দিনের আলো নিভে এসেছে প্রায়, পাখির কোলাহলে পূর্ণ গোধূলি বেলায় কেমন উদাস উদাস ভাব হয়। আধো আলো আধো অন্ধকারে ঝিরঝির বাতাসে গাছগাছালি ঘেরা বিশাল প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হতে থাকে, আমার মতন এ উঠোনে সাঁঝের আকাশ দেখে কবিগুরু কি ভেবেছিলেন যখন তিনি এখানে এসেছিলেন। শুধু যে কবিগুরুর পায়ের ছাপ পড়েছে এখানে তা-ই নয়, বহু বিখ্যাত ব্যক্তি এসেছেন এই ক্যাসেলে সময় কাটাতে, বহু জাঁকজমক আর আভিজাত্যের সাক্ষী এই ক্যাসেল। বলছি ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আলেকজান্ডার ক্যাসেলের কথা।
ময়মনসিংহ শহরের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত হলেও ক্যাসেলটির আশেপাশে এখনো যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মোড়ানো রয়েছে তা রীতিমতো দেখবার মতো। ময়মনসিংহের কোর্ট-কাচারি এলাকাতে প্রায় ২৭ একর জমির উপর নির্মিত এই ভবনটি। মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার ক্যাসেল নির্মাণ সম্পন্ন করেন। সূর্যকান্ত তার বাগানবাড়ি শশী লজে নির্মাণ করেন এই কুঠিটি।
ঠিক কীভাবে এর নাম আলেকজান্ডার ক্যাসেল হলো সে নিয়ে দুটি কাহিনী প্রচলিত আছে। এক দলের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক সপ্তম এডওয়ার্ড ও তার স্ত্রী আলেকজান্দ্রার নাম অনুসারে ক্যাসেলের নামকরণ করা হয়েছিল আলেকজান্ডার ক্যাসেল। অপর পক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, সেই সময়কার ময়মনসিংহ জেলা কালেক্টর এন. এস. আলেকজান্দ্রার নামানুসারে ভবনটির নামকরণ করা হয়েছিল আলেকজান্ডার ক্যাসেল।
তবে নামকরণ যার উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকুক না কেন, ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের কার্পণ্য করেননি মহারাজ সেটা নির্মাণ খরচ থেকেই আন্দাজ করা যায়। সে সময় আনুমানিক ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল এই রাজকীয় ভবনটি। লোকমুখে শোনা যায় সুদূর চীন দেশ থেকে কারিগর এনে এই ভবন তৈরি করেছিলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য।
ইট পাথরের মিশেলে তৈরি আর দশটা সাধারণ বাড়ি থেকে অনেকটাই আলাদা এই ক্যাসেলের নির্মাণশৈলী। এমনকি সে সময়ে নির্মিত আর সব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা থেকেও এর বানানোর ধরন ছিল ভিন্ন ধরনের। প্রচুর পরিমাণে লোহা আর কাঠ ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছিল ভবনটি যে কারণে আলেকজান্ডার ক্যাসেল লোহার কুঠি নামেও অনেকের কাছে পরিচিত।
পুরো প্রাসাদটি বিশাল একটি স্তম্ভমূলের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। সম্ভবত বন্যার সময় ব্রহ্মপুত্র নদীর জলস্রোত থেকে রক্ষা করার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। চারপাশে মোটা লোহার থাম আর লোহার ফ্রেমে আটা বিশাল এই আলেকজান্ডার ক্যাসেল যে জলস্রোতকে ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে তা এর এখনো টিকে থাকা অস্তিত্বই প্রমাণ করে।
উপর থেকে নেমে আসা ঢালু টিনের চালা দেখতে অনেকটা যেন ইউরোপীয় পুরনো ধাঁচের বাড়ির মতো। বহু ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে তবেই প্রবেশ পথের দেখা মেলে। নিচতলায় মোট ঘর রয়েছে চৌদ্দটি। একতলা আর দোতলার মাঝের অংশটাও চমৎকারভাবে কাঠের খড়খড়ি দিয়ে মোড়ানো। পুরো ভবনটি এক সময় ঐতিহ্যবাহী হস্ত বা কারু শিল্পকর্মের অসাধারণ নিদর্শন ছিল। সময়ের ধারায় সেই সব শিল্পকর্ম অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেলেও, যে টুকু কাজ এখনো অবশিষ্ট আছে তাই বেড়াতে আসা দর্শকদের মুগ্ধ করে।
নিচতলা থেকে লোহার মোড়ানো রাজকীয় সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া যায় ক্যাসেলের দ্বিতীয় তলায়। সেখানে রয়েছে উঁচু ছাদওয়ালা সাতটি শোবার ঘর। ঘরগুলোর সামনে থাকা প্যাসেজ যেখানে যুক্ত হয়েছে, সেখানে রয়েছে টিনের ছাদ দেয়া বারান্দা আর তারপর ঝুল বারান্দা। অযত্নে অবহেলায় সেখানে আজ আগাছা জন্মালেও এককালে যে সেই বারান্দা বহু নামিদামি ব্যক্তির চায়ের আসর হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাহ্যিক চাকচিক্যের সাথে ভেতরের পরিবেশ মনোরম রাখার ব্যবস্থাও করেছিলেন জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য। প্রাকৃতিকভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করতে ক্যাসেলের প্রতিটি ঘরের সিলিংয়ে অভ্র ও চুমকি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ঘরগুলো সাজানো ছিলো দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম আর রুচিশীল দামি আসবাব দিয়ে।
রাজকীয় এই প্রাসাদের মূল ভবনই যে এর একমাত্র আকর্ষণ ছিল তা কিন্তু নয়। ক্যাসেলের বাইরের অংশ সাজানোর ক্ষেত্রেও নিজের মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছিলেন মুক্তাগাছার জমিদার। কুঠিতে ঢোকার মূল ফটকের দুই ধারে রয়েছে দুটি অসাধারণ গ্রিক মূর্তি। বয়সের ভারে যদিও সে মূর্তিগুলোর অবস্থা এখন শোচনীয়, কিন্তু এক সময় এই মূর্তিগুলো যে ক্যাসেলের রাজসিক ভাবকে প্রতিফলিত করতো সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মূল এই দুই মূর্তি ছাড়াও ভবনের চারপাশে আরো বেশ কিছু নারী মূর্তি ছিলো বলে শোনা যায়, কিন্তু কালের ছোবলে সেগুলো কোথায় হারিয়ে গিয়েছে তা জানা সম্ভব হয় না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ক্যাসেলটিকে ঘিরে ছিল সুসজ্জিত একটি বাগান। যেখানে ছিলো দুর্লভ সব গাছ, লতাগুল্ম, নানান জাতের পশু-পাখি, সরীসৃপ পালনের ঘর আর জল-ফোয়ারা। বাকি সব সময়ের সাথে হারিয়ে গেলেও অতীতের জৌলুস চিহ্ন বহন করা ফোয়ারা দুটি এখনো চোখে পড়ে বাগানের সীমানার ভেতরেই। এখানেই শেষ হয়। সূর্যকান্ত আচার্য নির্মিত এই ক্যাসেলের জন্যে খনন করা হয়েছিলো দীর্ঘ কৃত্রিম হ্রদ বা লেক। সময়ের প্রভাবে সেই হ্রদ যদিও এখন কচুরিপানায় ঢাকা ছোট জলাশয় বলে ভুল হয়, তবে ইতিহাস অনুযায়ী এখানেই ছিলো নয়নাভিরাম কৃত্রিম জলাশয়।
আলেকজান্ডার ক্যাসেল মূলত মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্যের অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সে সময় বহু বিখ্যাত ব্যক্তি এখানে সময় কাটিতে এসেছিলেন। ১৯২৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসে চারদিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধিও সেই একই বছর আলেকজান্ডার ক্যাসেলে এসে সময় কাটিয়ে যান।
তাদের বাইরে ভারতের সে সময়কার ইংরেজ সেনাপতি জর্জ হোয়াইট, ভারতের বড় লাট লর্ড কার্জন, ফ্রান্সিস ম্যালকম, রাশিয়ার যুবরাজ ডিউক মরিস, আয়ারল্যান্ডের লর্ড উইসবোর্ন, স্পেনের ডিউক অব পেনাবেন্ডা, মিশরের যুবরাজ ইউসুফ কামাল পাশা, শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, স্যার সলিমুল্লাহ সহ অনেকে আলেকজান্ডার ক্যাসেলে এসেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালে আলেকজান্ডার ক্যাসেলকে ঘিরে নির্মিত হয় টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং প্রথমদিকে প্রাসাদ ভবনটিকেই ক্লাস নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে কলেজের জন্য আরো ভবন নির্মিত হলে পর্যায়ক্রমে একে শিক্ষকদের থাকার স্থান এবং সর্বশেষ কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
সংবাদপত্রের সুত্র অনুসারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ২০১৯ সালে আলেকজান্ডার ক্যাসেলটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ভবনটি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বুঝে নেয়ার কাজ এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা যায়।
অনেকটা সময় মানুষকে মুগ্ধ করতে করতে কিছুটা ক্লান্ত আর বিষণ্ণ মনে হলো হাজারো না বলা ইতিহাস মনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটিকে। দিনের আলো ততোক্ষণে পুরোপুরি নিভে গেছে। আরো কিছুক্ষণ অন্ধকারে ক্যাসেলের দিকে তাকিয়ে থেকে ফেয়ার জন্যে পা বাড়ালাম। মাথার ভেতর তখনও বাজতে থাকলো, রবীন্দ্রনাথ এখানে ‘সত্যি’ এসেছিলেন।