পরিবেশবান্ধব ছয় কাপড়

বর্তমানে সবাই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো পোশাকের সন্ধানে থাকে। সচেতন মানুষেরা শুধুমাত্র পোশাকের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়েই মেতে থাকে না। পোশাক কোন কাপড় দিয়ে তৈরি, আরামদায়ক নাকি, এর স্থায়িত্ব কেমন বা কাপড়টি পরিবেশবান্ধন নাকি তা নিয়েও ক্রেতাদের থাকে হাজার প্রশ্ন। আজকে এমন ছয়টি কাপড় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো যা একজন সচেতন ক্রেতার মোটামুটি সব শর্তই পূরণ করে। 

আনারসের লেদার বা চামড়া 

কোনো ফল বা উদ্ভিদের ‘লেদার’ বা ‘চামড়া’ মানে হলো তাদের উচ্ছিষ্ট বা পচে যাওয়া অংশ দিয়ে তৈরি চামড়া। বর্তমান বিশ্বে এই ধরনের চামড়া বেশ সাড়া ফেলেছে।‘পাইনেটেক্স’ এরকমই একটি ‘ফ্রুট লেদার’, যা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় আনারসের পাতা। এর উৎপত্তিস্থল হলো ফিলিপাইন। সাধারণত যেসব প্রক্রিয়ায় চামড়াকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয় সেগুলোর তুলনায় এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট ভালো। আনারসের চামড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে পানি যেমন কম লাগে তেমন ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করারও প্রয়োজন হয় না।

পাইনেটেক্স; Image source: inside-fashion.net

এতে করে ট্যানারিতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য এই ধরনের চামড়া উৎপাদনের কাজটি নিরাপদ। আনারসের চামড়া তৈরিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডও কম উৎপন্ন হয়। তাছাড়া কাজ শেষ হলে আনারসের পাতার যে অবশিষ্ট থাকে সেটা রিসাইকেল করা যায়। আর তা সম্ভব না হলে পরিবেশবান্ধব সার উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ এই ধরনের প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য ভালো। তাছাড়া এই লেদার সুতি, সিনথেটিক এবং অন্যান্য চামড়ার চাহিদা কমায় যেগুলো পরিবেশবান্ধব নয়। বর্তমানে লন্ডনের প্রথম ভেগান হোটেল স্যুটে এই ধরনের চামড়া ব্যবহার করা হচ্ছে।

উল

যদিও সব উল বা রোঁয়ার ফার্মগুলো মানসম্মত নয়, তবে উলের সঠিক ব্যবহার স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দুটোর জন্যই কল্যাণকর। উল বেশ টেকসই, মজবুত ও নবায়নযোগ্য। বিভিন্ন ধরনের উল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। সাধারণত ভেড়া, ছাগল, খরগোশ, লামা এবং ইয়াকের লোম থেকে এসব উল বা রোঁয়া তৈরি হয়। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে অ্যাঙ্গোরা খরগোশ, কাশ্মীরি ছাগল, মোহ্যার (অ্যাঙ্গোরা ছাগল) এবং ম্যারিনোর (ভেড়া) লোম থেকে উল উৎপাদন করা হয়। এসব উলের স্থায়িত্ব, কোমলতা ও নবায়নযোগ্যতার দিক থেকে ভিন্নতা রয়েছে। এসব উল দিয়ে মূলত শীতের কাপড় ও কার্পেট তৈরি করা হয়। সিনথেটিক কাপড়ের পোশাক ঘাম শুকাতে দেয় না। ফলে পরিধানকারী গরম এবং অস্বস্তি বোধ করে। অন্যদিকে, উল দিয়ে বানানো পোশাকে একদম ছোট ছোট ছিদ্র থাকে যা দেহের ঘাম শুকাতে ও আর্দ্রতা রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাছাড়া উলের তৈরি পোশাক বা কার্পেট আগুন প্রতিরোধ করতে সক্ষম এবং এসব পোশাক জল বিতাড়কও বটে। এতে করে উলের এসব পোশাক অনেকদিন টেকে এবং ভালো থাকে।

উল; Image source: wensleydalelongwool.co.uk

সিনথেটিকের তুলনায় উলের পরিবেশগত উপকারিতাও রয়েছে। উল উৎপাদনকারীদের অনেকে এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, যা পরিবেশ থেকে কার্বন শোষণ করে নেয়, যা কিছুটা হলেও পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়তা করে। তাছাড়া উলের মূল উপাদানই একটি নবায়নযোগ্য বস্তু। প্রতি বছরই ভেড়া ও আরো কিছু প্রাণীর নতুন করে লোম হয়। অর্থাৎ তাদের তখন আর পুরনো লোমের প্রয়োজন হয় না। আর এসব পশুদের অপ্রয়োজনীয় লোম দিয়েই উল উৎপাদিত হয়। ফলে এক্ষেত্রে কোনো পশুর প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয় না। 

স্কুইডস ইন

বায়োমিমিক্রি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে প্রকৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত কোনো জিনিস বা বস্তুর উপর নির্ভর করে কোনো নকশা তৈরি করা হয়। প্রকৃতিকে দেখার এক নতুন পথ দেখিয়েছে বায়োমিমিক্রি। বর্তমানে এই প্রক্রিয়া প্রকৌশল, স্থাপত্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটি ব্যবহার করেই ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক প্রোটোটাইপ কৃত্রিম চামড়া তৈরি করে যা দেখতে ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে স্কুইডের চামড়ার ন্যায়। গবেষকেরা কৃত্রিম সেফালোপোড ক্রোমাটোফোরস সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এসব কোষ স্কুইড ও অক্টোপাসের কোষের ন্যায় দেহের রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম। ফলশ্রুতিতে, কৌশলে যেকোনো বিপজ্জনক ব্যক্তি বা পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। তাছাড়া স্কুইডস ইন দিয়ে বানানো পোশাকের তন্তুগুলোতে আমিষের আবরণ দেওয়া। এই আবরণ কাপড়ের স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। স্কুইডস ইন রিসাইকেল ও নবায়নযোগ্য কাপড় তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। 

লিনেন

লিনেন একপ্রকার প্রাকৃতিক তন্তু যা যুগের পর যুগ ধরে এর অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের জন্য টিকে আছে। আরামদায়ক পোশাকের কথা উঠলে এই লিনেনের নাম এমনিতেই সবার মুখে চলে আসে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই কাপড় যত বেশি ধোয়া হয় বা ব্যবহার করা হয় তত বেশি নরম ও আরামদায়ক হয়ে যায়। এর স্থায়িত্ব সুতি কাপড়ের তুলনায় শতকরা ৩০ ভাগ বেশি। ভালোমতো যত্ন নিলে কয়েক দশক আরামেই পার করে দেওয়া যাবে।

লিনেনের একটি সুবিধা হলো এই কাপড় আপনি বছরের যেকোনো সময়ই ব্যবহার করতে পারবেন। গরমের সময় বাইরের উত্তাপ থেকে দেহকে রক্ষা করে এবং শীতের সময় শরীরকে গরম রাখে। গরমের সময় শতকরা ২০ ভাগ ঘাম লিনেন শোষণ করে। ফলে গরম ও অস্বস্তি কম লাগে। অন্যদিকে, শীতকালে জামা এবং চুল বা শরীরের ঘর্ষণে যে স্থিরতড়িৎ সৃষ্টি হয় তার শতকরা ১০ ভাগই প্রতিহত করতে সক্ষম এই লিনেন। অর্থাৎ আপনার দেহকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে একেবারে খাপ খাইয়ে নিতে লিনেন সহায়তা করে থাকে। যাদের চামড়ায় কোনোপ্রকার সমস্যা, যেমন- চুলকানি বা অ্যালার্জি থাকে, তাদের জন্য এই কাপড় ব্যবহার করা নিরাপদ।

লিনেন; Image source: thespruce.com

কারণ এতে কোনোপ্রকার কৃত্রিম উপাদান মিশ্রিত থাকে না। লিনেন তন্তু পুরোপুরি বায়োডিগ্রেডেবল। যারা পরিবেশ নিয়ে সচেতন তারা এই কাপড় ব্যবহার করতে পারেন। লিনেনের মধ্যে আবার ভিন্টেজ লিনেন সকলের কাছে এর স্থায়িত্ব ও কোমলতার কারণে বেশি সমাদৃত। লিনেন তন্তু তৈরি হয় শণ গাছ থেকে। এর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বৃষ্টির পানি ছাড়া অতিরিক্ত পানি লাগে না। আর আলাদা করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনোপ্রকার সার বা কীটনাশকের ব্যবহার নেই এই প্রক্রিয়ায়।

বেটার কটন

‘কটন’ বা ‘’তুলা’র প্রয়োজনীয়তা আসলে নতুন করে কিছু বলার নাই। আর তুলার তৈরি সুতির কাপড় সকলের কাছেই গুরুত্ব বহন করে। ধনী-গরিব, ছোট-বড় সকলেই দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য আরামদায়ক পোশাক চায়। এর জন্য সুতির কোনো বিকল্প চিন্তাই করা যায় না। তবে সমস্যা হলো এই প্রয়োজনীয় কাপড়ের ভবিষ্যত সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। এর পেছনে দায়ী পরিবেশবান্ধব নয় এমন কারখানা, কাজ করার অনুপযুক্ত অবস্থা এবং এর অস্থিতিশীল বাজার। পূর্বে সুতি কাপড় উৎপাদন ক্ষেত্রে অনিয়মের পরিমাণ ছিল আরো বেশি। অপ্রয়োজনীয় সার ব্যবহার, শিশুশ্রম ও শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেওয়া খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বেটার কটন; Image source: cotton-source.com

এগুলোর প্রতিবাদে ২০০৫ সালে কয়েকটি সংগঠন বাস্তববাদী কিছু সমাধানের মাধ্যমে এসব সুতি কাপড় তৈরির কারখানার ভবিষ্যত রক্ষার প্রচেষ্টা চালায়। ‘দ্য বেটার কটন ইনিশিয়েটিভ’ (বিসিআই) তুলার কৃষক, ব্যবসায়ী, পাইকারি বিক্রেতাদের একসাথে করে তুলা উৎপাদনের একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। বিসিআই কীভাবে বিষাক্ত সার বা কীটনাশক ছাড়া তুলা উৎপাদন এবং সুতি কাপড় তৈরি করা যায় সেই বিষয়ে শিক্ষাও দিয়ে থাকে। এই বিসিআই মূলত ‘গ্লোবাল অর্গানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ড’ লেবেলের তুলা উৎপাদন করে। এ ধরনের অর্গানিক তুলার তৈরি কাপড় তথা সুতি কাপড় যে একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে তাতেও কোনো প্রকার সন্দেহ নেই।

লায়োসেল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তু

কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি পোশাক ধোয়া হলে তা থেকে ক্ষতিকারক মাইক্রোব বের হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সেজন্য আমাদের এমন কৃত্রিম তন্তু উৎপাদন করা দরকার যা পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এরকম একটি তন্তু হলো লায়োসেল। কাঠমণ্ডের সেলুলোজ থেকে এই তন্তুর কাঁচামাল পাওয়া যায়।

লায়োসেল; Image source: simplififabric.com

এর ব্যবসায়িক নাম ‘টেনসেল’। লায়োসেল তৈরি করতে যে পানি ব্যবহার করা হয় তা মূলত ব্যবহৃত পানিকে রিসাইকেল কটে ব্যবহার করা হয়। ফলে পানির অপচয় হয় না। এই তন্তু পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণ হলো কোনো বিষাক্ত পদার্থ এতে দেওয়া হয় না। লায়োসেলের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মূল অবদান রয়েছে অস্ট্রিয়ার একটি কোম্পানির। ‘হেম্প’ আরেকটি প্রাকৃতিক তন্তু, যা পরিবেশের জন্যও ভালো। বর্তমানে যারা সচেতন ডিজাইনার তারা বাঁশ, কর্ক বা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েই পোশাক তৈরির চেষ্টা করে।

This article is in Bangla language. It's about six clothes which are environment-friendly. Sources have been hyperlinked in this article. 
Featured image: isorepublic.com

Related Articles

Exit mobile version