বর্তমানে ইউটিউব অনেকটাই ইন্টারনেটে ভিডিও দেখার প্রতিশব্দ। প্রতিদিন ৩ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী ৫০০ কোটিরও অধিক সংখ্যকবার এই সাইটটিতে ভিডিও দেখে। প্রত্যেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী ইউটিউবে ভিডিও খুঁজে তা দেখে থাকেন। ৭ কোটিরও বেশি সংখ্যক ভিডিও থাকা এই সাইটে প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা নতুন কিছু জানার জন্য, বিনোদনের জন্য, কেউ বা নিছকই সময় কাটানোর জন্য একবার হলেও ঢুঁ মেরে থাকেন। ইউটিউবে আপলোড করা কন্টেন্টের এত ভিন্নতা রয়েছে যে, এর সংক্ষিপ্ত বিষয়ভিত্তিক তালিকা দেওয়া কঠিন।
যেকোনো বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করা মানেই এখন ইউটিউবে সে সময়ের একটা অংশ দেওয়া। একাডেমিক বিষয়সহ যেকোনো ধরনের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ শেখার ক্ষেত্রেও ইউটিউব এখন ব্যক্তিগত শিক্ষকের ভূমিকা নিষ্ঠার সাথে পালন করছে। পরিস্থিতি বর্তমানে এমন দাঁড়িয়েছে যে “যার কেউ নেই, তার ইউটিউব আছে!“
এই লেখায় ইউটিউবে থাকা অসংখ্য শিক্ষামূলক চ্যানেলগুলোর মধ্যে যেগুলো প্রতিনিয়ত মানসম্পন্ন কন্টেন্ট প্রকাশ করছে, সেই সাথে কন্টেন্টের বৈচিত্র্য ও সংখ্যার প্রাচুর্য এবং আলোচিত বিষয়ের ওপর ব্যতিক্রমী; আকর্ষণীয় উপস্থাপনার ফলে উক্ত বিষয় নিয়ে ভালো ধারণা দিতে সক্ষম- এসব ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়ে সাতটি শিক্ষা-সংক্রান্ত ইউটিউব চ্যানেল সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।
১. টেড-এড (Ted-Ed)
“Ideas worth spreading”– এই স্লোগানকে সামনে রেখে টেকনোলজি, এন্টারটেইনমেন্ট এবং ডিজাইন এই তিন শব্দের আদ্যক্ষর দিয়ে গঠিত টেড এর একটি বিশেষ কার্যক্রম টেড-এড, যেটির স্লোগান “Lessons worth sharing”। টেড-এড বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি সার্বিক ধারণা দেওয়ার মতো করে একেকটি অ্যানিমেটেড ভিডিও তৈরি করে থাকে, যার নেপথ্যে একটি কন্ঠ ভিডিওটির বিষয় সম্পর্কিত তথ্যাবলী উপস্থাপন করে।
বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, জীবনী, বৈচিত্র্যমূলক প্রাকৃতিক কার্যকারণ ইত্যাদির এক বিশাল সমাহার রয়েছে এই চ্যানেলটিতে। অ্যানিমেটর এবং শিক্ষক- দু’পক্ষের যৌথ কার্যক্রমের দ্বারা টেড-এড ভিডিওগুলো তৈরি হয়ে থাকে। বর্তমানে এ কার্যক্রমের উপদেষ্টা হিসেবে খান একাডেমির সালমান খান, বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মেলিন্ডা গেটস অন্যতম সদস্য। ২০১১ সালে শুরু হওয়া চ্যানেলটির সব ভিডিও মোট ১০,৮৪,১৬,৮৬৬ বার দেখা হয়েছে।
২. সাই-শো (SciShow)
এই চ্যানেলটি বিজ্ঞানে আগ্রহীদের জন্য একটি সোনার খনি। ‘কী’, ‘কেন’, ‘কীভাবে’ দিয়ে যেসব প্রশ্ন আমাদের মনে হুটহাট উঁকি দিয়ে যায়- সেগুলোর বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ পাওয়া যাবে এই চ্যানেলটিতে। হ্যাংক গ্রিন এবং মাইকেল অ্যারান্ডার প্রাঞ্জল ও সরাসরি উপস্থাপনা এবং সেইসাথে আলোচিত বিষয়ের প্রয়োজনীয় দৃশ্যায়ন দর্শককে সম্পৃক্ত করে সহজেই। “কেন আমরা এখনো ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারিনি” থেকে শুরু করে “বেকিং পাউডার আর বেকিং সোডার পার্থক্য কী”– নিয়ে পর্যন্ত বিচিত্র বিষয়ের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা রয়েছে এই চ্যানেলে।
বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহীদের উঁকি দেওয়া অনেক প্রশ্নেরই সমাধান পাওয়া যাবে এই চ্যানেলটিতে। ২০১৭ সালে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষামূলক অনলাইন চ্যানেল ক্যাটাগরিতে পিপলস্ ভয়েস অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় সাই-শো।
৩. ক্র্যাশ কোর্স (Crash Course)
কেউ এই তালিকার অন্তত একটি চ্যানেল ঘুরে আসতে চাইলে সেটি হবে ক্র্যাশ কোর্স চ্যানেলটি। ‘ক্র্যাশ কোর্স’ টার্মটি দিয়ে মূলত অল্প সময়ে কোনো একটি বিষয়ের সার্বিক দিকগুলো নিয়ে একটি প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য অধ্যয়ন বোঝায়। এই চ্যানেলটিতেও ব্যাপারটি সেরকমই রাখা হয়েছে।
একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তার বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে বেশ কতগুলো ভিডিও তৈরি করা হয়ে থাকে। হ্যাঙ্ক গ্রিন ও জন গ্রিনের উপস্থাপনায় ক্র্যাশ কোর্স কার্যক্রম শুরু করলেও পরবর্তীতে বিষয়ের বিভিন্নতায় উক্ত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারাও ভিডিওগুলো উপস্থাপন করা হয়। একাডেমিক যে কোনো বিষয় নিয়ে এই চ্যানেলটির প্লে-লিস্ট দেখলে জ্ঞানপিপাসু যে কেউ আনন্দে আটখানা হয়ে যাবেন। কী নেই এতে? বিশ্বের ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, কম্পিউটার-প্রকৌশল, পরিসংখ্যান, সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য, অ্যাস্ট্রোনমি, অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, চলচ্চিত্র, থিয়েটার, ওয়ার্ল্ড মিথোলজি প্রভৃতি নিয়ে মানবসভ্যতার জ্ঞানের এক মহা সমারোহ পেয়ে যাওয়া সম্ভব এই চ্যানেলটিতে। ক্র্যাশ-কোর্সের একেকটি সিরিজ মূলত বিষয়ের বিস্তৃতির ওপর নির্ভর করে বেশ কিছু সংখ্যক ভিডিও দিয়ে বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে একটি সার্বিক ধারণা দিয়ে থাকে। যেখানে বেশিরভাগ ভিডিওর দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মতো হয়ে থাকে।
৪. দ্য স্কুল অব লাইফ (The School of Life)
আবেগ, দুশ্চিন্তা, পেশা, সম্পর্ক- এ ধরনের ব্যাপারগুলো নিয়ে যে কোনো সমস্যায় যে ক্ষমতাটি আমাদের বোঝাপড়ায় সাহায্য করে, তা হলো ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা আবেগীয় বিচক্ষণতা। প্রত্যেক সপ্তাহের মঙ্গল ও বৃহঃস্পতিবারে দুটি করে ভিডিও প্রকাশ করে এই চ্যানেলটি, যাতে এমন সব বিষয়বস্তু থাকে, যা শেখানো হয় না তথাকথিত কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। মানসিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার জন্য আমাদের যে ধরনের জ্ঞান প্রয়োজন, তা বেশিরভাগই আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ হয়ে থাকে। দ্য স্কুল অব লাইফ এ ব্যাপারে মনে করে এই বিষয়গুলো শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমেই নয়, সেইসাথে এ ধরনের আলোচনার মাধ্যমেও শেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। “আমি কে?” কিংবা “কীভাবে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়” এমনকি “বেশি ‘সুন্দর’ হবার কী সমস্যা রয়েছে”, এ ধরনের বিভিন্ন মানসিক দিক সম্পর্কিত অনুসন্ধানী ও দিকনির্দেশনামূলক কন্টেন্ট তৈরি করে থাকে এই চ্যানেলটি।
৫. কুর্টস্গাজাট-ইন আ নাটশেল (Kurzgesagt – In a Nutshell)
জামার্ন শব্দ ‘কুর্টস্গাজাট’ অর্থ হলো সংক্ষেপে বলা। আমাদের মহাজগৎ এবং তাতে আমাদের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ও চিন্তা-ভাবনা নিয়ে, যেমন: জীবন কী? ভিনগ্রহের প্রাণী আছে কি? কী হবে যদি আপনি একটি কৃষ্ণ-গহ্ববরে পা মাড়ান? এমন সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে চ্যানেলটি ভিডিও তৈরি করে থাকে। উপস্থাপিত বিষয় নিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান চ্যানেলটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এজন্য মাসে দুইটি ভিডিওর বেশি উপস্থাপিত হয় না চ্যানেলটিতে।
৬. মিনিট ফিজিক্স (MinutePhysics)
মিনিটেই পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয় সহজ করে বুঝতে এই চ্যানেলের জুড়ি নেই। হেনরি রাইখের এই চ্যানেলটিতে বিষয় উপস্থাপন করা হয়ে থাকে টাইম-ল্যাপ্স ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে, যেটির বেশিরভাগ ভিডিও’র দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে মাত্র কয়েক মিনিট। প্রায় ৪৫ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার থাকা এ চ্যানেলটিতে “স্থানান্তর অসম্ভব বস্তুর সাথে প্রচন্ড শক্তির সংঘর্ষ হলে কী হবে”, “গোলাপী কোনো রঙ নয়” এমন চমকপ্রদ ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা ছাড়াও রয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, হিগস-বোসন, স্পেশাল রিলেটিভি নিয়ে একগুচ্ছ ভিডিও। সুপরিচিত জ্যোতিপদার্থর্বিদ নিল ডিগ্রাস টাইসনের লেখা ও উপস্থাপনায় ‘আ ব্রিফ হিস্টোরি অব এভ্রিথিং’-নামে সাড়ে আট মিনিটের চমৎকার একটি ভিডিও আছে এই চ্যানেলে।
এছাড়াও, হেনরি রাইখেরই আরেকটি চ্যানেল রয়েছে ‘মিনিট আর্থ (MinuteEarth)‘- নামে, যাতে একই ফরম্যাটে আমাদের আবাসস্থল; পৃথিবী বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা রয়েছে। বিবর্তনবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন, মানুষ এবং প্রাণির আচরণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষক নিয়ে কন্টেন্ট পাওয়া যাবে এ চ্যানেলটিতে।
৭. খান একাডেমি (Khan Academy)
এই চ্যানেলটি তালিকায় না থাকলে তালিকাটি অসম্পূর্ণই থেকে যেতো, যদিও ইন্টারনেটকে একাডেমিক কাজে ব্যবহার করা কোনো ব্যবহারকারীর কাছেই খান একাডেমির নাম আর অজানা নয়। খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও সালমান খান প্রধানত ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমেই ২০০৬ সালে খান একাডেমির কার্যক্রম শুরু করে। এই ইউটিউব চ্যানেলটি বিশ্বে জুড়ে বিশ্বমানের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি ভিডিও-সমৃদ্ধ খান একাডেমির ইউটিউব চ্যানেলটি জ্ঞানার্জনের জন্য এক বিশাল ভাণ্ডার। গণিত, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, কলা ও মানবিক, অর্থনীতি বিষয়গুলোর বিভিন্ন টপিক নিয়ে প্রচুর ভিডিও কন্টেন্ট রয়েছে। এছাড়াও খান একাডেমি মেডিসিন (Khanacademymedicine) চ্যানেলটিতে পাওয়া যাবে শারীরবিদ্যা-সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও কন্টেন্ট।
শেষ করছি পাঠকদের জন্য চমৎকার একটি ভিডিও’র উল্লেখ করে। ইউটিউবে বিভিন্ন বিষয় নিয়েই ভিডিও রয়েছে কিন্তু এই ভিডিওটির বিষয়ই হচ্ছে এক কথায় সবকিছু! বিল উর্টজ ‘হিস্টোরী অফ দ্য এন্টায়ার ওয়ার্ল্ড, আই গেস’-এ ১৯ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে বিগ ব্যাং থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাসের পাতার সকল কিছুই উল্লেখ করে তৈরি করে ফেলেছেন এই ভিডিওটি।
বিশাল সময় অতিবাহিত করে বর্তমানে আসা পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, এত সহজে তাতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া হয়তো ইউটিউব আছে বলেই সম্ভব!
Feature image: tutorbright.com