পাকিস্তানের পাঞ্জাব, ২০০৯ সালের এক দিন। দিনটা শুরু হয়েছিল বাকি আর পাঁচটা দিনের মতোই। আসিয়া বিবি ঘর থেকে বের হয়ে ফল পাড়ার কাজ করছিলেন। কাজের ফাঁকে তৃষ্ণার্ত হয়ে এক পর্যায়ে বালতি থেকে কাপে পানি তুলে পান করলেন তিনি। আসিয়ার সাথে কাজ করছিলেন যে বাকি চার নারী, তারা ফুঁসে উঠলেন। আসিয়ার পুরো নাম আসিয়া নরিন। পাকিস্তানে অতি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর একজন তিনি। বাকি চারজন মুসলিম, তারা দাবি করলেন, আসিয়া পানি পান করায় তাদের পানি অপবিত্র হয়ে গেছে। এক কাপ পানির বিতর্কে আসিয়া বিবি আর বাকিদের মাঝে ঝগড়া হলো, গায়েও হাত তোলা হলো একে অপরের।
এই ঘটনার পর এদের মাঝে মুসলিম দুই নারী মাফিয়া বিবি ও আসমা বিবি দাবি করলেন, আসিয়া ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। ফলাফল হলো ভয়ানক। গ্রামের লোকজন আসিয়াকে চাপ দিতে শুরু করলো ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার জন্য। আসিয়া বিবি না মানলে তার নামে মামলা করার ভয় দেখালো। আর পাকিস্তানে ব্লাসফেমি বা ধর্মের অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এরপর আসিয়া বিবির নামে মামলা করা হলো, মামলার সাক্ষীদের দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া বাকিরা সবাই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনেছে বলে জানায়। পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে আজ পর্যন্ত কারো ফাঁসি হয়নি, তবে ব্লাসফেমির দায়ে অভিযুক্ত এমন অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। আসিয়া চার চারটা সন্তানের মা। কোন ধরনের মৃত্যু বেছে নেবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। জেলের মাঝে বেঁচে থাকা, নাকি নির্মম কোনো ধর্মান্ধের হাতে অজানা মৃত্যু? আসিয়াকে এসব ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হলো। আর্থিক অবস্থাও তার এমন ছিল না যে কোনো উকিল রেখে মামলা চালিয়ে নিয়ে যাবেন। যা হওয়ার হলো, নির্দিষ্ট প্রমাণ ব্যতিরেকেই আসিয়া বিবির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এলো। শুরু হলো আসিয়ার কারাগারের দিন। আসিয়া পাকিস্তানের প্রথম নারী, যাকে ব্লাসফেমির মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
আসিয়ার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। ইসলামের স্বর্গীয় ক্ষমা আর শান্তি? নাকি তথাকথিত ধর্মের রক্ষীদের প্রাণের দাবি? তখন পাঞ্জাব রাজ্যের গভর্নর সালমান তাসিরের পছন্দ হয়নি এই বিচার। তিনি কথা বলেছিলেন ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে। তার নিজের দেহরক্ষী মুমতাজ কাদির তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যার দায়ে মুমতাজ কাদিরের ফাঁসি হলেও একদল মানুষ তাকে নিজেদের আদর্শ বানিয়ে আন্দোলন-অশান্তি চালিয়ে যায়। মুমতাজ কাদরির কবর হয়ে ওঠে মাজার, তার অনুসারীদের রাজনৈতিক দল এতটাই শক্তিশালী আর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের গত নির্বাচনে তারা জিতে নিয়েছিল ২০ লাখ ভোট!
অন্যদিকে আসিয়া কারাগারে নিজেকে বার বার নিজেকে নির্দোষ দাবি করতে থাকলেও তার বক্তব্য ধোপে টেকেনি। কারাগারে ছিলেন বলেই হয়তো বেঁচে আছেন এতদিন। অন্য অনেক দেশের বিচার ব্যবস্থার মতো পাকিস্তানের আদালতেও বাদীকে তার বক্তব্য প্রমাণের জন্য চাপ দেওয়া হয়। কোনো প্রকার সন্দেহ থাকলে, সন্দেহের সুফল ভোগ করবে বিবাদী, যা হয়নি আসিয়া বিবির বেলাতে।
আসিয়া বিবির মামলার রায় দেওয়ার সময় বিচারকেরা বলেছিলেন, “এই মামলা এতদিন ধরে কোর্টে কোর্টে ঘোরার কথা ছিল না।” তাহলে যদি আসিয়া বিবি নির্দোষ, অথবা অপ্রমাণিত দোষীই হবেন, তবে কেন তার জীবনের দীর্ঘ আটটা বছর হারিয়ে গেল কারাগারের অন্ধকারে?
কারণ, বিষয় শুধু ধর্মীয় অবমাননার ছিল না, বিষয়টা আর তিন-চার মহিলার পানি পানের ঝগড়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বিষয়টা হয়ে উঠেছিল রাজনীতির শক্তিশালী হাতিয়ার। দীর্ঘ ৮ বছরের সামরিক শাসন শেষে গণতন্ত্রের দিকে ফিরতে থাকা পাকিস্তানের কর্ণধারেরা তখন চায়নি আসিয়া বিবিকে দায়মুক্ত করে বিশাল ভোটব্যাংক হারাতে। তাছাড়া বামঘেঁষা দল পিপিপির ধর্মীয় আচরণে সন্দেহ ছিল দেশের মানুষের, তা মেটাতেই আর এগোতে পারেনি সরকার। সালমান তাসিরের চেয়ে বড় উৎসর্গের জন্য প্রস্তুতও ছিল না দলটি। কিন্তু আক্রমণ থামেনি। সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকেও গুলি করে হত্যা করা হলো।
উগ্রপন্থীরা একের পর এক আন্দোলন করে দাবি করছিল আসিয়া বিবির, অথবা যে বিচারক তাকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে, তার রক্ত! একের পর এক ছোট আদালতে মামলা ঘুরতে থাকল। কিন্তু ছোট আদালতের বিচারকরা একপ্রকার প্রাণভয়েই কোনো বিচারের দিকে গেলেন না, যেহেতু তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত কম। এভাবে মামলা ঘুরতে ঘুরতে উচ্চ আদালতে এলে ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে এই বছর দায়মুক্ত হলেন আসিয়া বিবি।
এর মাঝেই আসিয়া বিবি মামলা নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি, হত্যা করা হয়েছে দুজনকে। বিচারক তিনজনই জানতেন, তাদের মৃত্যুঝুঁকি আছে। প্রাণের ভয় থাকা সত্ত্বেও তারা উগ্রপন্থীদের দাবির বিরুদ্ধে গিয়ে রায় দিলেন। এদের মাঝে একজন বিচারক নিসার, যিনি কি না দ্রুতই অবসরে চলে যাবেন। তার কাছে সুযোগ ছিল মামলাটাকে অবসরের পর নিয়ে যাওয়া, যাতে কোনো দায় তার উপর না বর্তায়। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে তিনি কাজটা শেষ করেন।
তারপর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, আরো একবার পাকিস্তান ফেটে পড়েছে বিক্ষোভে। রাস্তা বন্ধ করা, ভাঙচুর করা, বিচারকদের প্রাণনাশের হুমকি, আসিয়ার পরিবারকে অনবরত হুমকি দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছিল, আসিয়া জেলমুক্তির পর পরিবারসহ অন্য কোনো দেশে চলে যাবেন এবং সেটাই তার জন্য নিরাপদ হবে। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে বাইরেই আসতে পারছেন না আসিয়া।
এদিকে টানা বিক্ষোভের মাঝে পড়ে ইমরান খান সরকার উগ্রপন্থী ও ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে থাকা তেহরিক-ই-লাব্বাইকের সাথে সমঝোতা করেন। সমঝোতা অনুযায়ী, আসিয়া বিবিকে দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। আসিয়া বিবিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য যদি দলটি আবার আদালতে আবেদন করে, তবে বিরোধিতা করবে না সরকার। বিক্ষোভের জন্য যতজনকে ধরে নেওয়া হয়েছিল, তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
একদিকে আসিয়া বিবিকে দেওয়া হয়েছে দায়মুক্তি, তারপর আবার হয় কারাগার, নাহয় আততায়ীর হামলা। একপ্রকার জলে কুমির ডাঙায় বাঘের মতো ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে তার জন্য। কেন এমনটা করা হলো- সেই প্রশ্নের উত্তরে ইমরান খান অনেক কিছুই বলেছেন, সেসব অনেকটা বিক্ষোভকারীদের তিরস্কারের মতো। কিন্তু একজন সরকারপ্রধানের জন্য তিরস্কারের বেশি কিছু করার আছে কি না, সেই স্থান স্পষ্ট হয়নি তার অবস্থানে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন,
“আমাদের কাছে দুটো রাস্তা ছিল, হয় শক্তি প্রয়োগ, নয়তো সমঝোতা, শক্তি প্রয়োগে অনেক প্রাণক্ষয় হতে পারতো। কোনো রাষ্ট্রই এমনটা চাইবে না। দ্বিতীয় রাস্তা হিসেবে আমাদের সমঝোতা করতে হয়েছে। আর সবসময় সমঝোতায় কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হবেই।”
আসিয়া বিবির উকিল সাইফ মুলুক প্রাণভয়ে পাকিস্তান ছেড়েছেন, যাওয়ার আগে এএফপিকে বলে গেছেন, তার পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়া দরকার, বেঁচে থাকা দরকার, যেন তিনি আসিয়া বিবির হয়ে লড়তে পারেন। তার মতে, আসিয়া বিবিরও সুযোগ পেলে প্রাণ বাঁচাতে অন্য দেশে পাড়ি জমানো উচিত।
আসিয়া বিবির ঘটনায় আসিয়া বিবি সত্যিই ইসলামকে কটূক্তি করেছিলেন কি না, এ নিয়ে সন্দেহ জানিয়েছিল তদন্তকারী পুলিশেরাও। তারা বলেছিল, মাফিয়া ও আসমা বিবির ঘটনা শুধু গ্রাম্য লড়াই জিততে সাজানো অভিযোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিচারকেরা রায়ের সময় কোরআনের বিভিন্ন আয়াত বর্ণনা করেন। তারপরেও যদি ধরে নেয়া যায়, আসিয়া বিবি সত্যই ধর্মের অবমাননা করেছিলেন, রাসূলকে (সা.) গালমন্দ করেছিলেন, তাহলে সেই রাসূলের (সা.) উম্মতরা কেন তার ক্ষমার মহৎ দৃষ্টান্ত গ্রহণ করল না তা বোঝা যায় না।
ঈশ্বরকে বাঁচানোর দায় কাঁধে নিয়ে পর্দার আড়ালে থাকা কোনো হাতকে রক্ষা করে চলেছি। ভুলে যাচ্ছি, ঈশ্বর শান্তি রক্ষার দায়িত্বও দিয়েছিলেন। মানুষ চাইলেই পারে নিজে বাঁচতে, পৃথিবীকে বাঁচাতে, অথবা কারাগারে নোংরা বিদ্বেষভরা অন্ধকারে জীবন নষ্ট করা আসিয়াদের একটা নিরাপদ, সুন্দর স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে।