পৃথিবীবাসী আজ শঙ্কিত ও আতঙ্কিত। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এর কারণ কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ, সামরিক অভিযান বা ক্ষেপণাস্ত্র নয়, বরং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব। এটি কোনো হলিউড সিনেমার গল্প কিংবা কল্পনা নয়, করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারির ভয়াল ত্রাসে বিপর্যস্ত বর্তমান পৃথিবীর বাস্তব চিত্র।
দ্রুত কেটে যাবে মহামারি- এমন একটি সুখবরের অপেক্ষায় যখন অপেক্ষারত পৃথিবীবাসী, ঠিক সে মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাল, হয়তো এখন থেকে করোনাকে সাথে নিয়েই আমাদের সবকিছু ভাবতে হবে। এটি নিশ্চিতভাবেই হতাশার বার্তা। অণুজীববিজ্ঞান, জিন প্রকৌশল ও চিকিৎসাশাস্ত্র প্রসারের এ যুগে, মানুষ যেমন এখন মহামারি সংক্রান্ত দুর্যোগ সামলাতে ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে, তেমনি গ্লোবাল ভিলেজের ধারণা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুও বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, ভাইরাসের জিন নকশা পরিবর্তন ইত্যাদি আধুনিক মানুষকে আজ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মহামারির বিপদে ফেলেছে।
কী হতে পারে ইতিহাসের শিক্ষা?
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রত্যেকটি প্রাণীর বিবর্তন ঘটেছে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এর মাধ্যমে। যেসব প্রাণী এই প্রক্রিয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি, তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বহু অণুজীবের সংক্রমণের শিকার হয়েছে। প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই লক্ষ-কোটি বছরের মানব সভ্যতা এখনও টিকে আছে। বিজ্ঞানীরা মানুষের প্রাচীন ফসিল বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের নিদর্শন পেয়েছেন। প্লেগ, গুটি বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, পীতজ্বর, স্প্যানিশ ফ্লু’র মতো অনেক জানা-অজানা অণুজীব সৃষ্ট মহামারিতে প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ, ধ্বংস হয়েছে অনেক সভ্যতা।
জীবন কি আর স্বাভাবিক হবে না?
স্বাভাবিক জীবনের অর্থ- পরিস্থিতি এমন হতে হবে, যখন মনে হবে কোভিড-১৯ নামক কোনো মহামারি কখনও ছিলই না। একমাত্র প্রতিষেধকই পারে আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে। হোয়াইট হাউজের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ডা. ফসি বলেছিলেন, পৃথিবী করোনামুক্ত হলেও করোনা প্রাদুর্ভাবের পূর্বে মানুষের যে স্বাভাবিক জীবনযাপন ছিল, তা হয়তো আর কখনোই ফিরে আসবে না। ভ্যাকসিন পৃথিবীকে করোনামুক্ত করলে মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। কিন্তু সেই জীবনযাত্রা করোনা পূর্ববর্তী মানুষের জীবনযাত্রা থেকে আলাদা হবে। অর্থাৎ করোনা পরবর্তী বিশ্ব হয়তো আমাদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি বিশ্বের সূচনার মতো হবে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব সৃষ্ট মহামারির প্রভাবে বহু সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে, আবার নতুনভাবে চিত্রিত হয়েছে আর্থসামাজিক চিত্র, বদলে দিয়েছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমীকরণ। অনেক সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। আবার নতুন সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। যারা হারিয়ে গেছেন, তারা ইতিহাস হয়েছেন। যারা টিকে ছিলেন, তারা হয়েছেন সেই ইতিহাসের সাক্ষী। এসব মহামারির প্রভাবে পাল্টে গেছে পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়ম-কানুন। মানুষ সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ফিরে এসেছে স্বাভাবিক জীবনে।
বাংলাদেশের কী হবে?
কোভিড-১৯ মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে। বিঘ্নিত হয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। হুমকির মুখে পড়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্র। বাংলাদেশও এ পরিস্থিতির বাইরে নয়।
যেহেতু প্রতিষেধক নেই, তাই প্রতিরোধই সর্বোত্তম পন্থা। উহান শহরে প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণের পর, পুরো হুবেই প্রদেশকে অবরুদ্ধ করে চীন। তারা প্রায় ৫ কোটি মানুষকে আইসোলেশনে পাঠিয়েছে, দ্রুততম সময়ে তৈরি করেছে নতুন হাসপাতাল। রাশিয়া ও ইংল্যান্ড তাদের দেশে কড়া বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়া শুরু থেকেই ব্যাপক আকারে ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করেছিল। হংকংয়ে উপসর্গ রয়েছে, এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আলাদা করা হয়েছিল, জোর দেওয়া হয়েছিল কোয়ারেন্টিনে। এছাড়াও বিদেশ থেকে আগতদের উপর কড়া নজরদারি করা হয়েছিল।
সিঙ্গাপুর কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের দিনে কয়েকবার বাধ্যতামূলক নিজের অবস্থানের ছবি তুলে কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করতে হয়েছে । মহামারি প্রতিরোধে দেশগুলো দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায়, সংক্রমণের হার কমে এসেছে- এমনটাই বলা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসব সফল দেশের অনুকরণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বা সময়োপযোগী, তা দ্রুত নিতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ একদিনে ৫০০ (৫.৯০ মার্কিন ডলার) টাকার বেশি আয় করে। বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের কারণে, সর্বত্র কাজ কমে যাওয়ায় অর্থসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে অর্থসংস্থান নেই, সেখানে বাঙালি নিম্নবিত্তের জন্য লকডাউন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। এখানে মধ্যবিত্তের অবস্থা আরও শোচনীয়। করোনা মধ্যবিত্তকে নামিয়েছে নিম্নবিত্তের কাতারে। মজুদ ফুরিয়েছে, সঞ্চয়ও শেষ। বর্তমান পরিস্থিতিতে, দেশে নতুন করে একটি দরিদ্র শ্রেণী তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে লকডাউন এই শ্রেণীর জন্য একরকম বিলাসিতার বিষয়। প্রথাগত ত্রাণ সহায়তার বাইরে এসে তাদের জন্য জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে খাদ্যের। তাই এই খাতকে যতটা সম্ভব ঢেলে সাজানোর কথা মাথায় রাখতে হবে। উপরন্তু, দেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অসচেতনতা, দুর্নীতি, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় আগুনে ঘি ঢালার কাজ করছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি না করে এ অবস্থায় মহামারি মোকাবেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যেহেতু এই পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা সম্ভব না, এক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
যেহেতু ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত মানুষের হাতে আসেনি, সেহেতু মহামারি ঠেকাতে একমাত্র উপযুক্ত উদ্যোগই পারে কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে। স্বল্প সময়ে রোগ নির্ণয় ও ভাইরাস শনাক্তকরণ, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে গোটা দেশে। শুধু সরকারের একার পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বস্তুত, প্রত্যেক নাগরিকের যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হওয়া ব্যতীত দ্বিতীয় পথ খোলা নেই।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে একসময় হয়তো পৃথিবী করোনামুক্ত হবে। কিন্তু কবে নাগাদ এই ভ্যাকসিন আমরা পাব, তা বলা যাচ্ছে না। বিগত বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিল। কিন্তু আফসোস, আমরা কোনো শিক্ষা নিতে পারিনি। যেখানে উন্নত বিশ্ব করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অবস্থা কী হতে পারে, তা কল্পনা করলেই গা শিউরে ওঠে।
স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হলে পৃথিবীকে করোনামুক্ত হতে হবে। একমাত্র কার্যকর ভ্যাকসিনই পারে আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে। যতদিন পর্যন্ত আমরা হাতে ভ্যাকসিন পাব না, ততদিন পর্যন্ত নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, সচেতনতা ও রোগ শনাক্তকরণই পারে মহামারীর বিস্তার রোধ করতে।
বাংলাদেশকে অবশ্যই সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে দ্রুত উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। এক্ষেত্রে একসময়কার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ জাপান বাংলাদেশের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। এছাড়া, ডিজিটাল কারেন্সি, ই-কমার্স, ই-লার্নিং, টেলিমেডিসিন, উন্নত প্রযুক্তি ইত্যাদি যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করে, সময় বাঁচায়, আবার ঘরে বসে উপার্জনের মাধ্যমও তৈরি করে। বাংলাদেশেও বিষয়গুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
বস্তুত, আমরা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত অবস্থায় আছি, যেখানে শত্রু অদৃশ্য। আমরা অস্ত্রবিহীন হওয়ায় নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করা ছাড়া, শত্রুর হাত থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। কেউই জানি না, কার দুয়ারে কখন কড়া নাড়বে একবিংশ শতাব্দীর যমদূত!