অভিবাসীদের নিয়ে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ইউরোপের দেশগুলোর জন্য একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কীভাবে এই হাজার হাজার মানুষের জন্য আবাসন এবং মৌলিক চাহিদার যোগান দেয়া হবে?
এ বছর ব্রাসেলসে European Union Leader’s Summit অনুষ্ঠিত হচ্ছে যেখান ইউরোপের স্কল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা অভিবাসননীতি নিয়ে একটি বাস্তব সমাধানে আসতে চাচ্ছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, এই সামিট হয়তো অভিবাসন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগেই সমাপ্তি ঘোষণা করবে।
ইতালি, যেখান দিয়ে হাজার হাজার শরণার্থীদের প্রবেশপথ, বিশেষ করে আফ্রিকা থেকে যারা আসে তাদের জন্য, তারা বলেছে যদি কোনো সমাধান এই সামিটে না করা হয় তাহলে তারা অভিবাসীদের নিয়ে যেকোনো আলোচনায় ভেটো দিবে। গত কিছুদিন ধরে এটা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে এবং ইতালির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে অভিবাসীদের কিছু অংশ অবশ্যই ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোকেও নিতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপে আছেন জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মারকেল। জার্মানির অভ্যন্তরীন মন্ত্রী হরস্ট সিহফারের থেকে জানা যায়, যদি এবার অভিবাসন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে না আসা হয় তাহলে তারা তাদের দেশের সীমান্তে আসা অভিবাসীদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিবে, জার্মানিতে তাদের ঢুকতে দেয়া হবে না। ইতালি ইতোমধ্যে তাদের দেশের অভিবাসীদের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে।
শুধুমাত্র আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীরাই নয়। অনেক রিফিউজি বা শরণার্থীরাও এসে ঘাঁটি করছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে সিরিয়া যুদ্ধের পর সেখানে বসবাস না করতে পেরে আতঙ্কে সেখানকার প্রচুর মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি জমাচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বলা হচ্ছে, ২০১৫ সাল নাগাদ অভিবাসীদের নিয়ে কোনো সংকট ছিল না। সেসময় প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার অভিবাসী গ্রিক দ্বীপগুলোতে এসে আশ্রয় নিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে এসব মানুষ আরও এগিয়ে এসে অনৈতিকভাবে বসবাস করার জন্য ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিভিন্নভাবে ঢুকে অবৈধভাবে থাকতে শুরু করেছে। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয়।
এতদিন পর্যন্ত ইতালি এবং গ্রিস এই দুই দেশ সবচেয়ে বেশি অভিবাসী আশ্রয় দিয়েছে। তাদের দাবি, এখন অন্যান্য দেশের পালা। তাদেরকেও এসব মানুষদের কিছু অংশ ভাগাভাগি করে নিতে হবে। নাহলে হাজার হাজার শরণার্থী ও অভিবাসী সামাল দিতে শুধুমাত্র দুটি দেশের জন্য চাপ হয়ে যাচ্ছে।
এই মাসে অভিবাসীদের বিষয় আরও জটিল হয়ে পড়ে যখন অভিবাসী পুনরুদ্ধার জাহাজগুলোকে ইতালির বন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়। আবার জার্মানির জাহাজ লাইফলাইনও একই কাজের জন্য নিযুক্ত। কিন্তু ইউরোপিয়ান কিছু দেশের মধ্যে কূটনীতিগত সমস্যার কারণে মাল্টা ছাড়া অন্য কোথাও এই জাহাজ ঘাঁটি করতে পারছিলো না। এই দুই দেশ কিছু অভিবাসী নিতে রাজি হয়েছে। অন্যদিকে মাল্টার পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয় যে, নরওয়ে জার্মান জাহাজ লাইফলাইনে উদ্ধার করা কিছু সংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে।
কিন্তু কিছু কিছু দেশের ভেতর সমস্যার সমাধান হলেও পুরো চিত্রের দিকে যদি তাকানো হয় তাহলে দেখা যাবে ব্যাপারটি আস্তে আস্তে গুরুতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভেতর ধীরে ধীরে ভঙ্গুরতার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এই ফাটল ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে, বিশেষ করে এই অভিবাসীদের ভাগাভাগি করে আশ্রয় দেয়া নিয়ে। গত কিছুদিন ধরে ইতালির নতুন সরকার গঠন এবং তাদের অভিবাসী গ্রহণ না করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কিন্তু অন্যদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা যে সামিটে বসেছেন সেটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না। অথচ সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সামিটই একমাত্র জায়গা যেখানে সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের মধ্যে সরাসরি কথা বলে একটি সমঝোতায় আসতে পারবেন।
অভিবাসনের কারণে উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়েছে। দুই অঞ্চল একে অপরের বিপক্ষে চলে গিয়েছে। ইটালি এবং গ্রিস অনেক আগে থেকেই প্রায় একাই অভিবাসীদের সামাল দিচ্ছে। ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশগুলো দক্ষিণের দেশগুলোর প্রতি অভিযোগ এনেছে যে তারা ভূমধ্যসাগরে ঠিকমতো নিরাপত্তা দিচ্ছে না। তারা ইচ্ছা করলে ভূমধ্যসাগর এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে আরও কড়াভাবে নিরাপত্তা দিতে পারতো। শুধু উত্তর-দক্ষিণ অঞ্চল নয়, ইউরোপের পূর্ব-পশ্চিমভাগও অভিবাসন সমস্যার ভেতর পড়ে যাচ্ছে। একটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর ভেতর ঐক্য নেই। যখন সমস্যা সমাধানের জন্য সবাইকে একত্র করার চেষ্টা করা হয় কিংবা যখন কোনো সমস্যার কিছু অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার প্রস্তাব করা হয় তখন তাদের মধ্যে কোনো সংগতি এবং সংহতি লক্ষ্য করা যায় না। ইতালি এবং জার্মানি যখন অভিবাসী কোটার কথা প্রস্তাব করে তখন ইউরোপের অন্যান্য দেশ পিঠ দেখিয়ে চলে যায়।
এঞ্জেলা মারকেল নিজে এই সমাবেশে গিয়ে ইউনিয়নকে প্রস্তাব দেয় যেন অন্যান্য দেশ অভিবাসীদের গ্রহণ করে। নাহলে অবৈধভাবে অভিবাসীদের প্রবেশ বাড়তেই থাকবে। কিন্তু অন্যান্য দেশ তাদের নিজস্ব নীতিতে অটল যে, তারা কোনো অভিবাসী গ্রহণ করবে না। যেমন- অস্ট্রিয়ার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেয়া। তারা Keep Them Out প্রথা অবলম্বন করেছে।
অভিবাসীদের নিয়ে এঞ্জেলা মারকেল প্রথমদিকে অনেক বেশি সদয়ভাব দেখিয়েছেন এবং তাদের জন্য নিজ দেশের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তার নিজ দেশের মন্ত্রীরাই তাকে সাবধান করছে যে, এরকম সদয়ভাব বজায় থাকলে দিন দিন এই সমস্যা বাড়তেই থাকবে। তার অভিবাসীদের নিয়ে এরকম নীতিতে দাঁড়ানোর ফলে নিজের দেশের মধ্যেও সমালোচিত হতে হচ্ছে মারকেলকে।
এই মাসের ২৬ তারিখের হিসাব অনুযায়ী ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে স্পেনে ১৭,০৪৫ জন, ইতালিতে ১৬,৩২৬ জন, গ্রিসে ১৩,১২০ জন এবং সাইপ্রাসে ৭৩ জন অভিবাসীদের আগমন ঘটেছে।
তবে কিছু সমাধান আছে যেটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হয়তো গ্রহণ করতে পারে। যেমন- সব অভিবাসী এবং শরণার্থীদের তারা না-ও নিতে পারে। কিছু মানুষকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে যারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। সেজন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে কোথাও অনেকগুলো Disembarkation centre তৈরি করা হবে। অভিবাসন নিয়ম অনুযায়ী যেসব অভিবাসী এবং শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া যাবে শুধু তাদেরকেই ইউরোপের ভিতর ঢুকতে দেয়া হবে, না হলে নয়।
তবে ইউরোপে ঢুকতে বাঁধা দেয়ার জন্য ইউরোপের বর্ডারে ইইউ নিরাপত্তাকর্মীদের দরকার পড়বে। শুধুমাত্র ইউনিয়ন নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে সীমান্ত পাহারায় জোর দিতে পারে, বিশেষ করে ইউরোপের দক্ষিণ দিকের কয়েক হাজার মাইল সমুদ্র উপকূলে এই নিরাপত্তা আরও বেশি জোরদার করা প্রয়োজন। সেজন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আরও কঠোর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে অভিবাসননীতি নিয়ে জলদি যদি কোনো সিদ্ধান্তে না আসা যায় তাহলে এখান থেকেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শেষের শুরু, সেটা ধরে নেয়া যেতে পারে।
Featured Image Source: The Brock Press