বানানা রিপাবলিক: রাষ্ট্র যখন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি থাকে

‘বানানা রিপাবলিক’; শব্দজোড়া শোনার পর হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিকের সাথে আবার কলার সম্পর্ক কোথা থেকে আসলো? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাঠখোট্টা বিষয়ের সাথে একটি অতি সাধারণ ফলের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় আপনি অট্টহাসিতেও ফেটে পড়তে পারেন। কিন্তু বাস্তবে ‘বানানা রিপাবলিক’ দিয়ে হাস্যরসাত্মক কিছু বোঝানো হয় না, বরং এই শব্দজোড়ার মাধ্যমে এমন একটি রাষ্ট্রকে বোঝানো হয় যেটি কোনো বিদেশি ব্যবসায়ী কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্র বা অন্য কোনো উপায়ে হয়তো কখনও আপনি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ শব্দযুগলের কথা শুনেছেন। একটি রাষ্ট্র যখন সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য দায়িত্বগুলো পালনে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন সেই রাষ্ট্রকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র (Failed State) বলি। বানানা রিপাবলিকও ব্যর্থ রাষ্ট্রের মতোই নেতিবাচক অর্থ বহন করে।

বানানা রিপাবলিকগুলোতে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সবসময় অস্থিশীলতা বজায় থাকে। সেনা অভ্যুত্থান এখানকার নিয়মিত ঘটনা। আগেই বলা হয়েছে, বানানা রিপাবলিকে ব্যবসায়ী কিংবা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্র জিম্মি হয়ে পড়ে। এই ব্যবসায়ী বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কখনোই চায় না দেশটির শাসনক্ষমতায় এমন শাসকগোষ্ঠী আসুক, যারা তাদের একচেটিয়া ব্যবসা ও লুন্ঠনে সমস্যা সৃষ্টি করবে। এজন্য দেখা যায় যখনই বানানা রিপাবলিকগুলোতে কোনো সরকার ব্যবসায়ীদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় কিংবা তাদের সাথে কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, তার কিছুদিন পরেই সেসব দেশে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে এবং নতুন সরকার এসে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়।

এছাড়া রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়মিত উৎকোচ প্রদান করে ব্যবসায়ীরা, যাতে তাদের শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা যেকোনো মত দমন করা হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা দেশের প্রকৃত হর্তাকর্তা হয়ে বসে।

হডওতপতকআ
বানানা রিপাবলিকগুলোতে সামরিক গণঅভ্যুত্থান খুবই সাধারণ বিষয়; image source: hrw.org

ঔপনিবেশিক আমলে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো প্রথমে বাণিজ্যিক শক্তি হিসেবে উপনিবেশগুলোতে হাজির হয়েছিল। পরবর্তীতে স্থানীয়দের হটিয়ে তারা উপনিবেশের অর্থনীতি দখল করে নেয়। অর্থনীতিতে নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার পর এরপর রাজনীতির দিকে তারা দৃষ্টিপাত করে এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগ, অভ্যন্তরীন কোন্দলের সুযোগ গ্রহণসহ নানাভাবে রাজনীতিতেও ভাগ্যবিধাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় তারা। যেমন- ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা আলোকপাত করি, তাহলে দেখতে পাব ব্রিটিশরা বাণিজ্যিক শক্তি হিসেবে এই উপমহাদেশে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের স্থানীয় শিল্পগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে তারা অর্থনীতি করায়ত্ত করে ফেলে। অর্থনীতির পর ভারতের স্থানীয় রাজ্যগুলোর অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একসময় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতাও দখল করে নেয়।

হডওতগলগ
লাতিন আমেরিকায় খুব অল্প দামে শ্রম কেনা যেত; image source: blog.oup.com

লাতিন আমেরিকায় কিছু দেশে সস্তা শ্রম ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছিল গত শতাব্দীর প্রথম দিকে। আমেরিকায় তখন শিল্পবিপ্লবের কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে বেশকিছু পুঁজি জমা হয়েছে, তাই লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে মুনাফা অর্জনের সুযোগ নিতে খুব বেশি দেরি করেনি আমেরিকান কোম্পানিগুলো।

আমেরিকায় শিল্পবিপ্লবের কারণে যে বিশাল শ্রমিকশ্রেণী তৈরি হয়েছিল, তাদের কাছে কলা একটি পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করেছে। লাতিন আমেরিকার আবহাওয়া ছিল কলা উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এজন্য আমেরিকার ফল কোম্পানিগুলো লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে কলা ও অন্যান্য ফল আমদানি শুরু করে। হন্ডুরাস কিংবা গুয়াতেমালার মতো দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় পুঁজির বিশাল ঘাটতি থাকায় তারা পরবর্তীতে এই কোম্পানিগুলোর উপরেই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য নির্ভর করতে শুরু করে।

গুয়াতেমালা, লাতিন আমেরিকার একটি দেশ। ১৮৯৯ সালের দিকে আমেরিকার বোস্টনের একটি ফল কোম্পানি গুয়াতেমালায় ব্যবসা করতে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি নামের সেই প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের বিনিময়ে গুয়াতেমালার বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয়। পরবর্তীতে এই বিশাল অঞ্চলের জঙ্গলগুলো পরিষ্কারের মাধ্যমে তারা আবাদযোগ্য করে তোলে এবং স্থানীয় সুলভ শ্রম কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ কলা উৎপাদন করে।

গুয়াতেমালার অর্থনীতি ছিল কলানির্ভর, তাই গুয়াতেমালার সরকারকে ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির দিকেই তাকিয়ে থাকতে হতো। এই সুযোগে ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের আরও প্রসার ঘটায়, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। একসময় দেখা যায়, গুয়াতেমালার প্রায় অর্ধেক জমি ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির হাতে চলে এসেছে।

বয়হডপগেগে
ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি গুয়াতেমালা ও হন্ডুরাসসহ লাতিন আমেরিকার কলা ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য লাভ করেছিল;
image source: philippebourgois.com

বানানা রিপাবলিকের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো সেখানকার সমাজে বৈষম্য খুব প্রকট আকার ধারণ করে। প্রধানত সমাজে দুটি বড় শ্রেণী থাকে। অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা বাণিজ্যিক কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে থাকেন। অপরদিকে কোম্পানির শ্রমিক হিসেবে কাজ করা মানুষেরা সমাজের আরেকটি শ্রেণীতে থাকেন। এই মানুষগুলোর সামাজিক অধিকার থাকে না, রাষ্ট্র এই শ্রমিকদের উঁচুশ্রেণীর নাগরিকের মতো গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি গুয়াতেমালায় সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বিশাল মুনাফা অর্জন করলেও সেখানকার শ্রমিকশ্রেণীর উন্নয়নের জন্য আলাদা কোনো ব্যয় করতো না। এই ধরনের সমাজে যেকোোন শিশুর প্রধান লক্ষ্য থাকে কোম্পানির যেকোনো পদে চাকুরে হিসেবে যোগ দেয়া। এতে অর্থ ও সম্মান দুটোই মেলে। সমাজের কোনো শ্রমিক যে পরবর্তীতে অর্থ কামিয়ে শেষ বয়সে আয়েশি জীবনযাপন করবে– এরকম ব্যবস্থাও ছিল না।

নশজতজতকত
বানানা রিপাবলিকগুলোত সামাজিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে থাকে; image source: huffpost.com

বানানা রিপাবলিকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে প্রচুর রাষ্ট্রীয় অপরাধের ঘটনা ঘটে। সমাজের একেবারে নিচু শ্রেণীতে যারা অবস্থান করে অর্থাৎ শ্রমিকেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অনেক সময় বামপন্থার দিকে ঝুঁকে যায়, অনেক সময় দাবি আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার চেষ্টা করে। যেহেতু শ্রমিকদের দাবি পূরণ করতে গেলে কোম্পানির মুনাফা কমে যাবে, তাই কোম্পানি কখনোই চায় না শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামুক কিংবা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে উৎপাদন ব্যাহত করুক। এ জন্য যখনই কোনো শ্রমিক অসন্তোষ গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, তখনই কোম্পানির তাবেদার রাষ্ট্র শ্রমিকদের উপর হামলা চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। গুয়াতেমালা কিংবা হন্ডুরাসের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেখানে হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য অপহরণের পরিমাণ লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে যে, একসময় রাষ্ট্রের মসনদে কে বসবে– এটাও তারাই নির্ধারণ করে দেয়। কখনও যদি এরকম দেখা দেয় যে জনগণের নির্বাচিত সরকার কোম্পানির লুটপাটের প্রতিবাদ করছে– তখন সেই সরকারকে উৎখাতের জন্য কোম্পানি মরিয়া হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জান্তা সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়, যেহেতু তারা কোম্পানির একচেটিয়া লুন্ঠনের প্রতি বরাবরই সমর্থন দিয়ে থাকে। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সেনাবাহিনীর পেছনে প্রচুর অর্থ ঢালে কোম্পানিগুলো। বানানা রিপাবলিকগুলোর নামেমাত্র উন্নয়নের মাধ্যমে কোম্পানি তাদের লুন্ঠনের বৈধতা আদায় করে নেয়।

‘বানানা রিপাবলিক’ (Banana Republic) এই শব্দজোড়া প্রথম ব্যবহার করেন আমেরিকান লেখক ও. হেনরি তার ‘Cabbages and Kings’ বইয়ে। হন্ডুরাসের তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি সেদেশের এই নাম দেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে এই শব্দজোড়া জনপ্রিয়তা লাভ করে। ঔপনিবেশিক শাসনকাল অতিক্রম করে এলেও বানানা রিপাবলিকগুলো আসলে নয়া উপনিবেশ ব্যতীত কিছুই নয়। এখানকার লাখ লাখ জনগণ গুটিকয়েক ব্যক্তির কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বানানা রিপাবলিককে অনেক বছর পিছিয়ে দেয়, সেই সাথে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে। বানানা রিপাবলিক কখনোই ইতিবাচকতা প্রকাশ করে না, বরং একটি দেশের বন্দিদশাকেই ভিন্ন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে।

Related Articles

Exit mobile version