ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের ৩০ বছরের কম বয়সী শীর্ষ ক্ষমতাধারী ৩০ নারীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
প্রযুক্তির জগতে মেয়েদের পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ মেয়েরা নিজেরাই বলে মনে করে তাব্রিজ।
“এক বছর আগে একটি গবেষণায় ছেলে-মেয়েদের জিজ্ঞেস করা হয়, কম্পিউটার কোর্স না নেয়ার পেছনে তাদের কারণ কী। সেই গবেষণা থেকে উঠে আসে, মেয়েরা বি মাইনাস গ্রেড পাওয়ার পরেও ব্যক্তিগত ভীতির কারণে পরবর্তীতে আর কোনো মেয়েকে এই কোর্স নিতে উৎসাহিত করেনি। আর সেখানে ছেলেরা সি গ্রেড পেয়েও বিষয়টিকে মজার মনে করে কোর্স চালিয়ে গেছে। মজা আর ভয়ের অনুভূতিগুলো একান্ত ব্যক্তিগত। কোনো জিনিসকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলে সেখানে আপনি ভালো করতে বাধ্য,”
জানায় সে।
এই ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম এক হাই-প্রোফাইল নারী শেরিল স্যান্ডবার্গ। গুগলের এই সাবেক সহকারী পরিচালক বর্তমানে ফেসবুকের প্রধান অপারেটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তিনিও বললেন একই রকম এক গল্প।
“মেয়েরা যেন ধরা-বাঁধা নিয়ম মেনেই প্রতিনিয়ত নিজেদের অবমূল্যায়ন করছে। আপনি একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে সামনে রেখে তাদের জিপিএ অনুমান করতে বলুন, অধিকাংশ মানুষই বলবে ছেলেটার জিপিএ বেশি। সমাজের এই মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনা থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। মেয়েরা নিজেরাই তাদের মূল্য দিতে জানে না,”
আফসোস করলেন শেরিল।
ইরান প্রবাসী চিকিৎসক বাবা আর পোলিশ-আমেরিকান নার্স মায়ের সাথে শিকাগো শহরতলীতে বেড়ে ওঠে তাব্রিজ। নিঃসন্দেহে বাবা-মা দুজনই স্মার্ট ছিলেন, কিন্তু কম্পিউটারের ব্যাপারে তাদের একেবারে গণ্ডমূর্খ বললেও খুব একটা ভুল হবে না। ছোট দুই ভাইয়ের একমাত্র বড় বোন হিসেবে ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের উপর ছড়ি ঘোরানোর অভ্যাস তার।
“ভয় দেখানোর জন্য ভাইদের উপর ওদের পদ্ধতিই প্রয়োগ করতাম, ভিডিও গেমে হারিয়ে দিতাম, মারধোর করতাম,”
স্মৃতিচারণ করে তাব্রিজ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে বুঝতে পারে, গায়ের জোরে খুব একটা লাভ হবে না, ওদের সাথে টেক্কা দিতে হলে লাগবে নতুন অস্ত্র।
“শুরুতে বুঝে উঠতে পারছিলাম না ঠিক কী করা উচিত, স্কুলের ক্যারিয়ার টেস্টে অংশ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আমার সাথে কোন ধরনের চাকরি ভালো মানায়, পুলিশ অফিসারের কাজটাই পেলাম। সে সময় খুব হাসি পাচ্ছিলো, কিন্তু এখন মনে হয় এক রকম পুলিশের কাজই তো করছি!”
হাসতে হাসতে বলে নিরাপত্তার রাজকন্যা।
জীবনে কোনোদিন কম্পিউটার ছুঁয়ে না দেখা মেয়েটি ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বেছে নেয় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। জন ড্র্যাপারের, ক্যাপ্টেন ক্রাঞ্চ হিসেবেই যিনি সুপরিচিত, গল্প শুনে দারুণ উদ্দীপ্ত হয়েছিল সে। ড্র্যাপার ১৯৬০ এর দশকের শেষদিকে কাজ করতেন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর রাডার টেকনিশিয়ান হিসেবে। কাপ এন্ড ক্রাঞ্চ কর্ন ফ্লেক্সের প্যাকেটের ভেতরে একটি খেলনার সাহায্যে বিনা মূল্যে লং-ডিসটেন্স কল করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। এর মাধ্যমে এমন জোরে বাঁশি বেজে উঠতো যে তা তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ফোন নেটওয়ার্ককেও ছাপিয়ে গিয়েছিল!
তাব্রিজ প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়কে একজন সাধারণ অপরাধীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা রাখে। ‘ব্যাড গাই’দের মনের ভেতর থেকে ঘুরে এসে গুগল ইঞ্জিনিয়ারদের খামতি সম্পর্কে অবগত করে সেই ভুলগুলো সংশোধন করাই তাদের প্রধান কাজ। সেমিনারগুলোতে তাব্রিজ প্রথমেই সবাইকে পরামর্শ দেয় অপরাধ বন্ধ করার জন্য প্রথমে অপরাধীদের মতো করে চিন্তা করার মানসিকতা তৈরি করতে। গুগলের কাজের পরিবেশটাই এমন রোমাঞ্চকর, যে কেউ এখানে সম্পূর্ণ মেধা আর মনন প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে। যে ঘরে তাব্রিজদের কনফারেন্স হয়, সেটি সাত সিটের একটি বাইকের আকৃতিতে তৈরি। চিন্তাভাবনা করার জন্য রয়েছে ‘থিংকিং জোন’!
প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত গুগলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্যের নীতি হলো শত্রুদের কখনো চোখের আড়াল হতে দেয়া যাবে না। কাজেই গুগল ক্রোমের বাগ বা অন্য কোনো ভুলচুক ধরিয়ে দিতে পারলে হ্যাকারদের নগদ ৩০ হাজার ডলার পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে পারিস। সেই সূত্র ধরে ইতোমধ্যে প্রায় ৭০০ বাগের বিনিময়ে ১.২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে গুগলের। তাব্রিজের কথা হলো, এই ব্ল্যাক হ্যাটদের যদি হোয়াইট হ্যাটে পরিণত করা যায়, তাহলে তা অনলাইন দুনিয়ার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। তাব্রিজ তাদেরকে নিজের পাশে চায়, বিপরীতে নয়।
ডেফকোন নামক একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের ‘ভালোর জন্য হ্যাক’ শেখানো হচ্ছে। লাস ভেগাসের কম্পিউটার সায়েন্স কনফারেন্স আয়োজিত এই কর্মশালায় প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছে পারিসা তাব্রিজ। ট্রিনিটি নর্ডস্ট্রম নাম্নী ১৬ বছরের এক কিশোরী জানায়,
“পারিসা খুব ভালো রোল মডেল। আমিও তার মতো হ্যাকার হতে চাই।”
প্রতিদিন সবার অনলাইন জগতের নিরাপত্তার জন্য শত-সহস্র বিনিদ্র রজনী উৎসর্গ করা তাব্রিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে এমন সব অনুপ্রেরণাদায়ী মন্তব্য।